তানজিলা তিশা : ছোট্ট একটা জানালা দিয়ে তিথি ঝকঝকে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সেখানে টুকরো টুকরো মেঘেদের আনাগোনা। তার খুব ইচ্ছে করছে তুলোর মতো ভাসতে থাকা সাদা মেঘের টুকরোগুলো ছুঁয়ে দিতে। দূরেও কোথাও কুহু কুহু কণ্ঠে ডেকে কোকিল তার অস্তিত্বের জানান দিলো। বসন্ত এসে গেছে । গাছে গাছে দুলবে পলাশ আর শিমুলেরা। কেউ কেউ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিবে ," ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত "
বসন্তের এই স্নিগ্ধ রূপে সবাই বিমোহিত হয়। তিথিও এই বসন্তের রঙে মেতে থাকতো। কিন্তু আজ সে ছোট্ট একটা বেডে আটকে গেছে। জীবন তাকে এখানে নিয়ে আসবে, কোনোদিন সে স্বপ্নেও ভাবেনি। ফেলে আসা দিনগুলি তিথির মনে উঁকি দিয়ে যায়। যখন সে সবার সাথে মিলে বসন্ত বরণ করতো। বাসন্তী রঙের শাড়িতে নিজেকে সাজিয়ে নিয়ে আবিরের সাথে ঘুরে বেড়াতো সারাদিন। খোঁপায় পরতো হলদে ফুলের মালা। আবিরও তার সাথে ম্যাচ করে বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি পরতো। আবির যখন তাকে অনুরোধ করতো , বসন্তের ঐ গানটা গেয়ে শোনাও। তিথি বুঝতে পারতো আবির কোন গান শুনতে চাইতো। তাই সে গলা ছেড়ে গান ধরতো , আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে এত পাখি গায়....
সেইদিনগুলো আজ শুধুই স্মৃতি। একসময় তিথির খুব কান্না পেতো। এখন তাকে শুধু চাপা একটা কষ্ট সারাক্ষণ ঘিরে থাকে। বাইরের জগৎ বলতে তার কাছে বর্তমানে শুধু এই আকাশটাই । আর কিছুই সে দেখতে পায় না। তাই তিথি আকাশের দিয়ে তাকিয়ে ফেলে আসা দিনগুলোতে চলে যায়। সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠে শুয়ে বিশাল নীল আকাশে সাদা মেঘগুলো দেখেতে দেখতে সে আর আবির তাদের কত রঙিন স্বপ্ন বুনেছিল। সময় কখন চলে যেত তারা টেরই পেতোনা। মাঝে মাঝে আবির কবিতা আবৃত্তি করত। আমেরিকা চলে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো আবির জীবনান্দ দাশের " আবার আসিব ফিরে" কবিতাটি আবৃত্তি করেছিল । আবার আসিব ফিরে সেই ধান সিঁড়িটির তীরে_ এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়_ হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে ...
