নিজস্ব প্রতিবেদক : বিশ্বব্যবস্থা ওলট-পালট করা বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঢেউ কাবু করে ফেলেছে দেশের বিপুলসংখ্যক বেসরকারি চাকুরিজীবী ও নিত্যশ্রমের মানুষকে। দেশব্যাপী দীর্ঘ ছুটি, লকডাউন, সংক্রমণ পরিস্থিতির ক্রমাবনতির মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ও নিত্যপণ্যের স্থায়ী ব্যবসায়ী ছাড়া বেসরকারি বিভিন্ন খাতের চাকুরে ও শ্রমজীবী মানুষের চলছে কঠিন দুর্দিন। তাদের সামনে এখন শুধুই অন্ধকার।
এ অবস্থায় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে না পেরে ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামের পথ ধরেছেন রাজধানীতে বসবাসকারী এ ধরণের বিপুল সংখ্যক মানুষ। উপার্জন কমে যাওয়ায় বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মতো সংকটে পড়েছেন বাড়ির ভাড়ার ওপর নির্ভরশীল বাড়িওয়ালারাও। আর্থিকভাবে সমস্যায় থাকায় ভাড়াটিয়ারা ঠিক মতো বাড়িভাড়া দিতে পারছেন না। পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেক বাড়িওয়ালাও ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ দিতে পারছেন না। রাজধানীর অলিগলিতে এখন ‘টু-লেট’ এর প্লাবন বইছে।
গত মার্চের শুরুতে দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী প্রথম শনাক্ত হয়। তারপর সংক্রমন পরিস্থিতি ক্রমাবনতির দিকে যেতে থাকলে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপর দফায় দফায় ছুটি বাড়তে থাকে। সর্বশেষ গত ৩০ মে শেষ হয় টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি। দীর্ঘ ৬৬ দিনের সে ছুটির পর গত ৩১ মে থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে অফিস-আদালত ও ব্যবসা-বাণিজ্য খুলে দেয়া হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কোনো উন্নতির লক্ষণ নেই। বরং দিন যত যাচ্ছে- পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপের দিকেই যাচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে সংকট আরও ঘণীভূত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, নির্মাণসহ সব খাত স্থবির হয়ে পড়ায় গত কয়েক মাসে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন রাজধানীর লাখ লাখ মানুষ। কাজ হারিয়েছেন গৃহশ্রমিক, পোশাকশ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক, হোটেলশ্রমিক থেকে শুরু করে সব খাতের শ্রমজীবীরা। করোনা তাণ্ডবে কর্মহীন এসব মানুষ আয় হারিয়ে নিত্যপণ্যের পাশাপাশি বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকেই বাসা ভাড়া দিতে না পেরে ছেড়ে গেছেন রাজধানী ঢাকা। কেউবা বড় বাসা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত ছোট বাসায় উঠেছেন। আবার কেউবা শহরের উপকণ্ঠে কম টাকার ভাড়ার বাসায় আশ্রয় গড়েছেন।
সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় কিছু নিম্নবিত্ত পরিবারের খাদ্যের সংস্থান হলেও দিতে পারছেন না ঘরভাড়া। ফলে গত কয়েক মাসে অসংখ্য পরিবার রাজধানী ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে গ্রামে। কয়েক মাসের ঘরভাড়া বকেয়া পড়ায় অনেকে মালপত্র রেখেই চলে গেছেন। মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্তরা অর্থসঙ্কটে পড়েছেন। ভালো চাকরি করলেও কোনো কোনো অফিস বেতন কমিয়ে দিয়েছে কিংবা লোক কমানোর তালিকায় নাম উঠে যাওয়ায় এখন চোখে সরষে ফুল দেখছেন।
সাভার এলাকার একটি বেসরকারী সিরামিকস কারখানায় চাকুরী করেন সাহাবুদ্দিন। প্রতিদিন ১২ ঘন্টা কাজ করে সারা মাসে বেতন পান সর্বসাকুল্যে ১৭ হাজার টাকা যা দিয়ে কোনক্রমে সংসার চালিয়ে আসছিলেন। করোনা সংক্রমনের আগে থেকে মালিক বেতন দিতে পারছিলেন না। করোনা শুরুর পর কারখানা বন্দ করা হয় যা আর খোলেনি। এদিকে গত জানুয়ারী মাস থেকে বেতন বকেয়া রয়েছে। জমানো কিছু টাকা এবং ধারকর্য করে এতদিন চালিয়ে এসেছেন; ঈদ পার করেছেন শূন্যহাতে। মালিকপক্ষ ফোন বন্ধ রেখেছে। দেশের বাড়ীতেও তেমন কিছু নেই যে সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেবেন। ছেলে-মেয়ে নিয়ে এখন কোথায় যাবেন ভেবে পাচ্ছেন না সাহাবুদ্দিন।
গুলশানে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন আরিফুল হক। গত মাসে তার প্রতিষ্ঠান পাওনা চুকিয়ে দিয়ে ১৫ ভাগ জনবল কমিয়েছে। আরিফুল হক বলেন, পরিবার নিয়ে এখন মহাসঙ্কটে পড়েছি। করোনার এই সময়ে চাকরি পাওয়া কঠিন। কী যে করব বুঝতে পারছি না।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে অর্থাভাবে মানুষ বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে ভাড়া কমিয়ে হলেও ভাড়াটিয়া রাখার চেষ্টা করছেন অনেক বাড়িওয়ালা। কিন্তু কাজ না থাকায় সেই সামর্থ্যও নেই অনেকের।
রাজধানীর ভাটারা থানাধীন ছোলমাইদ এলাকায় একটি তিনতলা ভবনের নিচতলায় তিন বেডরুমের ‘ব্যাচেলর’ ফ্ল্যাটে সাড়ে চার হাজার টাকা দিয়ে থাকছেন মাত্র একজন। দুই মাস আগেও তাকে ভাড়া দিতে হতো পাঁচ হাজার টাকা। তখন অন্য দুই কক্ষে আরো দু’জন ছিল। কাজ না থাকায় ভাড়া কমিয়েও অপর দু’জনকে রাখতে পারেননি বাড়িওয়ালা। করোনা পরিস্থিতির আগে ফ্ল্যাটটি থেকে বাড়িওয়ালা পেতেন মাসে ১৫ হাজার টাকা। পুরো ফ্ল্যাটে একজন থাকলেও তাকে সেই ভাড়া পরিশোধ করতে হতো। ওই ভবনেরই তিনতলায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে পুরো ফ্ল্যাট নিয়ে থাকছেন আরেকজন।
এ দিকে গত দুই মাসে এই এলাকা থেকেই শতাধিক পরিবার ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। অধিকাংশ বিল্ডিংয়ে ঝুলছে ‘টু-লেট’ লেখা সাইনবোর্ড। অনেকেই ভাড়া বকেয়া পড়ায় মালপত্র রেখে চলে গেছেন। ভাটারার ছোলমাইদ ও বসুমতি এলাকার টিনশেড ঘরগুলোতে বসবাস মূলত গৃহকর্মী, রিকশাচালক ও নির্মাণশ্রমিকদের। এর মধ্যে কিছু রিকশাচালক টিকে থাকলেও করোনার কারণে কাজ হারিয়েছেন অধিকাংশ গৃহকর্মী ও নির্মাণশ্রমিক। ওই এলাকার বাড়িওয়ালা হাজী বদরউদ্দিনের আটটি ভাড়াটিয়া পরিবার গত তিন মাসে ঘর ছেড়েছে।
বদরউদ্দিন জানান, বটগাইছ্যাবাড়ি এলাকায় তার টিনশেড ভাড়া ঘর থেকে করোনা পরিস্থিতির শুরুতেই তিনটি পরিবার ভাড়া না দিয়ে চলে গেছে। তাদের ঘরগুলোতে তেমন কোনো মালামালও ছিল না। এ ছাড়া বালুর মাঠ এলাকায় তার টিনশেড ভাড়াঘর থেকে আরো চার ভাড়াটিয়া ঘরে তালা দিয়ে চলে গিয়েছিল। গত মাসে তাদের দু’জন এসে অনুনয়-বিনয় করায় ৩-৪ হাজার টাকা মওকুফ করে ছেড়ে দেন। এ ছাড়া দুই মাস আগে তার আরেকটি ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া নেন এক নারী। দু-একদিনের মধ্যে অগ্রিম টাকা দেবেন জানিয়ে ঘরে কিছু মালপত্র রেখে তালা দিয়ে চলে যান। এখন পর্যন্ত ফেরেননি। ফোনেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারের হাজীনগরে একটি চারতলা বাড়ির মালিক শামীমা বেগম। স্বামী মারা গেছেন। শামীমা বলেন, বাড়ির ভাড়ার টাকায় আমি চলি, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাই। করোনার আগে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল পরিশোধের পর ভাড়াবাবদ প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকার মতো পেতাম। করোনা তো সবাইকে বিপদে ফেলেছে। ভাড়াটিয়ারা এখন ঠিক মতো ভাড়া দিতে পারছেন না। কোনো কোনো ভাড়াটিয়ার তিন মাসের বকেয়া পড়েছে। সব দেখতে পাচ্ছি, চাপও দিতে পারছি না। এখন মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার বেশি আদায় হচ্ছে না। কি যে করবো এখন ভেবে পাচ্ছি না।
বেসরকারি সংস্থায় অফিস সহকারীর কাজে কর্মরত গাইবান্ধার হাসান থাকতেন ছোট একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে বাড়ি। ভাড়া ১২ হাজার। বউ কাজ করতেন আয়া হিসেবে এক বাসায়, ৮ ঘণ্টা বাচ্চা রাখার কাজ। দুজনে মিলে আয়-রোজগার ভালই ছিল। করোনা শুরু হওয়ার পরে বউয়ের কাজ চলে গেলে বাড়ি ভাড়াটাই হয়ে ওঠে গলার কাটা। গত মাসে বাড়ি খুঁজে ৩শ ফিট থেকে ভেতরের দিকে একটা ছোট্ট টিন-শেডে উঠে পড়েছেন এই মাসের শুরুতে।
পিকআপে মালপত্র নিয়ে বসে আছেন সাহেরা ও তার মা আয়নুরা বেগম। একটি খাট, ছোট টেবিল, টিভি, বেডিং, রান্নার জিনিস বস্তাবন্দি। মিরপুরের পাইকপাড়ায় টিন-শেডে দুই রুমে থাকতেন। স্বামী গুলিস্তানে একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। কাজ থেকে বাদ পড়েছেন মার্চের ২৬ তারিখ। সাধারণ ছুটি শেষ হলে যদি আবার সব স্বাভাবিক হয় এই আশায় ঢাকায় ছিলেন। কিন্তু ঢাকার বেশিরভাগ রেস্টুরেন্ট জুনের শুরুতে খোলা হলেও, ছাঁটাই করা হয় তাকে। ত্রাণ নিয়ে এই কয় মাস খাওয়ার সংস্থান হলেও বাড়ি ভাড়া, বিভিন্ন বিল দিতে যে নগদ টাকা লাগে তা হাতে নেই। স্ত্রী সন্তান ও শাশুড়িকে গ্রামে রেখে এসে কোনও মেসে উঠে কাজের সন্ধান করার পরিকল্পনা করেছেন তিনি।
এদিকে সন্তানের স্কুলসহ নানা বিষয়ে রাজধানীর সাথে জড়িয়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণী শেষ সম্বল খরচ করে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছেন। অনেকেই ভাড়া কমাতে ফ্ল্যাট বাসা ছেড়ে উঠছেন শহর থেকে দূরে টিনশেড ঘরে। বড় ফ্ল্যাট ছেড়ে উঠছেন ছোট ফ্ল্যাটে। করোনা সঙ্কটের কালো মেঘ কবে কাটবে, সেই আশায় এখন দিন গুনছেন তারা।