নিজস্ব প্রতিবেদক : বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া চীনা করোনাভাইরাস বাংলাদেশেও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। যে কোন সময় এই ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর খবর আসতে পারেÑ এমন আশঙ্কা সারাদেশের মানুষের। করোভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে নানা প্রকার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
সর্বশেষ করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে চীনের নাগরিকদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা দেয়া সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। গতকাল রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রধানমন্ত্রীর ইতালি সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
তিনি জানান, চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো। তাদের অনেকে এখানে কাজ করেন। তাদের দূতকে বলেছি, অন-অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ রাখছি। একমাসের জন্য আসা বন্ধ। এটা সাময়িক। তারা মেনে নিয়েছেন। তবে ভিসা নিয়ে আসতে পারবেন, এজন্য হেলথ সার্টিফিকেট লাগবে।
এছাড়াও করোনাভাইরাস নিয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এর আওতাধীন চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রা ও বেনাপোলসহ সব স্থলবন্দরে নেওয়া হয়েছে দু’স্তরের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। থার্মাল ও কোয়ারেন্টাইন টেস্টের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এসব জায়গায়। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং এজেন্ট কর্তৃক জাহাজ বহির্নোঙরে আসার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে যথাযথ ঘোষণা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে গতকাল রোববার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বৈঠকে এসব তথ্য জানানো হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে একথা জানানো হয়।
এতে বলা হয়েছে, বন্দরে আসা জাহাজের মাস্টারকে পোর্ট লিমিটে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা দিতে হবে যে, ওই জাহাজে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত নাবিক নেই। এ ছাড়া পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে আসা জাহাজগুলোতে শতভাগ নাবিকের পোর্ট হেলথ কর্মকর্তা কর্তৃক স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে নিরাপদ ঘোষণা করলে তবেই বন্দরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হবে। এছাড়া জাহাজ থেকে হাসপাতালে দ্রুত রোগী স্থানান্তরে জন্য বন্দরে ‘অ্যাম্বুলেন্স শিপ’ রাখা হয়েছে। বন্দর ইমিগ্রেশন ডেস্কে পোর্ট হেলথ অফিসারের তত্ত্বাবধানে একটি মেডিক্যাল টিম সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। কোনও নাবিক বাইরে যেতে চাইলে মেডিক্যাল স্ক্রিনিংয়ে সুস্থতা সাপেক্ষেই শুধু অনুমতি দেওয়া হবে।
এছাড়া সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে মাস্ক ও অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সবাইকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দর এলাকায় কর্মরত চীনা নাগরিকদের নিজ দেশে যেতে এ মুহূর্তে ছুটি দেওয়া হচ্ছে না। যারা ছুটিতে গেছেন তাদেরকে এখন না আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বন্দরে জাহাজে কর্মরতদের এ সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে।
জানা গেছে, গত ২১ জানুয়ারি থেকে গতকাল রোববার সকাল ১০টা পর্যন্ত চীন থেকে মোট পাঁচ হাজার ৫৪৬ চীনা নাগরিক ও বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। সরকারি হিসেবে চায়না ইস্টার্ন, চায়না সাউদার্ন, ড্রাগন এয়ার ও ইউএস বাংলা-এ চার ফ্লাইটে আসা যাত্রীদের হিসাব করা হচ্ছে। বিমানবন্দরের থার্মাল স্ক্যানার ও হ্যান্ড স্ক্যানারে শুধুমাত্র এ চার ফ্লাইটের যাত্রীদের স্ক্যানিং ও নিবিড়ভাবে স্ক্যানিং করা হচ্ছে।
কিন্তু হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এ চারটি ফ্লাইট ছাড়াও আরও কমপক্ষে পাঁচটি ফ্লাইটে চীন থেকে যাত্রী পরিবহনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত শনিবার নেপালের হিমালিয়ান ফ্লাইটে চীনে অধ্যয়নরত কমপক্ষে ১৬ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী দেশে ফিরেন। তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে বিমানবন্দরে কর্মরত স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের থাইল্যান্ড হয়ে দেশে ফেরার কথা জানান। করোনাভাইরাসে আক্রান্তের কবল থেকে রক্ষা ও রোগটি যেন সংক্রমিত না হয় সেই উপলব্ধি থেকেই তারা বিকল্প পথে দেশে ফেরার কথা জানান।
শাহজালাল বিমানবন্দরে কর্মরত স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ডা. শাহরিয়ার সাজ্জাদ বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে বলেন, মোট ৯টি ফ্লাইটে চীন থেকে যাত্রী আসার তথ্য পাওয়া গেছে। করোনাভাইরাস বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ায় এখন সব ফ্লাইটের রোগীদের স্ক্যানিংয়ের আওতায় আনতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে গত শনিবার চীনের উহান প্রদেশ থেকে বিমান বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে দেশে ফিরেছেন ৩১২ বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে ৩০২ জনকে দক্ষিণখানের আশকোনা হজ কাম্পে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে। বাকি দশজনের মধ্যে সাতজনকে সরকারি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও তিনজনকে (তিনজনের মধ্যে একজন মহিলা জ্বরের রোগী, তার সঙ্গে তার স্বামী ও শিশু সন্তান ইচ্ছে করেই হাসপাতালে অবস্থান করছেন) সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আশকোনা হজ ক্যাম্পে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও আর্ম মেডিকেল কোরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও রোগতত্ত্ববিদরা সকলের সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, চীন থেকে ফেরা যাত্রীদের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি সব সময় রয়েছে। যারা চীন থেকে ফিরছেন তাদের সকলকে কোয়ারেন্টাইন করা হচ্ছে না। এছাড়া এ রোগটির উপসর্গ দুই সপ্তাহের মধ্যে যে কোনো সময় দেখা দিতে পারে। এ কারণে যার গায়ে জ্বর নেই তাকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তার উপসর্গ পরেও দেখা দিতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার আগাম সর্বোচ্চ সতকর্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এরপর যদি রোগী পাওয়া যায় তাদেরকে আইসোলেশন ইউনিটে রেখে চিকিৎসার প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, এখন সব এয়ারলাইন্সের যাত্রীদেরকেই পরীক্ষা নিরীক্ষারও আওতায় আনতে হবে।
গত ডিসেম্বরে চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত দেশটিতে ৩০৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। একজনের মৃত্যু হয়েছে ফিলিপাইনে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ভারতসহ ২৭টি দেশে এই ভাইরাসে ১৪ হাজার ৫৫১ জনের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ম
ানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের এ ভাইরাস ঠেকাতে চীন ভ্রমণে কড়াকড়ি আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বহু দেশ। ফিলিপাইনসহ অনেক দেশই এই ভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে চীন থেকে আগতদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ করে দেয়। সেই তালিকায় এবার যোগ হলো বাংলাদেশও। অনেক দেশের এয়ারলাইন্স চীনগামী ফ্লাইটও বন্ধ করে দিয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে চীন।