তিথি যখন আবিরের সাথে খুব রাগ করতো, তাকে হাসানোর জন্য আবির হাসির গল্প বলতো । তিথিও খুব বেশিক্ষন রাগ করে থাকতে পারতোনা। হিহি করে হেসে দিতো। এমনি একদিন তিথি রাগ করলে আবির তিথিকে হাসানোর জন্য একটা হাসির গল্প বলতে শুরু করল। গ্রামের এক অল্প শিক্ষিত লোক তার ছাত্রদের উদ্দেশে বললো , হুনো আইজ থেইকা আমি তোমাগো মাস্টার। আমি যেইভাবে পড়ামু তোমরাও সেইভাবে পড়বা নইলে কিন্তু এই বেতের মাইর খাবা। বুজতেছো? বিশাল একটা বেত দেখিয়ে তার ছাত্রদের বলল। এতো বড়ো বেত দেখে বাচ্চা দুটি গাড় কাত করে সম্মতি জানালো। মাস্টার ও খুশি মনে তার ছাত্রদের পড়ানো শুরু করলেন । ক বলে ক। মাস্টার মাথা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে বললেন, বাচ্চাদুটিও তাদের স্যারকে ফলো করে বলল , ক বলে ক। বাচ্চারা মাস্টারের মতো করে পড়ছে দেখে মাস্টার বললো , হুনো। তোমরা সুদু ক , খ পড়বা। আর কিছু কওয়ার দরকার নাই। বুজছো? বাচ্চারা ঘাড় কাত করে বললো যে তারা বুঝচ্ছে। মাস্টার সাহেব এবার নিশ্চিন্ত মনে দুলে দুলে পড়াতে শুরু করলেন। ক বলে খ। এবারও পুরো শরীর দুলিয়ে বললেন। বাচ্চারাও তাকে ফললো করে বললো , ক বলে খ। মাস্টার এবার সত্যি চিন্তায় পড়ে গেলেন। কিন্তু সে হাল ছাড়বেনা। অনেক কষ্টে এই স্টুডেন্টদের পেয়েছে। যে করে হোক তাকে পড়াতেই হবে। তাই সে তার মত করে পড়িয়ে যাচ্ছে। ক বলে গ। ক বলে ঘো। এখন মুশকিল হলো মাস্টার আর ছাত্রদের এমন অদ্ভুত পড়া শুনে সবাই তাদেরকে উঁকি দিয়ে দেখছে। মানুষজন দেখে মাস্টারের ঘাম ছুটতে লাগলো। তার পেটের মধ্যেও হঠাৎ হঠাৎ মোচড়ে উঠছে। একজনকে সে জিজ্ঞেস করলো, বাতরুম কোনদিকে কইতে ফারবেন ? লোকটা আঙ্গুল দিয়ে যেদিকে দেখলে , মাস্টার উঠে সে দিকে দোড়ে গেলো । ছাত্ররা কি করবে বুঝতে না পেরে তারাও মাস্টারের পিছন পিছন দোড়াতে শুরু করল।নইলে স্যার যদি তাদেরকে বেত মারে ।
তিথি হেসে দিলো। তোমাকে বলসিলাম না এমন হাসির গল্প বলবেনা। আমার পেট ফেটে হাসি পায়। কি করবো। তোমার এমন গোমড়া মুখ দেখতে ভালো লাগেনা। ঠিক আছে আর রাগ করবোনা। সত্যিতো ? তিথি মাথা নেড়ে বললো, তিন সত্যি।
কিন্তু তিথি আবারো রাগ করে। আবির আবারো তার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করে। এবার কিছুতেই তিথির রাগ যায়না। তখন পাশে দুজন টোকাই দেখে আবির অদ্ভুত একটা কান্ড করলো । এই শুন শুন। আবির তাদেরকে ডাকলো । কৌতূহল নিয়ে টোকাই দুজন ধীর পায়ে সামনে এলে আবির বললো , একটা গল্প শুনবে ? হাসির গল্প। তারপর চিন্তা করে বললো । না থাক। হাসির গল্পগুলো আজকাল পানসে হয়ে গেসে। শুনে কেউ হাসেনা। আবির তিথির দিকে তাকালো। কিন্তু তিথি এখনো মুখ কালো করে বসে আছে । সিরিয়াস গল্প বলবো। শুনবে? গল্প শুনলে দশ টাকা পাবে । একথা শুনে ওদের চোখ কপালে উঠে যায়।