মায়ের যখন ৩য় বিয়ে হয় তখন আমার বয়স ১৬ বছর। আমি আমার মাকে ছোট থেকেই খুব ভালবাসতাম, কিন্তু কেন জানি না মায়ের এই ৩য় বারের বিয়েটা আমি মেনে নিতে পারিনি। এই ৩য় বারের বিয়ের জন্য আমি মা কে খুব ঘৃণা করতাম। তবে সেটা মনে মনে, মুখে খুব কমই তার প্রতিফলন হতো। এই দুনিয়াতে মা আর রাসেদ ছাড়া আমার আর কোন আপন লোক নেই। যে লোকটার সাথে মা ৩য়,বার বিয়ে করেন তার নাম রাসেদ! কেন জানি না এই লোকটাকে আমার বাবা বলে ডাকতে ইচ্ছে করে না।
আমি যখন মায়ের পেটে তখন আমার ১ম বাবা নাকি মারা যান! যদিও আমি সবটা ঠিকঠাক জানি না, কি করে বাবা মারা গেলেন। তবে লোকমুখে শুনেছি বাবা আর মা নাকি ভালবেসে বিয়ে করেছিল। পুরো ৫ বছর সম্পর্কের পর তারা গোপনে বিয়ে করেছিল, কারণটা ছিল বাবা বেকার আর দরিদ্র পরিবারের ছেলে তাই আমার নানা-নানী কেউ মায়ের সম্পর্কটা মেনে নিতে পারেন নি। মা নানার একমাত্র মেয়ে খুব আদরের ,তাদের আর্থিক অবস্থাও খুব ভাল। তাই মা আর বাবা পালিয়ে বিয়ে করে।
বিয়ের ঠিক ১ বছর পর আমি মায়ের গর্ভে আসি। শুনেছি মা যখন ৩ মাসের অন্তঃস্বত্তা, বাবা তখন কোন একটা কাজে আমাদের একা ফেলে চলে যায়, তারপর আর কখনো ফিরে আসেন নি। এর ঠিক ৫ মাস পর নাকি মায়ের কাছে খবর আসে যে বাবা বেঁচে নেই, যদিও মা বাবার মুখটাও শেষ বারের মতো দেখতে পায় নি। লোকমুখে শুনেছি খবরটা নাকি মিথ্যা ছিল। আমি কিংবা মা কথাটার সত্য মিথ্যা কতোটুকু আজও খুঁজে পাই নি, আর না তো বাবা কখনো আমাদের খোঁজ নিয়েছে।
আমার যখন ৩ বছর বয়স তখন মা ২য় বারের মতো বিয়ে করেন। যদিও এই বিয়েটা মা আমার জন্যই করেছিল। আমার ২য় বাবার নাম জাহেদ। উনি আমাকে খুব ভালবাসত। ছোট থেকে আমি ওনাকেই বাবা ডেকেছি। মা তাই আমার সুখের জন্য তাকে বিয়ে করে। আমার এই বাবাটা খুব ভাল ছিল, আমার আর আমার মায়ের খুব খেয়াল রাখত। মায়ের মুখে শুনেছি তিনি নাকি আমি মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় মা কে অনেক সাহায্য করেছিল। মা খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেছিল। মায়ের যখন ১ম বিয়ে হয়, তখন মায়ের বয়স ১৭ বছর। আমাকে নিয়ে মায়ের কাজ করতে খুব কষ্ট হতো! তবুও জীবন বাঁচাতে মা ছোট্ট একটা চাকরি নেয়, তাতে আমাদের সংসার কোনরকম এ চলে যেত!
আমি নাকি ছোট বেলায় আমার ২য় বাবা কে, বাবা বলে ডাকতাম। সবচেয়ে বেশি শান্ত আমি তার কোলেই থাকতাম। আমাদের ছোট্ট সংসারটা ভালই চলছিল। আমার যখন ৫ বছর বয়স তখন আমার ছোট্ট একটা ভাই আসে। আমি তার নাম রেখেছিলাম ইফতি। ইভার ভাই ইফতি। কিন্তু আমাদের এই ছোট্ট পরিবারে এত সুখ বিধাতার সহ্য হয়নি। ইফতির যখন ৩ মাস বয়স তখন সে টাইফয়েডে মারা যায়!
