নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রথমবারের মত দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস আক্রান্ত তিন রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে জনমনে বিরাজমান করোনা-আতঙ্কের পারদ এখন উর্ধ্বমুখি। দেশবাসীর ‘আউটফিট আর্টিকেল’ এর তালিকায় সহসাই শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছে একদা অপ্রয়োজনীয় ফেসমাস্কÑ যা সংগ্রহের জন্য চলছে রীতিমত হুড়োহুড়ি।
একই সাথে বেড়েছে লিকুইড হ্যান্ড-ওযাশসহ পরিচ্ছন্ন থাকার অন্যান্য উপকরণাদি সংগ্রহের তাগিদ। গত রোববার কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয়েছে প্রথম শনাক্ত হওয়া তিন রোগী। জানা গেছে, রোগাক্রান্তদের সংস্পর্শে এসেছিলেনÑ এমন আরও চল্লিশ জনকে কোরেন্টাইনে নেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি ইতালি থেকে দেশে আসবার পর শনাক্তকৃত দুই রোগীর মধ্যে একজনের সংস্পর্শে আসায় আক্রান্ত হয়েছেন তৃতীয়জন। সর্বশেষ গতকাল বিকেলে বিদেশ ফেরত আরও ৩ জনকে হাসপাতালে র্ভতি করা হয়েছে।
এমন সংকটময় পরিস্থিতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে দেশবাসীকে জনসমাগম এড়িয়ে চলার নির্দেশনা এসেছে। ইতোমধ্যে বাতিল করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বহু প্রত্যাশিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। যেখানে আসার কথা ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
গতকাল সোমবার করোনাভাইরাস সংক্রামণ রোধে দেশবাসীকে বড় ধরনের গণজমায়েত এড়িয়ে চলার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বানের কথা জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম। করোনাভাইরাস নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভায় কোনো নির্দেশনা দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, জেনারেল যে ইনস্ট্রাকশন সেটা হলো অযথা গ্যাদারিং যেগুলো অ্যাভয়েড করতে হবে। যে কারণে রিসিডিউল করতে হচ্ছে অনেক প্রোগ্রাম।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক গ্যাদারিং হয় এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, রোববার শিক্ষামন্ত্রীও ছিলেন, ওনাকেও ইনস্ট্রাকশন দেওয়া হয়েছে যে কোনোভাবেই ম্যাস গ্যাদারিং না হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যাতে কোনোভাবে আর স্প্রেড করতে না পারে গর্ভমেন্ট সে দিকে খুব স্ট্রং নজর দিচ্ছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ করা হবে কিনা-প্রশ্নে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বলেন, না, সেই রকম পরিস্থিতি হয়নি। আমার আবেদন এরকমভাবে আতঙ্ক ছড়ানোর কোনো যুক্তি বা ভিত্তি নেই। প্রধানমন্ত্রী কী নির্দেশনা দিয়েছেন এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বলেন, নির্দেশনা- প্রটোকল অনুযায়ী ব্যবস্থা হয়েছে, কোয়ারেন্টানের ব্যবস্থা হয়েছে, চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে। শুধুমাত্র যে নির্দেশনা সেটা হচ্ছে- যতোটা সম্ভব আমরা বড় গ্যাদারিং এড়িয়ে চলবো, সেটা নির্দেশনা।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বলেন, করোনাভাইরাস যখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষত চীনে হয়েছে তথন থেকেই আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। আমরা গ্লোবাল সোসাইটিতে আছি। চীন বা অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের কারণে প্রথম থেকেই প্রস্তুতি আছে।