কিছু বুঝতে না পেরে ওরা একটু হা হয়ে যায়। একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে । আবির আবারো তাদের বলল , বসে পড়ো। গল্প শুনলে দশ টাকা দেব। গল্পের নাম হল জুলিস সিজার। আগে কখনো শুনেছ ? মাথা নেড়ে তারা না বললো । না শুনলে সমস্যা নেই। এখন শুনবে। আবির একরকম জোর করে তাদেরকে গল্প শোনার জন্য রাস্তার পাশে বসালো। টাকা পাওয়ার জন্য টোকাইগুলোও আপত্তি করলনা। আবির গল্প শুরু করল। আজ থেকে প্রায় দু হাজার বছর আগের কথা। রোম নগরীতে এক জনপ্রিয় বীর সম্রাট ছিলেন। তার নাম ছিল জুলিয়াস সিজার। আবির গল্প শেষ করলো ব্রুটাসকে বলা জুলিস সিজারের সেই উক্তি দিয়ে , "এইতু ব্রূতে" মানে "ব্রূটাস তুমিও" । হয়তো কোনো স্টেজে এই গল্প দেখলে দর্শক কেঁদে ভাসাতো। কিন্তু টোকাইগুলো শুকনো মুখে আবিরের গল্প শুনলো। রোমের এত বড়ো বীর জুলিয়াস সিজারকে তার আপন বন্ধুসহ সবাই মিলে চাকু দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করলো, সে নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো অনুভুতি আসলোনা। চোখ জলে ছলচলও করছেনা। তারা বরং টাকা পেলেই খুশি। আবির তার শ্রোতাদের নিয়ে হতাশ। সে এতো সুন্দর করে একটা গল্প বললো। অথচ এরা রোবটের মতো বসে আছে। আবিরের অবস্থা বুঝতে পেরে তিথি খিলখিল করে হেসে দিলো। একটা হাসিতে কি করে এতো মায়া থাকতে পারে আবির ভেবে পায়না।
তিথির চাঁদের আলো খুব ভালো লাগে। পূর্ণিমার চাঁদ দেখে দেখে কত রাত তারা ফোনে গল্প করে কাটিয়ে দিতো। আজ সবকিছু যেন ধুলোয় ঢাকা পড়ে গেছে। একদিন পূর্ণিমার রাতে তিথি আবিরকে বললো, আমার ইচ্ছে করছে সারা রাত চাঁদের আলোতে হেঁটে বেড়াতে। তখনি আবির তিথির সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই তিথিদের বাসার সামনে চলে আসে। কিন্তু তিথিকে একটুও বুঝতে দেয়নি। তিথিদের বাসার পাশে এসে আবির তিথিকে বলে, একটু বারান্দায় এসে দেখতো। কেন? তিথি খুব অবাক হয় । আরে আসোনা। আসলেই দেখতে পাবে। তিথি বারান্দায় এসে দেখে আবির তাদের বাসার গেটের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। দারোয়ান তাকে দেখতে পাচ্ছেনা । চলো, চাঁদ দেখতে যাবো । পাগল তুমি? আবির মাথা নাড়ে। সত্যি বলতে কি আবিরের এমন পাগলামি তিথির খুবই ভালো লাগতো। এই ছিল আবির যে আবিরকে তিথি হাজারবার চাইবে।
স্কলারশিপ পেয়ে আবির আমেরিকা চলে যায়। তখন তিথি ভীষণ একা হয়ে পড়ে। সবাই বলে চোখের আড়াল নাকি মনেরও আড়াল। কিন্তু আবির আর তিথির মধ্যে তেমন কিছুই হয়নি। বরং সম্পর্ক খুব ভালোই ছিল। দূরত্ব তাদের সম্পর্কের ফাটল ধরাতে পারেনি। আবির চলে যাওয়ার পর আবিরের সাথে কাটানো জায়গাগুলোতে তিথি মাঝে মাঝে এসে একা বসে থাকে। সেখানে ছবি তুলে সেগুলো নিজের ফটো এলবামে রাখে। এমন একা একা ঘুরে ফেরার ছবি দেখে হয়তো আবিরের মন খারাপ হবে তাই