ধ্রুব খান
আমি আসলে মাঝে মাঝে বুঝে উঠতে পারিনা। তারা কি আসলেই আমার কথা বোঝে নাকি যা হয় তা একটি ভ্রম অথবা আমার মনের সাথে মিলে যায়। আমি যখন মনে মনে ভাবি মা টা এখন সাবান এর উপর বসবে তখন কিভাবে যেনো আসলেই সাবানের উপর বসে। আবার যখন ভাবি বাচ্চাটা এখন আমার নখের কাছে আসবে। আসলেই এসে পরে। এর কারণ কি! টেলিপ্যাথি নাকি। ওদের তো নিজেস্ব কোনো ভাষা নেই। নিশ্চয়ই তারা নিজেরা টেলিপ্যাথির মাধ্যমে কথা বলে। আচ্ছা আমার মাথায় এখন যা ঘুরছে তা কি তারা বুঝতে পারছে! বাবাটা কেমন তাজ্জ্বব হয়ে তাকিয়ে আছে। তারা কি বুঝে ফেলেছে আমি একটা খুন করতে চাই। খুব সুন্দর একটা খুন। সেই খুনেও যেনো সৌন্দর্য ফুটে উঠে। তারা কি আমাকে পিশাচ মনে করছে!
বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখলাম আনিশা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে প্লেট। প্লেটে দুটো পোড়া পরটা। সাথে একটু ভাজি যার দুটো আলু প্রায় সাদা হয়ে গেছে। - মুগ্ধ ভাইয়া দয়া করে রুম টা একটু গুছিয়ে রাখবেন। - কেনো রে, এই রুমে কি তোর বাসর হবে? - বাজে কথা বলবেন না। - রসিকতা করলাম। ছাদের চিলেকোঠায় কেনো কারো বাসর হবে। - হলে হবে। আমার বাবার বাসা। আমি যদি খোলা ছাদে বাসর করতে চাই, কারো কোনো সমস্যা থাকার কথা না।
- খোলা ছাদে না হয় হাত ধরে হাটতে পারবি। বাসর চাইলে এই চিলেকোঠায় করতে পারিস। - তার মানে, আপনি এই বাসা আগামী চার বছরেও ছাড়ছেন না। শুনেন মুগ্ধ ভাইয়া, আমারা একটি সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। আমাদের নুন আনতে পান্তার পানি শুকিয়ে যায়। তার উপর একটা বেকার ছেলেকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানো আমার বাবার পক্ষে সম্ভব না। আমার বাবা চিলেকোঠা রেখেছে আমি যাতে মাঝে মাঝে এখানে এসে বই পড়তে পারি। জানালার কাছে বসে চা খেতে খেতে গান গাইতে পারি। সেখানে সেই চিলেকোঠায় এখন বাস করছে এক গবেট। বাবাকে হয়ত একটা সময়ে আপনারা অনেক সাহায্য করেছেন। তাই বলে এভাবে আপনাকে কেনো পালবে আমার বাবা! - বুঝলাম। - কি ? - যে তুই নেক্সট চার বছরে বিয়ে করবি না। - মুগ্ধ ভাই আপনার কি এই ছাঁদ থেকে কখনো লাফ দিয়ে মরতে ইচ্ছে করে না? - করে কিন্তু সাহসে কুলায় না। - আমাকে বলবেন, আমি ধাক্কা দিয়ে দিবো। শহীদি মৃত্যু হবে। আর ওভাবে আমার দিকে তাকাবেন না। আমার চোখ এমন কোনো ইন্দ্রানির চোখ না যে হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে। গেলাম।
এই মেয়েটাকে কেনো যেনো রাগলে একদমই সুন্দর লাগেনা। আর মেয়েদের নাকি অদৃশ্য চোখ থাকে। আনিশার তো দৃশ্যমান দু’চোখেই সমস্যা। আমি তাকিয়ে ছিলাম তার ডান কাধের উপর দিয়ে ফেলে রাখা বেণির দিকে। ইশশ, আরো কিছুক্ষন সামনে থাকলে ভালো হতো। কেনো যে আমি বাক্যালাপ দীর্ঘস্থায়ী করতে পারিনা। অসহ্য। কালো মেয়েদের অনেক অদ্ভুদ সব ব্যাপারে সুন্দর লাগে। চুপচুপা তেল দিয়ে বেণী করা একটা মেয়েকে যে সুন্দর লাগতে পারে তা আমার জানা ছিলো না। সামনে যতক্ষন ছিলো ততক্ষন কল্পনার জগতে ভালোই ডুবে ছিলাম। সেই জগতে দেখলাম আনিশা রান্না করছে।
আমি পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার বেণীতে নাক দিয়ে ঘসা দিলাম। সে বললো, বেণী সরিয়ে ঘারে নাক ঘষতে। এরপরের ব্যাপার গুলো সেসময় ভাবতে ভালো লেগেছিলো এখন লজ্জা লাগছে। এখন বাজে দশ টা দশ। জাহিনের আসার কথা ছিলো দশটায়। হয়ত নিচে দাঁড়িয়ে আছে। চা যেহেতু দিলো না এখনো চা টা বাইরে থেকে খেয়ে নিতে হবে। আনিশা মনে হয় দেখেছে জানালার কাছে চায়ের কাপে কালকের চা রয়ে গেছে। কিন্তু সেই চা তো খাওয়া যাবেনা। সেই চা তো এক জোড়া চড়ুই পাখির যারা প্রতিদিন সকালে এসে চুক চুক করে খেয়ে যায়। তবে আজ এলোনা কেন?
জাহীন একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে চলছে। গাড়ীতে নাকি তার বসলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। শ্বাস নিতে পারলেও, ছাড়তে পারেনা। তখন এই সিগারেটের ধোয়ার মাধ্যমে শ্বাস ছাড়ে। আমার হাতে একটা পলিথিনে সেই পরোটা আর ভাজী। আমি দূরে সেই পরোটা ছুড়ে দিলাম। লুকিং গ্লাসে দেখলাম একটি কুকুর তার গন্ধ শুঁকছে। হঠাৎ জাহীন জিজ্ঞেস করলো।
- কিরে, আজো সেই স্বপ্ন দেখেছিস নাকি! - দেখেছি। -শুন, আমার একজন চেনা সাইক্রেটিক্স আছে। তার কাছে আজ তোকে নিয়ে যাবো। তুই তোর স্বপ্নের কথা কাউকে বলতে চাস না তাকেও বলার দরকার নেই। সাইক্রেটিক্সদের অনেক সময় কিছু না বললেও সমাধান দিতে পারে। - আচ্ছা জাহীন, একটা মেয়ের বেণী নিয়ে কি সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসী তৈরী হওয়া সম্ভব? - সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসী জিনিসটা অনেক বেশি জটিল। ধর, একটা দুই বেণী করা নর্তকী যার বেণিতে সবুজ রঙের ফিতা বাঁধা। সে তোর ঘরে তোর সামনে নগ্ন হয়ে নাচ দেখালো, তোর কাছে ব্যাপারটা খুব সাধারণ মনে হবে, বাজেও লাগতে পারে। কিন্তু সেই মেয়ে যদি পূর্ণিমায় চাঁদের আলোতে তোর সামনে শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। তোর কাছ মনে হবে সেই সবুজ রঙ্গের ফিতাটা তোকে আরও বেশি টানছে। - তোর দম আটকে যাচ্ছে। - সিগারেট শেষ। কিনতে হবে। চল আগে বাসায় যাই। চা খেয়ে নিস। - ঠিক আছে। - বাসায় গাঁজা রোল করা আছে। গাঁজা খেয়ে কথা বলতে সুবিধা হবে।
- লোকটার নাম কি? - রফিক জামান। আমি জাহীনদের বাসার বারান্দায় বসে আছি। জাহীন এখনো ঘরের থেকে বের হচ্ছে না। চায়ের নামে এদিকে হুলুস্থুল কান্ড চলছে। যারিশা প্রথমে নিয়ে এসেছে পাউরুটি জেলী। এখন আবার নিয়ে এসেছে পনির। বেলের সরবত। আমি একে একে সব খাওয়া শেষ করলাম। সবশেষে চা নিয়ে এসে সামনে বসলো। যখন আসলাম তখন দেখেছিলাম যারিশা একটা সেলোয়ার কামিজ পরা। কখন জানি শাড়ি পরে এসেছে। - মুগ্ধ ভাইয়া, আপনারা দু’জন কি আর জীবনেও চাকরি করবেন না? - নারে, আমাদের ভাগ্যে ওসব নেই। - বাবা প্যারালাইজড হওয়ার পর অনেকবার তাকে ব্যবসাটা দেখাশোনা করতে বলা হয়েছে, এখন তো বাবা ধরেই নিয়েছে আমার জামাইয়ের হাতেই ব্যবসা তুলে দিতে হবে। - ভালো তো।
- যদি আপনার মতো স্বামী পাই, তাহলে তো ভালোই। - কেনো? - আপনি তো আর ব্যবসা নিজের নামে করে নিবেন না। দেখা যাবে ভাইয়াকেই বুঝিয়ে দুজন মিলে ব্যবসা দেখছেন। সুখী পরিবার। - আমি যে নিজের নামে লিখবো না তা তোকে কে বললো? - আপনার নাক। আপনি খাওয়ার আগে কখনো খাবার শুকে খান না। এধরণের মানুষ লোভী হয় না। - ভালো খাবার অনেকদিন পর খেলে তা বাসি হলেও ভালো লাগে। - যাই হোক। ভাইয়ার একটি ডাইরি আছে। সেখানে তার কিছু সিক্রেট লিখে রাখে। আপনি কি তা জানেন? - না। তুই সেই ডাইরি পড়েছিস? - জ¦ী। কান্না পাচ্ছে খুব। ভুল হয়েছে পড়াটা। - আসলেই, এখন যদি ও তোর কোনো সিক্রেট জানে। - মেরেই ফেলবে হয়তো। আমিও ওর মতো ডাইরি লিখছি একটা গতকাল থেকে। কোনোদিন পড়ে ফেললে মেরে ফেলবে আমাকে। - সাবধান।
- আপনি কি ভাইয়ার পরিচিত নিতু নামে কোনো মেয়েকে চিনেন? - চিনি, ভার্সিটিতে আমাদের সিনিয়র এক আপু। - সেই মেয়ে নাকি ভাইয়াকে বলেছিলো, তার বুকে একটা তিল আছে সেই তিল নাকি ভাইয়াকে দেখাবে। কোনো এক জোছনায় বলে তাকে সেই তিল দেখাবে। - মেয়েটা ভালো নাচ পারতো। - ধুরু। হঠাৎ জাহিন বের হয়ে আসলো। যারিশার কাছে যেয়ে গালে একটা থাপ্পড় দিলো। - এখানে বসে বসে আমার বন্ধুকে শরীর দেখানো হচ্ছে? যারিশা কাচুমাচু হয়ে বললো, “নাস্তা দিয়েছিলাম” -ওড়না কোথায়? - শাড়ির সাথে ওড়না কিভাবে পরবো? - মানুষ শাড়ির সাথে চাদড় গায়ে দেয়। গরমকালে ওড়না গায়ে দিবি। শাড়ি পরার কারণটাই তো এখন ধরতে পারলাম। কি ভাবছিস, কমর দেখিয়ে শাড়ি পরলেই আমার বন্ধু তোর প্রেমে পরে যাবে! ভেতরে যা।
এরকম একটা পরিস্থিতির পর যারিশা হাসি মুখে আমাকে বললো, ভাইয়া, আবার আসবেন। গাড়িতে বসে আমি আর জাহিন গাঁজা টানছি। মাথা টা হালকা ধরে এসেছে। - বুঝলি মুগ্ধ, আমার না খুব ইচ্ছে খাগড়াছড়ির একটা পাহাড়ের মধ্যে কুঁড়ে ঘর বানিয়ে থাকি। সামনে থাকবে একটা ডাব গাছ সেটার নিচে থাকবে একটা মাচা। সামনের খালি জায়গায় জোছনার আলো পরবে সেই আলোতে নাচবে এক নর্তকী। কিন্তু ডাব গাছের ছায়ায় তো জোছনা ঢাকা পরে যাবে। কি করা যায় বলতো?
আমি অনেক চেষ্টা করেও জাহীনকে তার উত্তর দিতে পারলাম না। কারণ ততক্ষনে আমার মাথা পুরোপুরি আঁচল হয়ে গেছে যাকে বলে ব্ল্যাক আউট কিন্তু এর মাঝেও মাথায় একটা প্রশ্ন আসলো। পাহাড়ী অঞ্চলে ডাব গাছ হবে তো? আমার সামনে যে লোকটা বসে আছে তার নাম সম্ভবত রফিক জামান। এতক্ষণ তার নাকটা অনেক বড় মনে হচ্ছিলো। পুরো মুখে শুধু নাকটাই দেখা যাচ্ছিল। এখন অবশ্য স্বাভাবিক লাগছে। কড়া এক কাপ চা খেতে দিয়েছেন। ধন্যবাদ জানানো উচিত কিন্তু স্যার বলবো নাকি বুঝতে পারছি না। - তুমি কি এখন স্বাভাবিক? - স্যার, আমি এতোদিন জানতাম দাঁড়ি হলে মানুষের বয়স বেড়ে যায়। আপনাকে তো খোঁচা দাঁড়িতে পয়ত্রিশ বছরের মনে হচ্ছে। আপনার বয়স নিশ্চয়ই এর থেকে বেশী। - জ¦ী, পয়ঁতাল্লিশ।
- জ¦ী না, হ্যাঁ বলুন। তাহলে নিজেকে ছোট মনে হবে। - তোমার বন্ধু বললো তোমার নাকি কিছু সমস্যা আছে। - আমার বন্ধু! সেকি স্বাভাবিক ছিলো? - হ্যাঁ, কারণ তুমি যা সেবন করেছো তা সে সেবন করেনি। - হুম, বুঝলাম। - তোমারা কি অনেক ভালো বন্ধু? - জ¦ী, তবে আমার তাকে ভালো লাগে না। - কেনো ?
- সে আমার অনেক ক্ষতি করেছে। আমি কেনো জানি তাকে কখনো কোনো কিছুতে না করতে পারিনি। মদ, গাঁজা। হঠাৎ একদিন এসে বলে, “পড়াশুনা আর করবো না, শুধু হাটবো, ঘুরবো”। বিভিন্নভাবে আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে যেতো। - তাতে সমস্যা কোথায়? - তার ছোট বোন। সে চায় তার ছোট বোনের সাথে আমি ঘনিষ্ঠ হই। - এমনতো হতে পারে, ছেলে হিসেবে তার তোমাকে খুব পছন্দ তাই সে চায় তার বোনের সাথে তোমার বিয়ে হোক। - তার বোনকে সে একদমই দেখতে পারে না। - সে বলেছিলো, তুমি একটা স্বপ্ন দেখো যা তোমার স্বাভাবিক জীবনে প্রভাব ফেলছে। -জ¦ী সাথে নিশ্চয়ই বলেছে আমি এই স্বপ্ন কখনো কাউকে বলতে পারবো না। - বলেছে। শুনো, মাঝে মাঝে মানুষ তার নিজের সমস্যার সমধান নিজেই করে ফেলে। তুমিও কি কখনো নিজের সমস্যার সমাধান করতে পেরেছো? - জ¦ী, একটি খুন করতে হবে।
- বুঝলাম, কবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছো? - স্যার, আমি আমার বাথরুমে একটা তেলাপোকার পরিবার পালি। তিন সদস্য। বাবা তেলাপোকাটা আমাকে এই বুদ্ধি দিয়েছিলো। ভেবেছিল সিরিয়াসলি নিবো না, কিন্তু বুদ্ধিটা ভালো লেগেছে। খুশি হয়ে ওদের সন্তানের নাম দিয়েছি, “লালু”। - লালু কে ? - আমার মায়ের পালা গরু। এখন কোথায় আছে জানি না। মা মারা যাবার পর বিক্রি করে দিয়েছিলাম। - তোমার মা কিভাবে মারা গেলেন? - একদিন মা লালুকে খাবার দিতে যাচ্ছিলো। হঠাৎ কেনো জেনো লালু মাকে একটা লাথি দেয় পেটে। সেই সময় কিছু হয়নি। মা হেসে বলছিলেন, “আরে ওটুকু বাছুড়ের লাথিতে কি হয়!” সেদিন রাতে গা পুড়ে জ¦র আসলো। মায়ের সারা শরীরে কাঁথা ভিজিয়ে দেওয়া হলো, তাও জ¦র কমলো না। রাতে মারা গেলো।
- তোমার বাবা কি বেঁচে আছেন? - না, তিনি মারা গেলেন মানষিক রোগে। কেনো জানি তার সবাইকে নিজের শত্রু মনে হতো। যে কাছে যেতো তাকেই মারতে আসতো। একা একাই থাকতেন। হঠাৎ একদিন আমাকে ডাক দিলেন। কাছে যেতেই বললেন,”মুগ্ধ, বলতো তোর মা কেন তার আদরের গরুর লাথিতে মারা গেলো! গরুটারে তো সে খুব আদর করতেন। তাও কেন সেই গরু তারে লাথি দিলো। কারণটা আজকে বলি, তোর মারে জ্বীন ধরছিলো। সে হয়ে গেছিলো একটা পিশাচ। গরুরা তো এসব বুঝে তাই তোর মারে লাথি দিছিলো। সেই জ্বীনটাই আমারে জ্বালায়। আমারে স্বপ্নে বলে, তোরা আমারে মাইরা ফেলবি। আজকে জ্বীনটা চলে গেছে। সবাইরে আপন মনে হইতেছে। আমারে এক গ্লাস ডাবের পানি খাওয়াতে পারবি?” আমি সেদিন রাতে বাবাকে ডাবের পানি খাওয়াই। সে খুব খুশি হয়। আমার জন্য দোয়া করে ঘুম দেয়। পরদিন সকালে মারা যায়।
- মানষিক রোগটার নাম Delusional disorder of persecutory. - ধন্যবাদ। - তুমি তো পড়াশুনা করোনা। থাকো কোথায়? - মামার বাড়ির ছাদের চিলেকোঠায়। - একটা বেকার ছেলেকে তিনি খাওয়াচ্ছে ? - জ্বী স্যার, ছোটবেলায় যখন আমার বয়স পাঁচ বছর তখন হঠাৎ মামা কি রাজনৈতিক সমস্যায় পরে। পুলিশ তাকে খুজতে থাকে। তখন প্রায় সাত মাস তিনি আমাদের সাথে আমাদের বাড়িতে ছিলেন। রুম দুটো ছিলো। তিনি আমার সাথেই ঘুমিয়েছেন সাত মাস। - তিনি এখন কি করেন? - মামা এখন সাবেক কাউন্সিলর। ডেমরা এলাকার। - সাবেক! এই অভাবের সংসারে একটা বেকার ছেলে পালছে। নিশ্চয়ই অনেক ভালো মানুষ। - স্যার, আমি উঠি। আনিশা আমার জন্য অপেক্ষা করবে। দুপুরের খাবার দিতে আসবে। - আনিশা কে? তোমার মামাতো বোন? - জ¦ী, অসাধারণ রুপবতী একটি মেয়ে।
- তাকে তুমি পছন্দ করো? - পছন্দ করি নাকি জানি না তবে দৈহিক আকর্ষণ অনুভব করি। - সেটাও ভালোবাসার অংশ। দৈহিক আকর্ষণ একটা সম্পর্ক অনেকদিন টিকিয়ে রাখতে পারে যা ভালোবাসাও পারে না। ভালোবাসার চাহিদা কমে যায়, বিলীনও হয়। দৈহিক চাহিদা বিলীন হয় না। - আসি স্যার। আবার আসবো। - খুন সম্পন্ন করে? আনিশা খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের প্লেটে ভাত সাথে আছে ভেন্ডি ভাজি। ডালের পানিও হালকা দেখা যাচ্ছে। - লেবু নেই রে? - কাটা নেই। - গাছে আছে তো। একটা ছুড়ি দিয়ে যা। আমি কেটে খাবো। - আমাদের গাছে হাত দিলে আমি আপনার হাত কেটে ফেলবো। - আচ্ছা।
আনিশার সাথে কথা কেনো যেনো বাড়ানো যায় না। স্নান করে এসেছিলো মনে হয়। ঘার বেয়ে ভেজা চুলের পানি গলায়ে বেয়ে গড়িয়ে বুকের দিকে যাচ্ছিলো। কি সুন্দর লাগছিলো। দুটো সমস্যা হয়ে গেলো। এক ছুড়িটা পাওয়া গেলো না। মন মতো খুন করতে পারবো না। আরেক সমস্যা হলো ভেন্ডি ভাজি নিশ্চয়ই তেলাপোকারা খাবেনা। দুপুরের খাবারটা তাদের বাদ পরে গেলো। চিলেকোঠার দরজা টা খোলা। ছাদে আনিশার কাপর শুকাতে দেওয়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। আজব তো! তাকে দেখতে মায়ের মত লাগছে কেন! শাড়ি পরার জন্য। আনিশা আজ শাড়িই বা পরেছে কেন? মায়ের গায়ের রং তো কালো ছিলো না তবে কেনো মায়ের মতো লাগছে।
মৃত মানুষের এই এক সুবিধা। যেমনটা জীবিত মানুষ নিরুদ্দেশ হয়। মৃত মানুষ কিন্তু কখনো জীবন থেকে নিরুদ্দেশ হয় না। তাদের আরেকজনের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা যায়। অনুভব করা যায়। সৃষ্টিকর্তা আমাদের ইহকালেও পরকালের কিছু সুখ ধার দিয়েছেন। আজ রাতে কাজটা সারতে হবে। যদিও হাতে কোনো সরঞ্জাম নেই। গলা টিপে মারার একটা প্ল্যান আছে। হ্যান্ড গ্লাভস পরতে হবে তাহলে। কিন্তু সেটা কিনার টাকা তো নেই। এখন আমি বসে আছি যারিশার সামনে। হালকা সেজেছে। আসার সময় সেই সাজ দেখেনি। কখন সাজলো মনে করতে পারছিনা। এই মেয়ের মধ্যে কিছু একটা আছে। এত দ্রুত কিভাবে কেউ কিছু করতে পারে।
- মুগ্ধ ভাইয়া, আজ আপনার জন্মদিন। - তুই কিভাবে জানলি? - গত বছর ভাইয়া আপনাকে একটা পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছিলো এই দিনে। - সেই হিসেবে আজ আমার জন্মদিন হবে তা তোকে কে বললো? - জানি না। ধরে নিয়েছি। এই নিন আপনার গিফট। - এর মধ্যে কি আছে? - আমার ফোন। নতুন ফোন কিনে দেওয়ার মত পরিস্থিতি আমার নেই সেটা জানেন। - তোর আমাকে দিলে তুই কিভাবে চলবি? - ল্যান্ড ফোন দিয়ে।
- তোর বন্ধুরা ফোন দিলে? - সিম চেঞ্জ করে দিয়েছি। - আমি ফোন দিয়ে কার সাথে কথা বলবো? - কারও সাথে না। পকেটে কিছু না থাকলে অস্তিত্বহীন মনে হয়। ফোনটা অস্তিত্ব রক্ষার্থে সাহায্য করবে। - তোর ভাইয়া বাসায় নেই। - নাহ, জানিও না কোথায়। -সমস্যা নেই। রাতে দেখা হবে। আজ আসি তাহলে। - আরেকটু বসুন। - তোকে সুন্দর লাগছে। হ্যান্ড গ্লাভস কিনবো। কিছু টাকা দিতে পারবি। আমি হেটে গেটের কাছে যাচ্ছি। পিছনে যারিশা দাঁড়িয়ে আছে বারান্দা দিয়ে। মনে হচ্ছে সে কাঁদছে। সুন্দর বললে কি কেউ কাঁদে?
রাত নয়টা। এই সময় রফিক জামান সাহেবের বাসায় যাওয়াটাকি উচিৎ।কাজটা যেহেতু হয়ে গেছে সেহেতু যাওয়া তো উচিৎ। মাথায় একটা গানের লাইন ভাসছে। সন্ধ্যায় চিলেকোঠায় থাকা অবস্থায় ছাদে মামা এসেছিলো। ছাদের একটা অংশে শ্যাওলা। সেখান থেকে শহরটা সুন্দর করে দেখা যায়। মামা সেখানে দাঁড়িয়ে শহর দেখছিলেন আর গান গাচ্ছিলেন। গানটা কি ছিলো! কোনোভাবেই মনে আসছে না। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা এখনো প্যাকেটে মোড়া। কি আজব! একটা কাগজের প্যাকেটে করে কেউ ফোন গিফট করে।
- হ্যালো যারিশা, বল। -ভাইয়া কিভাবে বুঝলেন আমি কল দিছি। - নতুন সিম। নাম্বার তুই ছাড়া অন্য কারো জানার প্রশ্নও আসেনা। - জাহিন ভাইয়াকে গত রাতে যে বেড়িয়েছে এখনো বাসায় ফেরেনি। আপনার সাথে দেখা হবার কথা ছিলো। আর যাইহোক ভাইয়া বাসায় না ফেরার মানুষ না। - তোর জন্য তো ভালোই হলো। - আপনি হয়তো জানেন না, আমার মা এই বাড়ির দ্বিতীয় বউ। এরপরও জাহিন ভাইয়া আমাকে অনেক আদর করে। একবার ক্লাস এইটে পড়ার সময় আমাদের ভূগল স্যার আমার বুকে হাত দেয়। সেটা আমি মাকে বলার সময় ভাইয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনে ফেলে। সেসময় ভাইয়া অনেক ছেলে-পেলে নিয়ে ঘুরতো কিন্তু সেদিন ভাইয়া একা যেয়ে স্যারকে মারে। মারার অপরাধে ভাইয়াকে আবার বাবা মারে। আমাদের বাড়ির সামনের লেবু গাছের শুকনো ডাল দিয়ে। ভাইয়ার রাতে জ¦র এসে পড়ে। রাত দুটায় হঠাৎ বাবা আমাকে ঘুম থেকে তুলে বসে লেবু দিয়ে চা বানা এক কাপ। সেই চা নিয়ে বাবা ভাইয়ার রুমে যায়। আমি দরজার কাছে দাঁড়ানো। ভাইয়াকে বাবা বললেন, “তুমি যা করেছ তা কি তুমি ঠিক মনে করো?” ভাইয়া কেঁদে কেঁদে উত্তর দিলো, “বোনের ইজ্জতটা ফিরে পেলে মনে করতাম যা করেছি ঠিক করেছি।”
- বুঝলাম, তুই কি কাঁদছিস? - আপনি একটা কথা ঠিক বলেছিলেন, আমি যেহেতু ভাইয়ার ডাইরি পড়েছি। ভাইয়াও আমার ডাইরি পড়তে পারে। - পড়েছে? - হুম, আমার ডাইরিতে আমি শুধু একটা কথা লিখেছিলাম। ভাইয়া সেই লেখার নিচে লিখেছে, “এই স্বপ্ন কখনো অপূর্ণ রাখিস না।” - তোরা দুই ভাইবোন দেখি প্রাইভেসির কিছুই জানিস না। - ভাইয়া, আপনার কি জানতে ইচ্ছে করছে না? স্বপ্ন টা কি ছিল? - না, মানুষের জিনিস কেন জানতে চাইব। - কারণ স্বপ্নটা আপনাকে নিয়ে। - তোর ফোনের ব্যালেন্স কি শেষ হচ্ছে না? - ভাইয়া আমার স্বপ্নটা ছিলো, আমাদের ছাদে আমি আপনাকে বিশ মিনিট জড়িয়ে ধরে রাখবো। বাতাসে আমার চুল উড়বে। সেই চুল আপনার মুখে পরবে। আপনার শুরশুরি লাগবে। তাও কিছু করতে পারবেন না কারণ আপনিও আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখবেন। একজন স্ত্রী হিসেবে। - বুঝলাম।
- আমি ভেবেছিলাম এই জিনিস পড়লে ভাইয়া আমাকে মেরে ফেলবে। আচ্ছা, জাহিন ভাইয়া তো ভালো আছে তাইনা! জানেন আগামীকাল জোছনা। ভাইয়া নিশ্চয়ই সেই নিতু নামের মেয়েটার সাথে জোছনা বিলাস করতে গিয়েছে। কিন্তু আমি জানি, ভাইইয়া আর কোনোদিন আসবে না। কারণ সে তার ডাইরিটা নিয়ে গেছে। আমি ফোনটা খট করে কেটে দিলাম। হ্যান্ড গ্লাভস কেনা হয়নি। টাকা পকেটে আছে। এক কাপ চা খেলে ভালো হতো। যেই রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে আছি সেই রাস্তায় শুধু একটা ল্যাম্পপোষ্ট। আমি সেই আলোতে নিজেকে দেখলাম। একটু আগে আমি একটি কাজ করেছি। অথচ আমার মধ্যে তার কোনো প্রমাণ নেই। ইসস, জামাটায় যদি একটু রক্ত লাগানো থাকতো। তাহলে মানুষদেরকে একটু ভয় দেখানো যেত। আচ্ছা ভয় তো এখনো দেখানো যায়। ঝটপট আমি আমার পরনের গেঞ্জিটা খুলে হাতে নিলাম। পুরো উদোম অবস্থায় হাতে গেঞ্জি পেঁচিয়ে সামনের একটা টং এর সামনে দাঁড়ালাম। কন্ঠটা একটু মোটা করে বললাম। - এই লাউলা, এক কাপ চা দে। মধ্যবয়স্ক দোকানদার বলে উঠলো, যা পাগলা, আজাইরা জালাইস না।
- স্যার, আমি উদোম দেখে কি আপনার অস্বস্তি হচ্ছে? - না, বরং ভালো লাগছে। যেই গরম। আমারো তোমার মত জামা খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে। - স্যার, আমি কাজটা সেড়েছি। - জানি, ডেমরার সাবেক কাউন্সিলরের লাশ তার বাড়ীর পুবপাশে পাওয়া গিয়েছে। ধরে নেওয়া হয়েছে তিনি ছাঁদ থেকে পিছলে পরে গেছেন। কারণ ছাদের একপাশে শ্যাওলা ছিলো। সেখানে তার চপলের পিছলে যাওয়া ছাপ রয়েছে। খবরে দেখাচ্ছে। তবে বলেছিলে তার মেয়ে রূপবতী। আমার কাছে কিন্তু সেরকম লাগেনি। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে সাংবাদিকদের বলছিলো বাড়িতে তারা চারজন থাকে। সে, তার বাবা, তার মা এবং গৃহকর্মী। তোমার কথা বলেনি কেনো বলতে পারো? - আনিশাকে এলাকায় সবাই অনেক ভালো জানে। যদি আমার কথা বলে তাহলে অনেক কথা রটবে। - তোমাকে সে সন্দেহ করেনি। সন্দেহ করলে নিশ্চয়ই মিডিয়ার সামনে তোমার কথা বলতো। - আমাকে মামা অনেক আদর করতো সুতরাং, এ কথা তারা চিন্তাও করবে না। - প্লাটফর্মটা ভালোই তৈরী হইয়েছিলো নয়ত খুনটা হয়ত করতে পারতে না।
