স্টাফ রিপোর্টার : চকবাজারের চুড়িহাট্টা ট্র্যাডেজির এক বছর পূর্ণ হয়েছে আজ। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দিনগত রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ঘটে যায় স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। রাস্তা জুড়ে পড়ে ছিল পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া মানুষের দেহের অংশবিশেষ, আটকে থাকা পোড়া গাড়ির কঙ্কাল। পোড়া ধ্বংসস্তূপ ঘেঁটে অঙ্গার হওয়া ৬৭ জনের লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা। চারজন মারা যান চিকিৎসাধীন অবস্থায়। তবে এক বছর পরও তিনটি লাশের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। যাদের অবহেলা আর লোভে আগুনের এত ভয়াবহতা, সেই ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখিও করা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে আজ নানা কর্মসূচিতে স্থানীয় বাসিন্দারা শোকের দিনটি পালন করছেন।
সেদিনের ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে অহেদ ম্যানশন ভবনে আগুন লাগে। প্রথম থেকে তৃতীয়তলা পর্যন্ত ছিল বিভিন্ন মার্কেট এবং গোডাউন। সেখানে কেমিক্যাল ছিল। ক্ষণে ক্ষণে সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটে। আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
ধোঁয়ার কুণ্ডুলিতে পুরো চকবাজার এলাকায় ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। ভবনটির আশপাশের ভবনের বাসিন্দারা সেখান থেকে নিরাপদ স্থানে যেতে ছোটাছুটি করতে থাকেন। ভবনের আগুন পড়ে ছড়িয়ে আশপাশের ভবনেও। এ সময় যারা ভবনের ভেতর এবং চুরিহাট্টার রাস্তায় কিংবা দোকান, হোটেলে ছিলেন তারা আগুনে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়।
স্থানীয়রাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, দমকল বাহিনীর ৩৭টি ইউনিটের নিরলস চেষ্টার পর রাত সাড়ে ৩টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। সকাল বেলা শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। রাস্তা বা দোকান. হোটেল বা ভবনের কক্ষ থেকে একে একে বের হয়ে আসতে থাকে পোড়া লাশ। বিভৎস পুড়ে চেনার উপায় নেই। অনেক মাংস পুড়ে কঙ্কাল হয়ে যায়। অনেকেই নিখোঁজ ছিলেন। যাদের খোঁজে স্বজনেরা ভিড় করছিলেন। তাদের আহাজারিতে চুড়িহাট্টার বাতাস ভারি হয়ে উঠে। এখনও সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতি অনেককে তাড়া করে।
সেই রাতে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে ২৭ জন নানা পেশার শ্রমিক ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন রিকশাচালক আনোয়ার হোসেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে চার শিশুসন্তানকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন তার স্ত্রী হাজেরা বেগম। ওই সময় চুড়িহাট্টার অদূরে ইসলামবাগে ভাড়া বাসায় থাকলেও বাসা ভাড়া কমাতে এখন কামরাঙ্গীরচরে বসবাস করেন তিনি। হাজেরা বেগম বলেন, শুরুর দিকে ধারদেনা করে চলেন। আর পেরে উঠছিলেন না। শেষ পর্যন্ত সংসার চালাতে খেলনা তৈরির একটি কারখানায় কাজ নিয়েছেন।
সেই রাতে আগুনে পুড়ে যান দুই ভাই মাসুদ রানা (৩৮) ও মাহবুবুর রহমান রাজু (৩৪)। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত যে ভবন থেকে, সেই ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলায় ‘এম আর টেলিকম সেন্টার’ নামের দোকান চালাতেন তারা। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির ঘোষকামতা গ্রামে তাদের বাড়ি। মৃত্যুর ২৬ দিন আগে বিয়ে করেছিলেন রাজু। তিন মাস আগে তার স্ত্রী এক ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। রানা-মাসুদের বৃদ্ধ বাবা বাসিন্দা সাহেব উল্লাহ মিয়া বলেন, অনেক কষ্ট করে তাদের এত বড় করেছি, আর এভাবে চলে গেল। কীভাবে কী করব বুঝতে পারছি না। রাজুর ছোট ছেলে আর তার স্ত্রীরই বা কি ভবিষ্যৎ?
তিনি বলেন, আমার এত কষ্ট ঘোচাবে কে? তারাতো আমার বড় ভরসা ছিল। তাদের ছোট এক ভাই রয়েছে, সে সবেমাত্র পড়াশুনা শেষ করেছে। কিন্তু এত বড় দুই ছেলে এভাবে চলে গেল, এর চেয়ে বড় আর কি কোনো কষ্ট আছে?