জিপিএ ফাইভ ও উচ্চ শিক্ষাই মেধাবী নির্ণয়ের মাপকাঠি নয়
11, June, 2020, 12:42:17:PM
জুবায়ের আহমেদ
জ্ঞানার্জন করা প্র্যতেক নর নারীর উপর ফরজ। ইসলাম ধর্ম ছাড়াও প্রত্যেক ধর্মেই জ্ঞানার্জনের তাগাদা দেওয়া হয়েছে। জ্ঞানার্জনের বড় মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একটি শিশু কথা বলতে শেখার পরই মা, বাবা ও পরিবারের সদস্যদের কাছে থেকে কথা বলা শেখে, পরিবারের সদস্যদের কথাবার্তা, আচার আরচণ শিখে। শিশুরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়েও বেশি নৈতিক শিক্ষা পায় মা বাবার কাছে। পরিবার ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে। নৈতিক শিক্ষা পাওয়া একজন শিশু পরবর্তীতে বেশি লেখাপড়া না করলেও একজন ভালো মানুষ হতে পারে সহজেই। পেশাগত জীবনেও সফল হতে পারে নম্রতা ভদ্রতা ও পাশাপাশি নিজের ইচ্ছা শক্তি ও মেধা দিয়ে।
বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও দিন দিন শিক্ষিত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। স্বাক্ষরতার হার এখন ৭৩.৯ শতাংশ। সেই সাথে বিগত এক যুগ আগেও যেখানে একটি গ্রামে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী থাকতো বড়জোর ৪ থেকে ৫ জন, সেখানে বর্তমানে ২০ থেকে ২৫ জন, আবার তারও বেশি অনেক গ্রামে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চ শিক্ষার্থীর সংখ্যাও এখন পূর্বের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। প্রাথমিক থেকে পূর্বে বহু শিক্ষার্থী ঝড়ে যেতো, যা এখন মাধ্যমিকে এসেছে। বাল্য বিয়ে বন্ধের ফলে যে সকল কিশোরীরা প্রাথমিক শেষেই বাল্য বিয়ের বলী হতো তা এখন মাধ্যমিক শেষে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েছে। ছেলেদের বেলাতেও তাই। পূর্বে যেখানে এসএসসির আগেই ছেলেরা প্রবাসে চলে যেতো বা দেশেই কাজে লেগে যেতো সেখানে এখন প্রবাস গমনে জাতীয় পরিচয় পত্র বাধ্যতামূলক, করা এবং মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির ফলে ছেলেদের লেখাপড়া করাচ্ছে অন্তত এসএসসি পর্যন্ত।
দেশব্যাপী অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন এবং উচ্চ শিক্ষিতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষা এখন ভালো রেজাল্টের প্রতিযোগিতা, শুধু ভালো চাকুরী এবং পেশাগত জীবনে সফলতার মূল অস্ত্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। যার ফলে অভিভাবকদের চাপে ছোট থেকেই শিশুরা বইয়ের বোঝা কাঁধে নিয়ে পড়ার চাপে হারাচ্ছে আনন্দঘন শৈশব। পাঠ্য বইয়ের চাপে নৈতিক শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। পড়ার চাপে মানুষের সাথে ঠিকমতো না মেশার কারনে শেখা হচ্ছে না বাস্তব জীবনের কোন কিছুই। সেই সাথে ওর মতো,এর মতো ভালো রেজাল্ট করতেই হবে, ভালো রেজাল্ট মানেই মেধাবী ছাত্র, ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, অভিভাবকদের এই ধরনের মানসিকার বলি হচ্ছে বহু শিশু, যারা পড়ার চাপ নিতে না পেরে আত্মহত্যা করছে। ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে আত্মহত্যা করছে। প্রতিবেশীদের কটুক্তির কারনে মূল্যবান জীবন শেষ করে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে ততই শিক্ষিতের হার বাড়ছে ততই শিক্ষা হয়ে যাচ্ছে গৌরবের অহংকারের। সকলেই লেখাপড়া করায় এখন কাউকে অশিক্ষিত বলে তাচ্ছিল্য করার বিপরীতে তুই, তুমি জিপিএ ফাইভ পাওনি, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছো না বা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছো না মানে তুমি মেধাবী নও। খারাপ ছাত্র ছিলে তাই পারনি। এমন মানসিকতা সবার মাঝে। স্বয়ং অভিভাবকেরাও সন্তানরা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে হতাশ হন, কথা শোনান, মেধা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। জিপিএ ফাইভ না পাওয়াকে দায়ী করেন। প্রতিবেশী বা সহপাঠীরাও দূরে সরে যান শুধুমাত্র ভালো রেজাল্ট করতে না পারায়। সবাই ধরে নেয় যে, সে এ প্লাস বা এ গ্রেড পায়নি মানেই ভালো ছাত্র নয়। এই ধারণাটা আমাদের সমাজ ও দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, যার বলী হচ্ছে বহু শিক্ষার্থী। অথচ পাঠ্য বই নিয়মিত পড়লেও সব বিষয়ে সবার ভালো জ্ঞান থাকে না, সবাই ভালো বুঝে না, প্রয়োজনও নেই বুঝার। যে বিষয়ে ছাত্রটি ভালো বুঝে সে বিষয়ে ভালো করলেই হয়। আর ডি গ্রেড পেয়ে পাশ করা ছাত্রও কোন না কোন বিষয়ে ভালো বুঝে। এটা প্রকৃতিগত বিষয়। ভালো বুঝার বিষয়টি দিয়েই প্রমাণ হয় সে মেধাবী,না হয় সে কোন বিষয়েই ভালো বুঝতো না। আবার লেখাপড়া কম করেও অনেকে ভালো রেজাল্ট করছে। এর মানেই সে মেধাবী নয়।