- স্যার, খুনটা কেনো করেছি তা কি জানতে চান না? - না, কারণটা আমি জানি। তবে জানতাম না। খবর শুনে জানলাম। তুমি বলেছিলে তোমার মামা ছোটবেলায় তোমাদের সাথে থাকে। সাথে বলেছিলে সাত মাস তিনি তোমার সাথে ঘুমিয়েছে। একটা মানুষ তার অতীত বলার সময় এরকম সাধরণ একটা কথা কখনোই উল্লেখ্য করবেনা। যেহেতু তুমি উল্লেখ্য করেছো বুঝে নিতে হবে এটা সাধরণ কিছু না। তোমার মামা তোমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলো। সাত মাস ধরে তুমি তা সহ্য করেছো। সেটার থেকেই তোমাকে একটা দুঃস্বপ্ন প্রতিনিয়ত তোমাকে তাড়া করে। তাই তুমি খুনটা করেছ।
- স্যার, আপনার চেনা কোনো কাজী আছে? আমি কালকে বিয়ে করবো, দুপুরের আগে করতে হবে। কারণ যাকে বিয়ে করবো তার খুব ইচ্ছে আমাকে বিশ মিনিট ধরে জড়িয়ে ধরে রাখবে। দুপুরে রোদে তো এই কাজ সম্ভব না। সুতরাং, সন্ধ্যায় করতে হবে। পারবেন না স্যার? - কালকে করার ই বা দরকার কি? পরেও তো করতে পারো। - কাল তো জোছনা। সন্ধ্যায় সে যখন আমাকে জড়িয়ে ধরবে তখন জোছনার আলোতে তাকে দেখা যাবে। সেটা অন্য সময় নাও যেতে পারে। যে আমাকে জড়িয়ে ধরবে তাকে না দেখা গেলে ভালো লাগবে না ব্যাপারটা।
- তাহলে পরের জোছনার জন্য অপেক্ষা করো। - সেই জোছনার জন্য প্ল্যান রেডি। খাগড়াছরিতে হানিমুনে যাবো। সেখানে আমার বন্ধু জাহিন, যে আমাকে আপনার কাছে দিয়ে গিয়েছিলো সে নিতু নামে একটা মেয়ের সাথে জোছনা বিলাস করবে। তাদের খুজে পেতে একটু কষ্ট হবে। কিন্তু ভালো সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে। আচ্ছা, স্যার পাহাড়ী এলাকায় কি ডাব গাছ হয়?
- হতে পারে। তুমি কি আনিশাকে বিয়ে করবে? - জ্বী না, জাহিনের বোন যারিশাকে। - ওহ, তোমাকে সাহায্য করতে পারলাম না। আমার কোনো চেনা কাজী নেই। - তাহলে বিয়েটা বিকেলে করতে হবে। খুজতে খুজতে দুপুর হয়ে যাবে। যাই স্যার। রফিক জামান স্যার খুব স্বাভাবিক ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি কি বিশ্বাস করেছেন আমি মামাকে খুন করেছি। আচ্ছা আনিশাকি মামার চারিত্রিক সমস্যার কথা জানতো। হঠাৎ আমি হাঁটা থামালাম। আবার রফিক জামান স্যারের কাছে ফিরে এলাম।
- স্যার, আমি আসলে খুবই অসুস্থ একটি ছেলে। আমি কি সুস্থ হবো? - তুমি চাইলে অবশ্যই সুস্থ হবে। যারিশা নামের মেয়েটি তোমাকে সুস্থ করতে পারবে। - স্যার, এটা আপনার কেনো মনে হলো? - তার স্বপ্ন পূরণের জন্য তোমার আকাঙ্ক্ষা দেখে। - স্যার, আপনি কি আমাকে কিছু খাবার দিতে পারবেন। আমার পোষা তিনটি তেলাপোকা দুপুরে কিছু খায়নি। রাতে নিশ্চয়ই সেই বাসায় আজ রান্না হবে না। রাতে খাবার না পেলে বাবা এবং মা তেলাপোকা বেঁচে থাকলেও লালু মারা যাবে।
স্বাধীন বাংলা/এআর
|