প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় কতটুক প্রস্তুত বাংলাদেশ?
26, July, 2020, 12:21:10:PM
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মূলত স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে ব্যতিক্রম ঘটনা বা ঘটনাবলী। প্রাকৃতিক সাধারণ নিয়ম ব্যতীত যেকোনো ঘটনাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে। স্বাভাবিক জীবন-যাপন ব্যাহত হচ্ছে।যেসকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের কাছে এ পর্যন্ত চিহ্নিত হয়েছে; সেসকল দুর্যোগ মোকাবেলা করতে কতটুকু প্রস্তুতি লাভ করেছি?
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে নিত্যকার ঘটনাতে রুপান্তর হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দুর্ভোগ আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসেব ছাড়িয়েছে অধিক। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের পাশাপাশি মৃত্যুর হার যেন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহাওয়া অধিদফতর কর্তৃক পূর্বাভাস পেলেও ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ এড়ানো সম্ভব হচ্ছেনা। ইতিহাসের পাতা ঘাটলে আমরা দেখতে পাই, ৮৮’র ভয়াবহ বন্যা। বাংলাদেশে সংঘটিত প্রলংকারী বন্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আগস্ট-সেপটেম্বর মাস জুড়ে সংঘটিত এই বন্যায় দেশের প্রায় ৬০% এলাকা ডুবে যায় এবং স্থানভেদে এই বন্যাটি ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিলো। এটি ছিলো এদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক ও ক্ষয়-ক্ষতিময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এই প্রলংকারী বন্যাটি সংগঠিত হওয়ার মূল কারণ ছিলো সারা দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং একই সময়ে দেশের তিনটি প্রধান নদীর পানি প্রবাহ একই সময় ঘটায় নদীর বহন ক্ষমতার অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হয়। এই বন্যায় বাংলাদেশের প্রায় ৮২,০০০ বর্গ কি.মি. এলাকা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরবর্তীতে, ১৯৯৮ সালের বন্যা ছিল বাংলাদেশে সংঘটিত ভয়ংকর বন্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। দুই মাসের অধিককাল জুড়ে সংঘটিত এই বন্যায় দেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যায়।
২০০৭ সালে বঙ্গোপসাগর এলাকায় সৃষ্ট একটি ঘূর্ণিঝড় সিডর। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সকাল বেলা পর্যন্ত বাতাসের বেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কিমি/ঘণ্টা এবং ৩০৫ কি.মি/ঘণ্টা বেগে দমকা হাওয়া বইছিলো। সরকারি ভাবে ২,২১৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছিল। বাংলাদেশ সরকার এ ঘটনাকে জাতীয় দুর্যোগ বলে ঘোষণা করেছে। ঘূর্ণিঝড় সিডরের ফলে প্রায় ৩,৫০০ লোক মারা গিয়েছিল।
২০০৯ সালে সংগঠিত হওয়া আরেক দুর্যোগ আইলা। খুলনা ও সাতক্ষীরায় ৭১১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্থ হয়েছে। প্রায় ২,০০,০০০ একর কৃষিজমি লোনা পানিতে তলিয়ে যায়।কাজ হারায় ৭৩,০০০ কৃষক ও কৃষি-মজুর। জলোচ্ছাস ও লোনা পানির প্রভাবে, গবাদি পশুর মধ্যে কমপক্ষে ৫০০ গরু ও ১,৫০০ ছাগল মারা যায়।কমপক্ষে ৩,০০,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। পর পর দুই মৌসুম কৃষিকাজ না হওয়ায় প্রায় ৮,০০,০০০ টন খাদ্যঘাটতি সৃষ্টি হয়। খুলনা ও সাতক্ষীরায় প্রাণ হারান ১৯৩ জন মানুষ।
সাম্প্রতিক ঘূর্নিঝড় আম্ফান ১৬ মে ২০২০ আঘান আনে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আঘাত আনা ঝড়গুলির মধ্যে এই ঝড়টি সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী ছিল। আনুমানিক ৫ মিটার (১৬ ফুট) উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ে উপকূলীয় সম্প্রদায়ের বিস্তৃত অংশ ডুবে গেছে এবং সেখানকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ১০টি গ্রাম ডুবে গেছে।নোয়াখালী জেলার একটি দ্বীপে ঝড়ের বর্ষণে কমপক্ষে ৫০০টি ঘর নষ্ট হয়েছে। দেশজুড়ে প্রাথমিক ক্ষতি ১১০০ কোটি পৌঁছেছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে ১০ কোটিরও বেশি লোক বিদ্যুৎবিহীন হয়েছিল। কোভিড-১৯ এর কারণে মানুষকে সরিয়ে আনা হলেও প্রশ্ন জেগেছিল সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার।
বর্তমানে বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হওয়ার আশঙ্কা জানিয়েছে জাতিসংঘের কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য মতে ১৮ জেলায় ২৪ লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাসস্থান হারিয়ে ৫৬ হাজার মানুষ, আশ্রয় নিয়েছেন আশ্রয়স্থলে। এ পর্যন্ত অন্তত ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় সাড়ে পাচ লাখ বাড়িঘর বন্যায় কবলিত হয়েছে।বাঁধ ও নদী ভাঙনের ফলে প্রতিনিয়ত পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্ষা মৌসুম এলেই দেখা যাচ্ছে নদী ভাঙন, রাস্তা-ঘাট অল্প বৃষ্টিতেই পানিতে ডুবে যাচ্ছে। সঠিক সময়ে টানেল মেরামত হয়নি। নদী ভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। নির্মাণ হলেও অল্পতে ভেঙে গিয়েছে। টানেল নির্মাণ হলেও জনসাধারণের কান্ড জ্ঞানহীনতার কারণে যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলানোর জন্য ড্রেনের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। আবার, টানেল মেরামত সুষ্ঠু হয়নি তা ভেঙে পড়ছে অচিরেই। দুর্নীতি যেন প্রতিটি স্তর গ্রাস করে নিয়েছে। যার ফলে একটি কাজ শেষ হওয়ার কিছুদিন পরে তা ভেঙে পড়ছে। দুর্ভোগের সীমা ছাড়িয়ে যায় অল্পতেই। আশ্রয় স্থলে মানুষের বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দেয়, খাবারের ঘাটতি দেখা দেয়। এ চিত্র যেন প্রতিবছর প্রতিফলিত হচ্ছে। বন্যায় কবলিত এলাকায় মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, নিরাপদ আশ্রয়স্থল, গবাদিপশু পাখির জন্য নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে তুলতে হবে। দুর্যোগ শেষ হওয়ার সাথে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন এবং নদী ভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। শুধু সরকার নয় বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে আমাদের সকলের সহযোগি মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এড়ানোর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের দুর্ভোগের পরিমাণ অনেকটা লাঘব হবে।
-খায়রুজ্জামান খান বিভাগ:ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া সেশন :২০১৯-২০২০