সে ফেসবুকেও ছবিগুলো আপলোড দেয়না। নিজের ডায়রিতে ছবিগুলো আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখে। সেখানে সে তারিখ এবং তার সাথে ছোট্ট একটা কমেন্টস যুক্ত করে। বসন্তের দিনগুলোতে সবাই কেমন আনন্দে মেতে থাকে। কিন্তু সারাক্ষণ একা একা তিথির খুব মন খারাপ হয়। পড়ন্ত বিকেলে পাখিগুলোকে উড়তে দেখে তারও ইচ্ছে করে পাখির মতো উড়ে আবিরের কাছে চলে যেতে। আবিরের জন্য তার অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। যেন কখনোই ফুরাবার নয়। এর মধ্যে তিথির লিউকোমিয়া ধরা পড়লো। প্রথম দিকে তার পরিবার ছাড়া আর কেউ জানতোনা। তিথি তাদেরকে নিষেধ করে যেন কেউকে না বলে। কারণ আবির শুনতে পেলে দেশে চলে আসবে। তিথি তার মাকে অনুরোধ করে বলে বলে , মা আমিতো চলেই যাবো। তাহলে শুধু শুধু কেন আবিরের লাইফটা নষ্ট করবো ? তাই বলছি প্লিজ, কাউকে কিছু বলোনা। এরপর থেকে আবিরের সাথে কথা বলতে গেলে তিথির খুব কান্না পেতো। বুঝতে পেরে আবির বলতো এতো মন খারাপ করছো কেন। কিন্তু তিথি এড়িয়ে যেত। বলতো , আমার ঠান্ডা লেগেছে , তাই তোমার এমন মনে হচ্ছে। তুমিতো জানো বেশি ঠান্ডা লাগলে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ে।
কিছুদিন পর তিথি লক্ষ্য করলো হঠাৎ তাদের সম্পর্কের মধ্যে একটা ছন্দ পতন হতে শুরু করলো। এই আবিরের সাথে আগের আবিরের সাথে সে সূক্ষ্ণ পার্থক্য খুঁজে পায়। কারণ তিথি কথা বলতে চাইলে আবির নানা অজুহাত দেখতে থাকে। নিজ থেকেও আবির আর তিথিকে কল দেয়না। সামান্য কিছুর জন্য তিথির সাথে চেচাঁমেচি করে । আবির কয়দিন যাবত জ্বরে ভুগতে থাকলে তিথি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। একটু সাবধানে থাকতে পারোনা। কিভাবে এতো ঠান্ডা লাগাও। জনোইতো তোমার ঠান্ডা সহ্য হয়না। কিন্তু আবির খুব রেগে যায়। এতো আদিখ্যেতা দেখাইও নাতো। তোমার এসব দেখতে আর ভালো লাগেনা। যাও এখন। তিথি স্তব্ধ হয়ে যায়। বুঝতে পারেনা কী বলবে। তিথি আবিরকে যতটুকু চেনে , আবির তার সাথে কখনোই এমন করার কথানা। আবিরের মধ্যে একটা সারল্য ছিল। কোনো হিপোক্রিসি সে কোনোদিন দেখতে পায়নি। এমন চেঁচামেচিও কখনোই করেনি। তাহলে কি আবিরকে চিনতে তার অনেক বড় ভুল হয়ে গেলো !
কিছুদিন পর তিথি আবিরকে কল দিলে ওয়েটিং দেখায়। তিথি আবিরের ফোনের জন্য বসে থাকে। কিন্তু ফোন আর আসেনা। অনলাইনে এসেও আবির তিথির টেক্সটের রিপ্লায় দেয়না । তিথি বুঝতে পারে তার প্রতি আবিরের আগ্রহ কমে গেছে। কিন্তু কিছুতেই সে মানতে পারেনা। তিথি অঝোরে কাঁদতে থাকে। সে ভেবে পায়না আবির কি করে এত পাল্টে গেলো ! কয়েকদিন পর তিথি আবার আবিরকে কল দেয়। সে ভাবে আবির হয়তো কোনো কারণে রাগ করেছিল। তাই সেদিন এমন বিহেভ করেছিল । আজ নিশ্চয় আর তেমন করবেনা। কিন্তু আবির আবারো তিথির সাথে চেঁচামেচি করতে