স্বাধীন বাংলা রিপোর্ট : ঘণ্টায় ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন আম্পান। গতকাল বুধবার বিকাল ৪টা থেকে এটি সাগর উপকূলের পূর্ব দিকে সুন্দরবন ঘেঁষা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ দিয়ে অতিক্রম করে। চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তাণ্ডব চালিয়ে রাত ৮টার দিকে ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে আম্পান সাতক্ষীরা, খুলনা অঞ্চল অতিক্রম করে। আরেক দফায় সুন্দরবন বুক পেতে দিয়ে অনেকাংশে ঠেকিয়ে দেয় আম্পানের তাণ্ডব। এর আগেও সিডর-বুলবুলের আঘাত আসে সুন্দরবনে। এই সুন্দরবনই বাঁচিয়ে দেয় হাজার হাজার মানুষের প্রাণ। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আম্পানের তাণ্ডবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটসহ উপকূলীয় এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি, ভেঙে পড়েছে গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে আম্পান স্থল নিম্নচাপে পরিণত হলেও উপকূলজুড়ে রেখে গেছে তার ক্ষতচিহ্ন।
আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :-
খুলনা : আম্পানের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে খুলনার উপকূলীয় এলাকা। বিধ্বস্ত হয়েছে বিপুল সংখ্যক ঘরবাড়ি। বিশেষ করে কয়রা ও বটিয়াঘাটায় বাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা বিলীন হয়ে গেছে। ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের পানি বেড়ে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে বিভিন্ন এলাকার মাছের ঘের ও ফসলি জমি। এছাড়া হাজার হাজার গাছ উপড়ে পড়েছে। সড়কে গাছ পড়ে থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে।
অপরদিকে, খুলনার ৮১৪টি সাইক্লোন সেন্টারে আশ্রয় নেয়া ২ লাখ ৭ হাজার মানুষ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে নিজ নিজ আবাসে ফিরতে শুরু করেছেন।
খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজিজুল হক জোয়ার্দ্দার জানান, খুলনায় ২ লাখ ৭ হাজার মানুষ ৮১৪টি সাইক্লোন সেন্টারে আশ্রয় নেন। ঘূর্ণিঝড়ে এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। অনেক ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ভেঙেছে বেড়িবাঁধ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তথ্য পাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ জানা যাবে।
আম্পানের তাণ্ডবে বুধবার সন্ধ্যা থেকে খুলনায় বিদ্যুৎ বিছিন্ন রয়েছে প্রায় সব এলাকায়। নগরীর বিভিন্নস্থানে তার ছিড়ে ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তবে, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ আসতে শুরু করে।
বাতাস ও পানির তোড়ে খুলনার কয়রা উপজেলার ১১টি জায়গায় বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এতে কয়রা সদর, উত্তর বেদকাশি, দক্ষিণ বেদকাশি, মহারাজপুর ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। প্রচুর পরিমাণে গাছ পালা, কাঁচা ঘর-বাড়ি, রাস্তা ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি এলাকার মো. আবু সাঈদ খান জানান, কয়রায় ৮টি পয়েন্ট দিয়ে বাঁধ ভেঙে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। পয়েন্টগুলো হচ্ছে- দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা এলাকার নিরাঞ্জন ও মাজিদ গাজীর বাড়ি সামনে, ছোট আংটিহারা এলাকার বাকের গাজীর বাড়ির সামনে, গোলখালী গ্রামের তসলিম মোল্লার বাড়ির সামনে, চরামুখা খেয়াঘাট এলাকা, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাজী পাড়া ও কাশির হাট খোলা এবং কয়রা সদর ইউনিয়নের হরিণখোলা এলাকা। এতে অনেকের বসত বাড়িতে পানি উঠেছে। কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা সøুইচ গেটের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে।
আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফেরা কয়রার রিয়াসাত আলী সানা, আব্দুল জলিল মোড়ল, আব্দুল হামিদ সরদার ও শারমিন বেগম জানালেন, ঝড়ে তাদের ঘর-বাড়ি ও গাছ-পালার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে, গরু-ছাগলের কোন ক্ষতি হয়নি।
বাগেরহাট : সুপার সাইক্লোন আম্পানের তা-বে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। জেলায় থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ, ঘরবাড়ি ও মৎস্য ঘেরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে জেলার কোথাও হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। মাঠে থাকা পাকা ধান ও সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলা প্রশাসন বলছে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কর্মকর্তারা কাজ শুরু করেছেন।
বুধবার রাতে পাউবো বাগেরহাটের ৩৫/১ পোল্ডারের শরণখোলা উপজেলার বগী-গাবতলা অংশের ২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বিভিন্ন স্থান ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে বাঁধের আশপাশের কয়েকটি গ্রামের নিম্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ফলে পানিতে ভেসে গেছে সহস্রাধিক মৎস্য ঘের। এছাড়া বাঁধের আশপাশের বেশকিছু কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। উপড়ে পড়েছে বেশ কিছু গাছপালা।
এদিকে ভাঙা বাঁধ দিয়ে পুনরায় জোয়ারের পানি ঢুকে আবারও লোকালয় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ বাঁধ সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
জেলার রামপাল উপজেলার ননী গোপাল বলেন, রাতে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে আমার বসতঘর ভেঙে পড়েছে। ঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে মাছের ঘের। উপজেলায় আমার মতো অনেকের ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়াসহ ভেসে গেছে মৎস্য ঘের। এতে উপজেলার মাছ চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