তিনি বলেন, সবসময়ই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকে, অ্যাড্রেস করে কী করতে করতে হবে সেসব বিষয়ে নির্দেনা নিয়ে থাকেন। চীন থেকে যখন ছাত্রদের নিয়ে আসা হলো তখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মতোই তাদের কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা হলো- এটা যেহেতু একটা ছোঁয়াছে রোগ এবং এটা এভাবে ছড়ায়, আমাদের যে কর্মকৌশল তিন পর্যায়ে। যাতে দেশে না আসে, যদি আসে তাহলে কীভাবে ট্রান্সমিশন কন্ট্রোল করবো যে একজন থেকে আরেকজনে না ছড়ায় সে ব্যবস্থা নিয়েছি এবং তৃতীয় পদক্ষেপ হলো যদি কিনা প্রাদুর্ভাব হয় সেটা কীভাবে ম্যানেজ করবো। সবসময়ই আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক ও তার গাইডেন্স অনুযায়ী করে থাকি। পাবলিক হেলথ পার্ট আমাদের দেশে খুবই স্ট্রংগার অন্যান্য বিষয়ের তুলনায়। উনি বলেছেন যে এখন আমাদের কী করতে হবে, আপনাদের কাছে যে অনুরোধটা আমাদের মাধ্যমে উনার- সেটা হলো যে আমরা যেন আতঙ্কিত না হই। কারণ এটা একটা ভাইরাস। আসাদুল ইসলাম বলেন, এটা নিয়ে আমাদের আকঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পৃথিবীতে এ ঘটনা ঘটেছে তারা ম্যানেজ করছে। আমরা মিডিয়া থেকে জানতে পারছি এত লোক আক্রান্ত হয়েছে, এত লোক মারা গেছে। কিন্তু যেটা কম শুনেছি সেটা হলো কত লোক সুস্থ হয়ে গেছে।
এদিকে, করোনাভাইরাসের বিস্তাররোধে প্রবাসীদের এই মুহূর্তে দেশে না আসার আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেছেন, বিদেশ থেকে যারা বাংলাদেশে আসছেন, আমি বলব, এই মুহূর্তে আপনারা দেশে আসবেন না। নিজ নিজ স্থানে থাকুন। গতকাল সোমবার বিকেলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কমিটির সভা শেষে মন্ত্রী এ আহ্বান জানান। তিনি এ কমিটির সভাপতি।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কমিটির সভা শেষে মন্ত্রী বলেন, বিদেশফেরত বিশেষ করে করোনাভাইরাসে বেশি আক্রান্ত ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো থেকে আসা বাংলাদেশিদের বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। তাদের পরীক্ষার মাধ্যমে প্রয়োজন হলে কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থাও নেয়া হবে।
বিদেশ ফেরত দু’জনের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে করোনা প্রতিরোধ করার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, বিদেশ থেকে যারা বাংলাদেশে আসছেন, আমি বলব, এই মুহূর্তে আপনারা দেশে আসবেন না। নিজ নিজ স্থানে থাকুন। এটা আগেও আমরা বলেছি। অ্যাম্বাসেডরদেরও (রাষ্ট্রদূত) আমরা নির্দেশনা দিয়েছি- তাদের জন্য সেফ জোনের ব্যবস্থা করতে। মন্ত্রী বলেন, দেশ থেকে তারা বেশি যাবেন, আমরা সেটাও চাই না। সবাইকে সেল্ফ-কোয়ারেন্টাইনে থাকার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। তিনি বলেন, জেলা পর্যায়ে খবর দেয়া হয়েছে, যারা আসবেন (বিদেশফেরত) সেল্ফ-কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন। তার যারা প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন- বিষয়টি আমাদের জানাবেন। আমরা তাদের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করে দেব।
জাহিদ মালেক বলেন, সচেতনতামূলক কার্যক্রম আমরা আগে থেকেই নিয়েছিলাম। এখন নতুন করে পোস্টার ও ব্যানার তৈরি করা হচ্ছে। আগামী দু’দিনের মধ্যে তা সারাদেশে পৌঁছে দেয়া হবে।
দেশে তিনজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত শনাক্ত হলেও আপাতত স্কুল স্বাভাবিকভাবে চলবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, সারাদেশের স্কুল ও কলেজগুলোতে হাত ধৌত করার জন্য সরকারিভাবে বিনামূল্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও সাবান প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। তবে পরিবর্তিত ব্যবস্থায় প্রয়োজন হলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে। খেলাধুলা, ধর্মীয় বা সামাজিক প্রোগ্রাম সীমিত আকারে করার অনুরোধ জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এগুলো না করলেই ভালো- এ বিষয়ে ডিসিদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ক্যাবল টিভিতে স্থানীয়ভাবে প্রচারণা চালানোরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, দর্শক সমাগম যেন না হয়, সে বিষয়ে আমরা বলেছি।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম হঠাৎ বৃদ্ধির প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, দাম বৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা আমরা নেব। দেশবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এতে মৃত্যুঝুঁকি ইবোলা ভাইরাসের চাইতে অনেক কম, ৩ শতাংশেরও কম। এটা হবে, আমরা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। আমরা যদি সকলে মিলে কাজ করি, প্রটেকটিভ মেজারগুলো মেনে চলি, পাবলিক গ্যাদারিং পরিহার করি- যেগুলো আমরা বলে আসছি, আশা করি করোনাভাইরাস আমরা প্রতিরোধ করতে পারব। এ ভাইরাস প্রতিরোধে হাত ধোয়াসহ প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থাগুলো সম্পর্কে জানতে হবে, জানাতে হবে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে তাদের পরিবারগুলোতেও সতর্কতামূলক বার্তা পৌঁছাতে হবে।
অন্যদিকে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেছেন, গত রোববার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত দেশে তিনজনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় আরও চারজনের নমুনা সংগ্রহ করেছি, তবে তাদের কারোর মধ্যেই করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। তার মানে এ পর্যন্ত সর্বমোট সর্বমোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা তিনজনই। গতকাল সোমবার রাজধানীর মহাখালিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের আইডিআরএ সম্মেলন কক্ষে নিয়মিত প্রেসব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। ব্রিফিংয়ে মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, গত রোববার যখন জানিয়েছি যে, বাংলাদেশে তিনজন রোগী শনাক্ত হয়েছে। তারপর থেকে হটলাইনে ৫০০ ফোনকল পেয়েছি। অনেকেই হটলাইনে ঢুকতেও পারছেন না, কারণ বিজি থাকছে। ৫০০ কলের মধ্যে ৪৭৯টি কলই হচ্ছে করোনা সংক্রান্ত। অনেকেই আমাদের বিভিন্ন তথ্য জানার জন্য কল করছেন।
তিনি বলেন, আইইডিসিআরে সরাসরি এসেছেন ১৮ জন। যারা বিদেশ থেকে আসছেন, আক্রান্ত দেশের সংখ্যা এখন অনেক। যারা আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আসছেন তারা অবশ্যই ১৪ দিন বাড়িতে অবস্থান করবেন। এ ১৪ দিন বাড়িতে অবস্থানের ক্ষেত্রে তাদের যারা প্রতিবেশী বা বন্ধু-বান্ধব তাদের সহযোগিতা চাইব। যদি বিদেশ থেকে এসে কেউ বাইরে বেরিয়ে আসে তবে তাদের মনে করিয়ে দেন যে, উনাকে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। অনেক সময় হয়তো ওঁদের খেয়াল থাকতে নাও পারে। কিন্তু ১৪ দিন তাদের কোয়ারেন্টাইনে থাকতেই হবে। মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, যারা দেশের বাইরে থেকে আসছেন তাদের সঙ্গে আশপাশের প্রতিবেশীরা বা বাড়ির মলিকরা শঙ্কিত হয়ে একটু ভিন্ন আচরণ করছেন। আমরা যদি তাদের সহযোগিতা না করি, তাদের যদি বাসা থেকে গিয়ে হোটেলে বা অন্য কোথাও থাকতে হয় তাহলে কিন্তু এটা আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে। আমরা ইতোমধ্যে বারবার বলেছি যে, বিদেশ থেকে আসলেই কিন্তু আক্রান্ত নন। যদি কেউ সংক্রমিত হয়েও থাকেন এবং বাইরে ঘোরেন তাহলে এটা ছড়িয়ে পড়বে। তাই তারা যেন বাড়িতেই থাকেন, সে সহযোগিতা করতে হবে।
বিদেশ ফেরত ৩ জন হাসপাতালে : দেশে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঘটার প্রেক্ষাপটে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে বিদেশ থেকে আসা তিনজনকে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এই তিন বাংলাদেশিদের মধ্যে দুজন এসেছেন ইতালি থেকে, অন্যজন এসেছেন সিঙ্গাপুর থেকে। বিমানবন্দর স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে জানা গেছে, এই তিনজন কাতার এয়ারওয়েজ, এমিরেটস ও সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে ঢাকায় আসেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসক শাহারিয়ার সাজ্জাদ বলেন, ইতালি থেকে আসা দুজনের শ্বাসকষ্ট ছিল। সিঙ্গাপুর থেকে আসা ব্যক্তির ছিল জ্বর তাদের (ইতালি ফেরত) শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়ার লক্ষণ ছিল। এটা যেহেতু করোনা আক্রান্তের একটা উপসর্গ, এ কারণে তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সিঙ্গাপুর থেকে আসা যাত্রীর শরীরে জ্বর থাকায় তাকেও হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
|