থাকে। তোমার প্রব্লেম কি বলতো। তুমি কি বুঝতে পারনা আমি আর তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিনা। এসব তুমি কি বলছো ? কি হয়েছে বলবেতো। দেখো তোমার সাথে আমি আর কোনো সম্পর্ক রাখবোনা। তুমি তোমার পথ দেখো । তিথির পুরো পৃথিবীটা যেন দুলে উঠে। আবিরের এমন কথা শুনে তিথির খুব রাগ হলো , তুমি বললে আর হয়ে গেলো ? এসবের মানে কী! আমার দোষটা কী বলো। তাদের মধ্যে খুব কথা কাটাকাটি হয়। যেটা আগে কোনোদিন হয়নি। আবির তিথিকে সবগুলো সোশ্যাল সাইট ব্লক করে দেয়। এমনকি ফোনেও। তিথির পরিচিত সবাইকেও সে ব্লক করে দেয় । একদিন তিথি আবিরকে জিজ্ঞেস করেছিল, বলতো ভালোবাসার শেষ কোথায় ? আবির বললো , মেডাম, ভালোবাসার শুরু আছে , কিন্তু শেষ নেই। যে ভালোবাসার শেষ হয় সেটা ভালোবাসা হতে পারেনা । আজ কী তাহলে আবির সেই কথাটি ভুলে গেছে ! তিথির ইচ্ছে করে আবিরকে জিজ্ঞেস করতে।
সবাই তিথিকে দেখতে আসে। কিন্তু যার সবার আগে তাকে দেখতে আসার কথা , সেই আবিরের দেখা নেই। আবির কোথায় যেন হারিয়ে গেলো ! বুকের ভিতর কষ্টগুলো জমাট বাঁধতে থাকে। মা-বাবা বন্ধু সবাইকে ছেড়ে যেতে তার খারাপ লাগছে ।আবার এই ভেবে ভালো লাগছে যে সে সবার ভালোবাসা নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারছে। কিন্তু আবির তার সাথে যা করেছে সেটা সে মেনে নিতে পারছেনা। মানুষ যখন কাউকে বেশি ভালোবাসে, সেই প্রিয় মানুষটির দেয়া কষ্টের ওজন অনেক বেশি হয়। বুকের উপর যেন বিশাল একটা পাথর ভর করে। ক্রমে নিঃশ্বাসও বন্ধ হয়ে আসে । মা-বাবার কান্নাকাটি দেখে তিথির মন আরো ভেঙে যায়। তিথি মাকে কাঁদতে দেখে বলে, আমি যতদিন বেঁচে আছি , ততদিন আমাকে ভালো করে বাঁচতে দাও মা। এতো কান্নাকাটি করছো কেন ? আমিতো এখনই মরে যাচ্ছিনা।
তিথীরা দু ভাই-বোন। সবসময় তাদের দু ভাই-বোনের মধ্যে খোঁটাখুঁটি লেগেই থাকতো। কিন্তু নাবিল এখন বোনের হাত ধরে বসে থাকে। বলে, আমি আর কখনোই তোর সাথে ঝগড়া করবোনা। তোর যতক্ষণ ইচ্ছে টিভি দেখিস , আমি দেখবোনা। সবচেয়ে বড়ো বারান্দার রুমটা নিস ।মুরগির লেগপিসটা তোর জন্যই থাকবে। আমার পাখিগুলো ও তোকে দিয়ে দিবো। মা প্রিতিদিন তোর জন্য পায়েস রান্না করবে। সবটুকু তুই খাবি। আমি এসব কিচ্ছু চাইনা। নাবিল কান্না চেপে রাখতে পারেনা। দোড়ে বারান্দায় গিয়ে কাঁদতে থাকে। এদিকে বন্ধুরাও সারাক্ষণ তাকে ঘিরে থাকে। এমনকি তার বার্থডেতে উইশ করলো। মরণের আগে কাছের মানুষদের ভালোবাসাটা পাওয়া একটা ভাগ্যে। সবাই তা পায়না। তিথির চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে আমি বাঁচতে চাই । অবশেষে বসন্তের এক বিকেলে, আপন সবাইকে কাঁদিয়ে তিথি না ফেরার দেশে চলে যায়।
তিথি মারা যাওয়ার কিছুদিন পর আবির দেশে আসে। একদিন তিথির এক বন্ধুর সাথে আবিরের দেখা হয়ে যায়। তার কাছে আবির জানতে পারে তিথি লিকুমিয়ায় মারা গেছে। সঙ্গে সঙ্গে তিথির জন্য মনের কোন লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা তাকে নাড়া দিতে থাকে। সে তার কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। অভিমানের বিশাল পাহাড় একমুহূর্তেই ধসে পড়লো। ফেসবুকে এসে তিথির স্ট্যাটাসগুলো পড়তে থাকে। একটা স্ট্যাটাসে তার চোখ আটকে যায় । সবাই জানে সে একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু কবে, তা কেউ জানেনা। যে মানুষটা জানে সে আর কিছুদিনের মধ্যেই চলে যাবে , সে আর অন্য মানুষগুলোর মধ্যে ঠিক এখানেই পার্থক্য হয়। পৃথিবীর রূপটা তার কাছে অন্যরকমভাবে দেখা দেয়। সবকিছুতে যেন মায়া ছড়িয়ে থাকে। সবচেয়ে কষ্ট লাগে যখন চারপাশের মানুষগুলো করুনার দৃষ্টিতে তাকায়। আর সবচেয়ে ভালো লাগে যখন প্রিয় মানুষটা খুব সুখী হবে বলে অন্য কারো হাত ধরে। সুখী হোক এই কামনা করি । আবির প্রচন্ড একটা ধাক্কা খায়। চোখ পানিতে টলমল করে উঠে। আরেকটা স্ট্যাটাস ছিল, শেষবারের জন্য খুব দেখতে ইচ্ছে করছে !!! আবিরের এখন ইচ্ছে করছে একবারের জন্য তিথিকে সরি বলতে। মরে গিয়ে যেন তিথি যেন তার কাছে অনেক বেশি জীবন্ত হয়ে গেছে । থাকতে না পেরে তিথির কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় । তিথুলি আমায় ক্ষমা কর প্লিজ। আবির তিথিকে তিথুলি ডাকতো । আবির নাবিলের সাথে দেখা করে। নাবিল তার কাছে থাকা তিথির ডায়রিটি আবিরকে দেয়। নাবিল আবিরকে বলে , তিথি চলে যাওয়ার আগে আমাকে বলেছিলো আবির আমার খোঁজ নিতে এলে তাকে এই ডায়রিটা দিস। আর বলিস আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম । কথাটা তীরের মতো গিয়ে আবিরের বুকে গিয়ে বিঁধলো। তিথি কি করে বুঝতে পারলো আবির তার খোঁজ নিতে আসবে ! তিথির ডায়রিটা পরে আবির তার সব ভুল বুঝতে পারলো। তিথি তাকে এতটা ভালোবাসতো। অথচ তার বিনিময়ে আবির তিথির উপর অনেক বেশি অবিচার করে ফেলেছে। এই অসুস্থতা নিয়েও তিথি প্রচন্ড মানুসিক কষ্ট নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। অথচ হাসি-আনন্দ নিয়ে তার শেষ সময়টুকু কাটানোর কথা ছিল ।
এতটাই অপরাধবোধ করছে যে কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেনা। যদিও রিংকি দিনরাত তিথির নাম আবিরের কান ভারী করত, তবুও আবিরের মনে হচ্ছে তিথির মৃত্যুর জন্য সে দায়ী । তিথি আর রিংকি বন্ধু ছিল। কিন্তু রংকি আবিরকে পছন্দ করতো। তাই আবিরের সাথে তিথির সম্পর্কটা রিংকি কোনোদিনই মেনে নিতে পারেনি । ব্যপারটা তিথি কখনোই বুঝতে পারেনি। আবিরও এটা ভাবতে পারেনি। কারণ রিংকি তাদের সাথে খুব মিল দিয়ে চলতো যেন সে তাদের খুব ভালো বন্ধু। তিথি আর আবিরের মঙ্গল হোক এটাই যেন তার কাম্য। কিন্তু রিংকি সুযোগ বুঝে আবিরকে বলতো , যা করবে ভেবে চিনতে