যার বিবেক বুদ্ধি আছে সেই মেধাবী। মেধাবী হতে পারে একজন ড্রাইভার, কৃষক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ক্রীড়াবিদ ও মিস্ত্রি সহ যেকোন পেশার মানুষ। একজন মেধাবী মানুষের পরিচয় হলো সে যে কাজটি করবে তা বুদ্ধি খাটিয়ে করে সফলতা অর্জন করা। চৌকসতার সাথে কাজটি সম্পন্ন করার মাঝেই মেধার স্বাক্ষর রাখা যায়। মেধাবী মানেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ, ভালো রেজাল্ট বা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণই নয়। নৈতিক শিক্ষা পাওয়া, বিবেকবোধ জাগ্রত রাখা এবং নিজ কাজে সফল হওয়ার চেয়ে বড় মেধাবী আর কেউ হতে পারে না। অথচ এখন মেধাবী নির্ধারণ করা হয় শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ভালো রেজাল্ট এবং উচ্চ শিক্ষা দিয়ে। যারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ, ব্যারিস্টার, বিসিএস ক্যাডার হওয়া সহ বড় বড় মাধ্যমে ভালো চাকুরী করে তাদেরকেই মেধাবী হিসেবে গন্য করা হয়। একজন নার্স তার কাজে সবসময় সফল হলেও তাকে মেধাবী মনে করা হয় না, কারন সে ডাক্তার নয়। একজন কৃষককে মনে করা হয় মূর্খ, কারন সে লেখাপড়া করেনি। অথচ একজন কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম, ভালো জীব বপন এবং প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে বীজ থেকে উৎপাদিত ফসলকে খাদ্য উপযোগী করে তোলার মাঝে মেধার স্বাক্ষর রাখে। দেশের মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ করে। খাদ্যের যোগান না হলে, খাদ্য না থাকলে অন্যসব বড় বড় পেশাজীবির কি মূল্য আছে।
শুধুমাত্র ভালো রেজাল্ট, উচ্চ শিক্ষা বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই যে মেধাবী নির্ধারণের মাধ্যম নয় তা বুঝার ও মানার জন্য মুসলিমদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কি হতে পারে। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন না করলেও তিনি সর্বোচ্চ জ্ঞানী ও মেধাবী ছিলেন। বিশ্বের সেরা একশত মনিষীর মধ্যেও তিনি প্রথম স্থানে জায়গা করে নিয়েছেন। বাংলাদেশে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কি হতে পারে। তিনি শুধুমাত্র মক্তবে ধর্মীয় ও প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেও সাহিত্যকর্মে ভূবন জয় করেছেন। আজ কাজী নজরুলের সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করে ডক্টটের ডিগ্রি লাভ করছেন বহুজন। বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেলাতেও তাই। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস এর উচ্চ শিক্ষার সনদ ছিলো না, প্রযুক্তিবিদ স্টিভস জবস কলেজ সনদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সফল স্থপতি ফ্র্যাংক লয়েড রাইট বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নিতে পারেননি। আজকের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করতে পারেননি। স্যার আইজাক নিউটন খেলাপড়ায় খারাপ ছাত্র ছিলেন। বাংলাদেশেও বহু সফল ব্যক্তি আছে যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। এখন তাদের গড়া ও সফলতা অর্জন করা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে শত শত উচ্চ শিক্ষিতরা।
বাংলাদেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থাও এক্ষেত্রে অনেকটা দায়ী। পাশাপাশি মানুষের হীনমন্যতা, দাম্ভিকতা,অহংকার এবং লেখাপড়া করা না করা সকল কর্মহীনদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না থাকাও বড় কারণ। যার ফলে যারা কাজে লেগে যায় বা বড় মাধ্যমে কাজ করে তাদেরকে মেধাবী গন্য করে অন্যদের তাচ্ছিল্য করা হয়। যথেষ্ট কর্মসংস্থান থাকলে এবং সকলেই কাজে নিযুক্ত হতে পারলে স্ব স্ব দক্ষতা অনুযারী কাজ করে মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারতো। মানুষের ভাবনার পরিবর্তনের পাশাপাশি কোন কাজকেই ছোট করে না দেখে কর্ম সম্পাদনকারীর অবদানকে মূল্যায়ন করা জরুরি। সেই সাথে সকল কর্মহীনদের স্ব স্ব দক্ষতার বিষয়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে কাজে লাগিয়েই দেশকে এগিয়ে নেয়ার বিকল্প নেই। জিপিএ পাওয়া বা উচ্চ শিক্ষাই নয়, কাজে সফলতা অর্জন করাতেই মেধাবীর পরিচয় পাওয়া যায়, এই মানসিকতা সবার মাঝে তৈরী হবে।
শিক্ষার্থী ডিপ্লোমা ইন জার্নালিজম বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম)