যার জীবন আছে তাকে মৃত্যুবরণ করতেই হবে। এই বিশ্বাস সকলের আছে। মৃতু থেকে বাঁচার কোন ঔষধ এখনও চিকিৎসা বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে পারেনি। আর কোনদিন তা পারবেও না। একটি জীবন জন্মগ্রহণ করলে তাকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে এটা প্রকৃতির নিয়ম। পৃথিবীতে সকলের প্রত্যাশা থাকে তার যেন স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। অস্বাভাবিক মৃত্যু কেউ আশা করে না। কিন্তু বাংলাদেশে অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যু এত বেড়ে গেছে যে, পরিসংখ্যান দেখলে যে কেউ চমকে উঠবে। প্রতিদিন অকালে ঝরে যাচ্ছে শতশত তাজা প্রাণ। খবরের কাগজ বা টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠছে বীভৎস সব লাশের চেহারা। এই সমস্ত মৃত্যুর খবর যেন আমাদের সয়ে গেছে। ফলে প্রতিদিন শতশত প্রাণ ঝরলেও তা আমাদের মনকে আবেগতাড়িত করে না। প্রতিদিন বাংলাদেশে বিভিন্ন যাত্রা পথে হাজারো প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। আকাশ স্থল বা জল, কোন পথ আজ নিরাপদ নয়। সীমান্ত হত্যা, বিচার বহিরর্ভূত হত্যাকান্ড লাশের মিছিলে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য দায় কার? কেনই বা এই মৃত্যুকে হ্রাস করা সম্ভব হচ্ছে না। যাত্রী ও পথচারীদের জন্য দেশের রাস্তাঘাট এখনও রয়ে গেছে ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ। গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দেশে ৭৫৫ সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪১ নারী ও ১৬৬ শিশুসহ মারা গেছেন ১,০২৭ জন। সেই সাথে আহত হয়েছেন ১,৩০১ জন।
করোনাভাইরাসের কারণে জনসাধারণের চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ থাকলেও গত জুন মাসে ২৯৭ টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩৬১ জন মারা গেছেন। এমন পরিসংখ্যান দিচ্ছে জাতীয় দৈনিকসমূহ।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সংগঠনের করা ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৭০২টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫ হাজার ২২৭ জন। আহত ৬ হাজার ৯৫৩ জন ২০১৯ সালে দেশের সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বিগত দুই বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে উল্লেখ করে নিসচার প্রতিবেদনে বলা হয়। প্রতিবেদনে এসেছে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ১ হাজার ৫৯৯টি বেশি হয়েছে। ২০১৮ সালে ৩ হাজার ১০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৩৯ জন নিহত ও ৭ হাজার ৪২৫ জন আহত হয়েছিল। আর ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৬৪৫ জন নিহত ও ৭ হাজার ৯০৮ জন আহত হয়েছিল। অথচ এই বিপুল সংখ্যক তাজা প্রাণ আর হাজারো স্বপ্নের ইতি সড়ক পথে নিঃশেষ হলেও আমাদের রাষ্ট্র কোন এর দায়ভার নিতে রাজি নয়।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলেছে সবকিছু। বেড়েছে প্রযুক্তিগত উন্নত সুবিধা। তবুও সবচেয়ে নিরাপদ যাত্রা হিসেবে পরিচিত রেলপথেও দুর্ঘটনা থামছে না। ৩০ বছর আগেও রেল দুর্ঘটনা যেসব কারণে ঘটেছে এতদিন পরও এর পরিবর্তন হয়নি।
সড়ক পথে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি হওয়ার কারণে মানুষ রেলপথকে পছন্দের তালিকায় রাখে। কিন্তু সেই রেলপথে যাত্রা নানা কারণে অনিরাপদ হয়ে উঠছে। শুধু ২০১৯ সালে রেলপথে ১৬২টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৯৮ জন, আহত ৩৪৭ জন। ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল এই নয় বছরে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে দুই হাজার ২২২ জন। ছোট বড় মিলিয়ে মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা ২৯৭টি। চলতি বছরেও কিছু ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী।
জলপথে যাতায়াত সাশ্রয়ী এবং নিরাপদ মনে হলেও গত কয়েক বছরের নৌ-দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান দেখলে শিউরে উঠতে হয়। নদী নিরাপত্তা বিষয়ক সামাজিক সংগঠন ‘নোঙর’-এর হিসাব অনুযায়ী ১৪ বছরে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৫৩৫টি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর এতে ছয় হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এই দিকে শুধু ২০১৯ সালে নৌপথে ৩০টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৬৪ জন এবং আহত হয়েছে ১৫৭ জন আর নিখোঁজ ১১০ জন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সারাদেশে বিভিন্ন নৌপথে এই ছয় মাসেই যাত্রী ও পণ্যবাহী মিলিয়ে মোট ১০৬টি ছোট-বড় নৌ-দুর্ঘটনায় ১৫৩ জন নিহত ও ৮৪ জন আহত হয়েছেন। এই সময়ে নিখোঁজ হয়েছেন আরো অন্তত ২২ জন। এ বছর ইতোমধ্যে বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবিতে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। এই ঘটনায় ৩৪টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এমন হতাহত ঘটনা দৃশ্যমান হলেও নৌপথের যানবাহনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তেমন কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আকাশপথে গত বছর দেশে কোন বড় দুর্ঘটনা না ঘটলেও বিগত বছর গুলোর পরিসংখ্যান আকাশপথেরও নিরাপত্তাও আশাহত করে। তবে বিশ্বব্যাপী ২০১৯ সালে বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে ৮৬টি। এর মধ্যে ৮টি ছিল মারাত্মক দুর্ঘটনা। সব মিলিয়ে মানুষের মৃত্যু হয়েছে ২৫৭ টি।
শুধু যাত্রাপথ নয়, দেশে অকারণে প্রতিদিন ঝরে যাচ্ছে শতশত প্রাণ। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা প্রবাসী শ্রমিকরাও মৃত্যুর পরিসংখ্যানে পিছিয়ে নেই। প্রবাসী শ্রমিকের লাশ দেশে ফেরার সংখ্যা বাড়ছে বাংলাদেশে। সরকারি হিসেবে গত এক দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করতে যাওয়া ২৭ হাজার ৬৬২ জন শ্রমিকের লাশ দেশে ফেরত এসেছে। তার সাথে বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারণে উদ্বেগজনক হারে বিচার বহিরর্ভূত হত্যাকান্ড বেড়েই চলছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকার আমলে ক্রসফায়ারে ৭৩৬ জনের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে ৫৪৪ জনই ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার আগে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর ঘটনা কমলেও ক্রসফায়ার বন্ধ হয়নি। আসকের হিসাবে, ২০০৭-০৮ সালে, দুই বছরে ক্রসফায়ারে নিহত হন ২৫৬ জন। সেই গল্প এখনো চলছে গ্রেফতার ব্যক্তিকে নিয়ে রাতের বেলায় অস্ত্র উদ্ধারে বের হলে বা তার সহযোগীদের গ্রেফতার করতে বের হলে ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা হামলা, গুলিবর্ষণ করে। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আত্মরক্ষায় পাল্টা গুলি ছোঁড়ে। দুই পক্ষে বন্দুকযুদ্ধের সময় ক্রসফায়ারে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় বন্দী ব্যক্তি। ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের সব গল্প প্রায় এ রকম। ঘটনাস্থল থেকে কিছু অস্ত্র উদ্ধারও দেখানো হয়। ২০০৪ সালে শুরু হওয়া এই গল্প এখনো জারি আছে। কেবল ক্রসফায়ার-এর স্থলে কখনো কখনো ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘এনকাউন্টার’ শব্দ প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
মহাজোট সরকার নির্বাচনের ইস্তেহারে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার তা বিন্দুমাত্র রক্ষা করতে পারেনি। আসকের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত পাঁচ বছরে ক্রসফায়ারে মোট নিহতের সংখ্যা ৩৮০ জন। এরপর ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে দেওয়া আওয়ামী লীগের ইশতেহার থেকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’র প্রসঙ্গটি বাদ পড়ে যায়। সর্বশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারেও এ বিষয়টির উল্লেখ নেই। যার ফলে বিগত এবং চলতি বছর অনেক হত্যার ঘটনা ঘটছে।
সীমান্ত হত্যা যেন কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। আমাদের কথিত বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে যে কয়টি দেশের সীমান্ত রয়েছে তারমধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের সাথে ভারতে কোন বিরোধপূর্ণ সীমান্ত নেই। তারপরেও শুধুমাত্র বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে প্রতিবছর অকালে অনেক বাংলাদেশির প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যথাক্রমে ৬৬, ২৪, ১৮, ৩৮, ১৭, ৪৩, ৫৫, ২৪, ২৪, ২৫, ১৪ এবং চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৩০ জন বাংলাদেশির হত্যাকান্ড ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে। এমন চিত্র তুলে ধরেছে বিবিসি বাংলা। অসংখ্য বাংলাদেশী ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে নির্যাতন ও হত্যার শিকার হলেও বাংলাদেশ সরকার অজানা কারণে কোন প্রতিবাদ করেনা। যার ফলে সীমান্তে প্রতিদিন অসংখ্যা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে।
প্রতিদিন পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে অসংখ্য হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে। যেকারণে দেশে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যাও দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন অনেক ঘটনা আছে যেগুলো খবরের কাগজ বা টেলিভিশনের পর্দায় আসেনা। কিন্তু এই পরিসংখ্যান এর বাহিরে বাস্তবিক চিত্র আরো মারাত্মক ভয়াবহ।
এমনাবস্থায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমি, আপনি বা আমরা যেকোন সময় লাশ হয়ে যেতে পারি। রাষ্ট্র চাইলে অকারণে মৃত্যুবরণ অনেকটাই হ্রাস করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সেই স্বদিচ্ছা একদম অনুপস্থিত। সেজন্য ঘুণে ধরা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিবর্তন করে একটি সমতাভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে; যেন প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা যায়। যেখানে সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে আর অকারণে ঝরবে না একটিও প্রাণ। দেশের নাগরিকেরা সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে আর অনুভব করবে স্বর্গীয় সুখের সুবাস।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।