করবে। কারণ, এটা সারা জীবনের জন্য। এমন কথার মানে কী ? খুলে বলবে ? আবির জানতে চায় । না,কী আর বলবো। তোমার ভালো হোক তাই চাই । শত হলেও নিজের বান্ধবী। কিছু বলা আমার ঠিক হবেনা। কিন্তু সত্যি বলতে কি তোমার কথা ভেবে আমার খারাপ লাগছে । আবির রিংকিকে সব খুলে বলতে বলে। কিন্তু রংকি এমন ভাব দেখায় যেন সে কিছু বলতে চাইছে না। আবির তাকে রিকোয়েস্ট করতে থাকে। প্লিজ, কিছু জানলে বলো। আমি কাউকে বলবোনা । তিথির রূপমের সাথেও সম্পর্ক আছে বলে রিংকি আবিরের মনে সন্দেহ ঢুকাতে থাকে ।
আবির চলে যাওয়ার পর তিথি একা হয় যায়। তাই মন খারাপ হলে সময় কাটাতে তিথি বন্ধুদর সাথে আড্ডা দিতো। কিন্তু রূপমের সাথে একটু বেশি আড্ডা দেয়া হতো। কারণ তিথি আড্ডা দিতে চাইলে সবাই ব্যস্ত থাকলেও রূপমই আসতো। মাঝে মাঝে রিংকিও থাকতো। রূপমের সাথে তিথির সম্পর্ক আছে প্রমান করার জন্য গোপনে রিংকি তাদের আড্ডা দেয়ার ছবি তুলে আবিরকে পাঠাতো । সন্দেহের তীর এতটাই বিষাক্ত যে , একবার বিঁধলে তা সম্পর্কটাকে মেরেই ফেলে। তিথি আর আবিরের তাই হলো। শোনা আবির , তুমি এমন মেয়েকে নিয়ে কখনোই হ্যাপি হতে পারবেনা।ভালোর জন্যই বলছি কিন্তু। ভেবে দেখো। রংকি আবিরের মন বিষিয়ে দেয়। সব শুনে, ছবিগুলো দেখে আবিরের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। তখনি তিথিকে তার খুন করতে ইচ্ছে করছিলো।
কিছু ভুল মানুষের থাকেই। তিথির সে ভুলগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে রিংকি আবিরের কানে দিতে থাকে। ধীরে ধীরে তিথির উপর থেকে আবিরের মন একেবারেই উঠে যায়। তিথির উপর প্রতিশোধ নিতে আবির অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক করে। এদিকে তিথি থাকতে না পেরে অন্য আইডি থেকে আবিরের ফেসবুকে যায়। তার টাইমলাইনে একটা মেয়ের সাথে ক্লোজ ছবি দেখতে পায় তার সাথে সম্পর্ক আছে বলেও আবির উল্লেখ করে। তিথির আর কিছু বুঝতে বাকি নেই। পৃথিবীর এমন নিষ্ঠুর চিত্র দেখতে সে মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা।
যে কষ্ট নিয়ে তিথি পৃথিবী ছেড়ে গেছে, তার দ্বিগুন কষ্ট নিয়ে আবির এখন দিন কাটাচ্ছে। দিনশেষে শুধু তিথির একটা কথা বার বার আবিরের কানে বাজতে থাকে ,
আমি মরে যাওয়ার পরও আকাশের তারা হয়ে তোমার গল্প শুনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবো। তখনো কি আমাকে এমন করে গল্প শোনাবে ? বল। আবির আকাশের দিকে তাকায়। এতগুলো তারার ভিড়ে কোনটা যে তিথি বুঝতে পারেনা। তিথি কি সত্যি তার জন্য অপেক্ষা করছে। নাকি এখনো অভিমান করে আছে। আবিরের বড় জানতে ইচ্ছে করে।
তিথির সাথে কাটানো সেই ঘাসে ঢাকা মাঠে, গাছের ছায়ায়, রেস্টুরেন্টে, পথগুলোতে আবির তিথিকে খুঁজে ফিরে। কিন্তু মেলেনা তার দেখা। কারণ সময় আর মানুষ একবার হারিয়ে গেলে আর কখনোই ফেরেনা।
|