ইফতির মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম আমি। আমার সেসব স্মৃতি খুব ভাল মনে নেই তবে ইফতির মুখটা আমার স্পষ্ট মনে আছে ওর সেই হাসিটা এখনো আমার চোখে ভাসে। ইফতিকে হারিয়ে পুরো পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এলো। হাসিখুসি ভরা পরিবারটা যেন মুহূর্তে কালো মেঘে ঢেকে গেল! ইফতির মৃত্যুর ঠিক ২ মাস পরে আমার ২য় বাবা ও একটা রাস্তা দূর্ঘটনায় মারা যান। বাবার মৃত্যুতে আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। বাবার লাশটার সামনে এসে শুধু বাবাকে বলেছিলাম, ‘আমার আর চকলেট লাগবে না, তুমি ওঠো’ কিন্তু বাবা আর উঠল না। বাবা ও আমাদের ছেড়ে ইফতির কাছে চলে গিয়েছিল। বাবার মৃত্যুর পর বকবক করে পাগল করা এই আমিটা হয়ে যাই নিস্তব্ধ। সেই থেকে আমি চুপচাপ স্বভাবের হয়ে যাই!
এরপর আমাদের সংসারটা মায়ের বাসা বাড়িতে কাজের টাকা দিয়ে কোনরকমে চলে যায়! কখনো ৩ বেলা বা কখনো ২ বেলা খেয়ে দিন কাটাতাম। বাবার রেখে যাওয়া শেষ সম্বলটুকোও হারিয়ে ফেললাম আমার পড়াশোনার খরচ বহন করতে গিয়ে। শেষ পর্যন্ত আমার পড়াশোনা বন্ধ হবার উপক্রম। মা কে একবার বলেছিলাম নানাকে জানাতে। মা না করে দিয়েছিল, ২য় বার আমি আর মা কে এ ব্যাপারে কিছু জিঙ্গেস করিনি। আমি যখন উচ্চ মাধ্যমিকে উঠব তখন ভর্তির টাকাটাও ছিল না। মা কে বললাম থাক আর পড়াশোনা করব না। মা বলেছিল তোকে আমার মতো হতভাগী হতে দেব না, দরকার হলে কিডনি বিক্রি করব। তবে মা কে তা করতে হয় নি, রাসেদ সাহেব মা কে আমার ভর্তির টাকাটা দেন। তা দিয়েই আমি ভর্তি হই।
অনেক টাকার মালিক রাসেদ সাহেব কেন জানি না মাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। রাসেদ সাহেবের কোন সন্তান নেই, স্ত্রী গত হয়েছেন ৩ বছর হলো। মা আমাকে এসে বলল, ‘রাসেদ সাহেব আমাকে বিয়ে করতে চায়, তোকেও মেয়ে বলে মেনে নেবে, কি করব?’ কথাটা বলতে গিয়ে মায়ের মুখটা লজ্জায় নিঁচু হয়ে গেল। আমি দেখলাম মায়ের, দু’গাল বেয়ে অঝরে পানি পড়ছে। আমি বললাম, ‘বিয়েটা করো’। মা আমার দিকে একবার তাকিয়ে দৌড়ে ঘরে গিয়ে দরজা দিয়ে দিল। আমি বাইরে থেকে মায়ের কান্নার আওয়াজ পেলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের কাজে চলে গেলাম।
৩য় বার বিয়ের পর আমি মাকে কখনো আমার সামনে মাথা উঁচু করে কথা বলতে দেখিনি। যদিও রাসেদ সাহেব আমাকে যথেষ্ট ভালবাসেন তবুও লোকটাকে বাবা বলে মেনে নিতে পারি নি। আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন মা আমার পায়ের কাছে এসে রোজ রাতে কাঁদে! আমি টের পাই কিন্তু কিছু বলিনা। আমি জানি মা এই বিয়েটা করেছে আমাকে ভাল রাখতে তবুও, না আমি আর না তো মা সুখে আছি। আমরা হয়তো ভাল আছি তবে সুখে নেই। রোজ রাতে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি, ‘সুখটা কি জিনিস? কোথায় থাকে? সবার জন্য কি সুখটা নয়?’ উত্তর মেলে না। এক বুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার চলে আসি একটু সুখের আশায়!