মোঃ মস্তাক আহমদ: পর্যটন শিল্পকে আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ও দ্রুত বর্ধনশীল শিল্প হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একটি পর্যটন শিল্পের দেশ হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নতুন ভাবে তার অবস্থান জানান দিতে যাচ্ছে। এই শিল্পের পরিকল্পিত উন্নয়ন সাধন করা গেলে দেশের জিডিপি বর্ধনে এই শিল্প অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অর্থাৎ রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার পর্যটন শিল্পের বিকাশ সাধনে সমস্যা, সম্ভাবনা ও করণীয় সম্পর্কে এই নিবন্ধে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। পর্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রকৃতিক সৌন্দর্য স্থানীয় এবং বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম। এই অঞ্চলের পাহাড় এবং উপত্যকাগুলো অত্যন্ত মনমুগ্ধকর। বৈশিষ্টগত দিক থেকে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে ভারতের দার্জিলিং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনেকটা মিল পরিলক্ষিত হয়। এই অঞ্চলের পাহাড়, উপত্যকা, মেঘের আনাগোনা অথবা সকালের সূূর্যোদয় কিংবা সন্ধ্যার সূর্যাস্ত সবকিছুর সাথেই দার্জিলিং এর সৌন্দর্যের এক মিলবন্ধন দৃষ্টিগোচর হয়। দার্জিলিং এর অর্থনীতি পুরোপুরি পর্যটন শিল্প নির্ভর। দার্জিলিং এর মত একই ধরণের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং আকর্ষণ থাকা সত্বেও আমরা এই শিল্প হতে কাঙ্খিত পরিমাণ রাজস্ব আহরণ করতে পারছি না। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে আমাদের পর্যটন শিল্পের বিকাশে সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব। আমরা আমাদের পাহাড়ী জমির অপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করছি। যেখানে সেখানে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মান করছি এমনকি পাহাড়ের চূড়ায় আমরা অপরিকল্পিত বাজার স্থাপন করছি। এই সব নির্মাণ ও স্থাপনা আমাদের পর্যটন শিল্পের বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে। আমাদের পর্যটকরা এই সব অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত স্থাপনা দেখে বিরক্তিবোধ করছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন শিল্পের বিকাশের অন্তরায় সমূহ হচ্ছে একটি সমান্বিত পর্যটন পরিকল্পনার অভাব; পর্যটন সহায়ক অবকাঠামো যথা- রাস্তা, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, নর্দমা নিষ্কাষণ ব্যবস্থা ইত্যাদির অভাব; মানসম্মত পর্যটন সেবার অভাব; প্রশিক্ষিত জনশক্তির অভাব; পর্যটন সম্পর্কিত প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব; প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাব এবং নিরাপত্তার অভাব। সুতরাং, একটি পর্যটন শিল্প নির্ভর অর্থনীতির উন্নয়ন এবং পর্যটক আকৃষ্ট করার পূর্বশর্ত হচ্ছে সকল অংশীদারদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরী। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমন্বিত পর্যটন পরিকল্পনা তৈরী এখন সময়ের দাবী। সরকার এ বিষয়ে একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানারস (বিআইপি) এর নবীন ও প্রবীন পরিকল্পনাবিদগণ এ বিষয়ে সরকার ও সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তর বা সংস্থাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করতে পারেন। একটি সমন্বিত পর্যটন পরিকল্পনা প্রণয়ণের পর উক্ত পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পর্যটন শিল্প উন্নয়নে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তর বা সংস্থাকে এ বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর নজরদারী রাখতে হবে যাতে পরিকল্পনার বাইরে কোন ধরণের স্থাপনা নির্মান বা উন্নয়ন না হয়। পরিকল্পনা মোতাবেক পর্যটন সহায়ক অবকাঠামো যথা রাস্তা, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, নর্দমা নিষ্কাষণ ব্যবস্থা ইত্যাদির উন্নয়ন করতে হবে। এছাড়াও পরিকল্পনা মোতাবেক পর্যটন বিকাশে কিছু বিশেষ অবকাঠামো যেমন-পার্ক, জাদুঘর, রিভার রাফটিং সুবিধাদি, প্যারা গ্লাইডিং গ্রাউন্ড ইত্যাদির নির্মাণ বাস্তবায়ন করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের সেবা সমূহ অত্যন্ত দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সাথে প্রদান করতে হবে। স্থানীয় জনগণ এবং বিভিন্ন সেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্টানকে পর্যটন সেবা প্রদান বিষয়ে আরও সচেতন এবং পেশাদার হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। সেবা সমূহের মধ্যে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ব্যববস্থানা, যাতায়াত ব্যবস্থাপনা, বিনোদন ব্যবস্থাপনা, পর্যটন গাইড ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয় অন্তভূক্ত থাকবে। সকল সেবা সমূহের সমন্বয়ে বিভিন্ন প্যাকেজ ব্যবস্থার প্রচলন করা যেতে পারে। পর্যটন শিল্পের বিকাশে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। প্রয়োজনে পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন উন্নয়নে বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন ধরণের প্রনোদনা প্রদান করতে হবে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমেও এ অঞ্চলে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যেতে পারে। ব্যাংক ও বিভিন্ন অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান সমূহকে এ অঞ্চলের পর্যটন শিল্পের বিকাশে বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন তফসিলী ব্যাংক সমূহকে নির্দিষ্ট হারে এ অঞ্চলের পর্যটন বিকাশে বিনিয়োগের নির্দেশনা প্রদান করতে পারে। পর্যটন শিল্পের বিকাশে নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা প্রয়োজন। যদিও পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে অনেক ভাল তারপরও এই শিল্প বিকাশে এই নিরাপত্তার ধারা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ সেনাবহিনী, বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ ও অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবহিনীর সদস্যদের সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে যেন কোন পর্যটকের মনে নিরাপত্তা নিয়ে ন্যূনতম সংশয় না থাকে। সর্বোপরি, পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য এই অঞ্চলের পর্যটনের প্রচার ও বাজারজাতকরণ একান্ত আবশ্যক। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন অন্যান্য সকল অংশীদারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের পর্যটন শিল্পের বিকাশে পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, প্রচার ও বাাজারজাত করণে প্রয়োজনীয় সকল কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। উপর্যুক্ত সকল প্রস্তাবনা সমূহের বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে বিশ্ব দরবারে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে উপস্থাপন করা সম্ভবপর হবে। পাশাপাশি এ অঞ্চল সমগ্র বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে আশা করা যায়। শুধুমাত্র একটি বাস্তবমুখী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে পর্যাপ্ত পরিমাণ রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। একটি বাস্তবমুখী পরিকরল্পনা প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশী এবং বিদেশী প্রচুর পর্যটক আকর্ষণ করা সমম্ভবপর হবে। শুধুমাত্র দেশী পর্যটকদের দার্জিলিং থেকে যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখী করা যায় তাহলেও প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে। আরও শুধুমাত্র একুট সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে পর্যটকদের পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখী করা যেতে পারে কেননা প্রকৃতি এই অঞ্চলের শুভা বর্ধনে কোন প্রকার কার্পণ্য করেন নি। তাছাড়া যদি পার্বর্ত্য চট্টগ্রামে কম খরচে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন সেবা সরবরাহ করা যায় তাহলে দেশী পর্যটকের বিচরণ আপনাআপনি অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। *লেখক- ব্যাংকার এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানারস (বিআইপি) এর একজন সদস্য।