বাগেরহাট জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মামুনুর রশীদ বলেন, আম্পানে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা নিরূপণ করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঝিনাইদহ : ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন গ্রাম। গ্রামের পর গ্রাম আম বাগান, মেহগনি বাগান উপড়ে গেছে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে কলা বাগানের। এর আগে ঝড়ের এমন তা-ব দেখেনি ঝিনাইদহের মানুষ।
মহেশপুর থানার ফতেপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ৬৫ বছরের ছাহেরা বেগম বলেন, জীবনে অনেক ঝড় দেখেছি। এমন ঝড় আগে কখনও দেখিনি। মানুষের আম গাছ, মেহগনি গাছ উপড়ে গেছে অথবা ভেঙে গেছে। মানুষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ অঞ্চলে আগে কখনও এভাবে ঝড়ে গাছপালা উপড়ে পড়েনি।
একই ইউনিয়নের হারুন আবু নামের ৩০ বছরের এক যুবক বলেন, মাঠের পর মাঠ কলা বাগান শেষ। আম বাগান, কাঁঠাল বাগান, মেহগনি বাগান-সব উপড়ে অথবা ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ঝড়ের এমন তাণ্ডব আমাদের অঞ্চলের মানুষ এর আগে কখনও দেখেনি। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে গেছে, তার ছিঁড়ে পড়ে আছে।
তিনি বলেন, ঝিনাইদহ জেলা উঁচু অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এ অঞ্চলে সাধারণত বন্যা দেখা যায় না। বড় ধরনের ঝড় দেখা যায় না। কিন্তু আম্ফান বুধবার সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাণ্ডব চালিয়েছে। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
সাতক্ষীরা : ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চল। ইতোমধ্যে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। উপকূলীয় এলাকার বাঁধগুলোর অর্ধশত পয়েন্ট ভেঙে গেছে। জনপদে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করছে। এছাড়াও ঝড়ের কবলে পড়ে সাতক্ষীরা শহরের কামালনগর এলাকায় এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে কাঁচা ঘরবাড়ি, উপড়ে পড়েছে গাছপালা।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর আলিফ রেজা জানান, আশাশুনি উপজেলার উপকূলীয় প্রতানগর. ক্রীউলা. আনুলিয়া ও খাজরা ইউনিয়নের অইশে পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে গেছে। ইতোমধ্যে চাকলা, দিঘলারাইট, কুড়িকাউনিয়া, হিজলা, কোলা, শ্রীউলা, হাজরাকালি, দয়ারগাট, বিছট, বাহাদুরপুর গ্রামসহ আরও অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনই বলা সম্ভব নয়।
আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিল জানান, ইউনিয়নের একটিও টিনের ছাউনি ও কাঁচাঘরবাড়ির অস্তিত্ব নেই। সবগুলো ঝড়ে ধসে পড়েছে। টিনের ছাউনি উড়ে গেছে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আ.ন.ম আবুজর গিফারী বলেন, বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা, পদ্মপুকুর ও রমজাননগর ইউনিয়নের উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে।
বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডল বলেন, ইতোমধ্যে তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামই প্লাবিত হয়ে যাবে। বাঁধ ভেঙে জনপদে পানি প্রবেশ করছে।
কালিগঞ্জ উপজেলার ভাড়াশিমলা এলাকার খারহাটে ইছামতি নদীর বাঁধ এবং মথুরেশপুর চিংড়া বাঁধ ভেঙে অনেক কাঁচা ঘর, গাছপালা ভেঙে গেছে। প্লাবিত হয়েছে তিনটি গ্রাম।
পটুয়াখালী : আম্পানের তাণ্ডবে উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীতে দুইজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে একজন শিশু আছে। এছাড়া ঝড়ে জেলার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় কলাপাড়ায় মানুষকে সচেতন করতে গিয়ে ধানখালীর ছৈলাবুনিয়া এলাকায় খালে নৌকাডুবে শাহ আলম নামে এক স্বেচ্ছাসেবীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি এলাকায় ঝড়ো হাওয়ায় গাছের ডাল ভেঙে পড়ে রাশেদ (৬) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সন্ধ্যায় বাবার সঙ্গে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার সময় গাছের ডাল ভেঙে নিহত হয় সে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তা-বে পটুয়াখালীতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভেঙে পড়েছে বহু গাছ। বিচ্ছিন্ন হয়েছে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। কলাপাড়ার ও রাঙ্গাবালীর উপজেলার ১৭টি চরের ২০টি গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
আম্পানে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটাসহ গোটা উপকূলীয় এলাকায় প্রচণ্ড বেগে ঝড়ো বাতাসের সাথে বৃষ্টি হয়। সন্ধ্যার পর থেকে সমুদ্রে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে। ঝড়ে গলাচিপার পানপট্টি বাজারের ১০/১২টি দোকান উপড়ে পড়ে। পায়রা নদীর পানি বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালীর উপজেলার ১৭টি চরের ২০টি গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
চরাঞ্চলসহ দুর্গম অঞ্চলের বেশ কিছু মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। আম্পানের ক্ষয়-ক্ষতি মনিটরিং করার জন্য জেলা ও উপজেলায় ১০টি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। জেলায় মোট ৭৫২টি আশ্রয় কেন্দ্রে পর্যাপ্ত শুকনা খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে ৩২৫টি মেডিকেল টিম করছে। পায়রা বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সতর্কাবস্থানে রয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বন্দরের সকল কার্যক্রম।
এদিকে শহর রক্ষা বাঁধ উপচে শহর প্লাবিত হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের অধিকাংশ রাস্তা এবং বেড়িবাঁধ উপচে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে বাড়িঘর ডুবে গেছে। ভেসে গেছে অনেক চাষির মাছের ঘের। ওইসব এলাকার মানুষ সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছে।