নিজস্ব প্রতিবেদক : পরিবেশের বিষয় বিবেচনায় বিশ্বে পাট পণ্যের চাহিদা নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। ফলে সম্প্রতি সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়া হলেও পাট ও পাটজাত দ্রব্য থেকে রফতানি আয় বেড়েই চলেছে। করোনা মহামারীর মধ্যে গত তিন মাসে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি আয়ে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই সময়ে পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি করে ৩০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার আয় করেছে দেশ।
বর্তমানে দেশে পাট চাষীর সংখ্যা ৪০ লাখ। আর পাটকে কেন্দ্র করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৪ কোটি মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। প্রতিবছর মৌসুমে পাট থেকে কৃষক গড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা পায়। দেশের জিডিপিতে পাট খাতের অবদান দশমিক ২৬ শতাংশ ও কৃষি জিডিপিতে তা ১ দশমিক ৪ শতাংশ। দেশে সাড়ে সাত থেকে আট লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। যেখানে কম বেশি ৮২ লাখ বেল পাটের আঁশ উৎপন্ন হয়ে থাকে। গত বছর দেশে ৬৮ লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়েছিল। ইপিবি, কৃষি বিভাগ এবং পাট খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি করে দেশ ৩০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার আয় করেছে। এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশের মতো বেশি এসেছে। গত অর্থবছরে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করে সঙ্কটে পড়া চামড়া খাতকে (৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার) পেছনে ফেলে তৈরি পোশাকের পরের স্থান দখল করে নিয়েছে পাট খাত। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছিল ১০২ কোটি ডলার। আর পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি করে ৮১ কোটি ৬২ লাখ ডলার আয় হয়েছিল। ওই হিসেবে এক বছরে চামড়ার রফতানি যতটা কমেছে, তার তুলনায় পাটের রফতানি বেড়েছে। তাছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে গত অর্থবছরে তৈরি পোশাকসহ বড় সব খাতের রফতানি আয়ে ধস নামলেও পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি আয়ে বরাবরই দেখা গেছে উল্টো চিত্র। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ২২ কোটি ৫১ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় কমেছে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অন্যদিকে এই তিন মাসে পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৩০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৯ দশমিক ২৬ শতাংশ।
সূত্র জানায়, সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হলেও পাট ও পাটজাত দ্রব্য থেকে রফতানি আয় বেড়েইে চলেছে। এই খাত থেকেই করোনা মহামারীর মধ্যে গত তিন মাসে রফতানি আয়ে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ ৯৮৯ কোটি ৬৮ লাখ ডলার আয় করেছে। এর মধ্যে ৩০ কোটি ৭৫ লাখ হাজার ডলার এসেছে পাট ও পাট পণ্য রফতানি থেকে। এই তিন মাসে পাটসুতা (জুট ইয়ার্ন) রফতানি হয়েছে ২১ কোটি ৮ লাখ ২ হাজার ডলারের; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৩ শতাংশ। কাঁচাপাট রফতানি হয়েছে ৪ কোটি ১১ লাখ ৫ হাজার ডলার; আয় বেড়েছে ২৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রফতানি হয়েছে ৩ কোটি ৫১ লাখ ৯ হাজার ডলারের। আয় বেড়েছে ৩৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
পাট ও পাটসুতা দিয়ে হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৩ কোটি ২৯ লাখ ২ হাজার ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ। তাছাড়া পাটের তৈরি অন্যান্য পণ্য রফতানি হয়েছে ২ কোটি ৩ লাখ ৯ হাজার ডলার। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ মোট ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করেছিল। ওই অঙ্ক ছিল আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি এসেছিল ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে পাটসুতা রফতানি থেকে ৫৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলার আয় হয়েছিল। অর্থাৎ মোট রফতানি ৬৪ শতাংশই পাটসুতা রফতানি থেকে এসেছিল। কাঁচাপাট রফতানি থেকে আয় হয়েছিল ১৩ কোটি ডলার। পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রফতানি হয়েছিল ১০ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের। তাছাড়া পাটের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য ১৯ কোটি ডলারের রফতানি হয়েছিল।
সূত্র আরো জানায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১১৬ কোটি ৭০ লাখ (১.১৬ বিলিয়ন) ডলার। তবে মহামারী না থাকলে এই লক্ষ্য গত অর্থবছরেই অর্জিত হতো। অর্থবছরের শেষ তিন মাসে করোনাভাইরাসের ধাক্কা না লাগলে গত অর্থবছরে এ খাতের রফতানি ২৫ শতাংশের মতো বেড়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মতো ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যেত। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাট ও পাটপণ্য রফতানি করে ১০২ কোটি (১.০২ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ওই একবারই এ খাতের রফতানি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল। তিন মাসের যে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরে এই খাত থেকে রফতানি আয় ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে অন্যান্য পণ্যের চাহিদা কমলেও পাটপণ্যের চাহিদা কমবে না। খাদ্যের জন্য ফসল ফলাতেই হবে, আর সেই ফসল মোড়কজাত বা বস্তাবন্দী করতে পাটের থলে লাগবেই।
এদিকে স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালে সোনালি আঁশে সমৃদ্ধ অর্থনীতির স্বপ্নে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠাকালে বিজেএমসির আওতায় ৭৬টি পাটকল ছিল। কিন্তু ধারাবাহিক লোকসানের কারণে মিলসংখ্যা কমতে কমতে ২৫-এসে ঠেকে। গত জুলাই মাসে পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। ওই পাটকলগুলোতে উৎপাদিত চট, বস্তা, থলে বিদেশে রফতানি হতো। বন্ধের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছরের মধ্যে ৪৪ বছরই লোকসানে ছিল বিজেএমসি। বর্তমানে সংস্থাটির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যদিও বেসরকারি খাতের অনেক পাটকল ঠিকই মুনাফা করতে পারছে।
বন্ধ ঘোষণার কারণ হিসেবে সরকারের পক্ষে বলা হয়েছে, দেশের পাট শিল্পকে আবার কীভাবে প্রতিযোগিতায় আনা যায় এবং কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, সে বিবেচনা থেকেই পাটকলগুলো বন্ধ করা হয়েছে। এর আগে বন্ধের বিষয়ে মত দিয়ে পাটকলগুলো দ্রুত চালুর বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গত জুলাই মাসে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) আওতাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫ পাটকলে উৎপাদন বন্ধ করে ২৪ হাজার ৮৮৬ স্থায়ী শ্রমিককে অবসরে পাঠানো হয়েছে।
অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, দেশে বেশি পাট উৎপাদন হয় ফরিদপুর, যশোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও জামালপুর জেলায়। তবে সবচেয়ে বেশি পাটের চাষ হয় ফরিদপুর জেলায়, সেখানে এবার ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। গত মৌসুমে হয়েছিল ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে। পাটনির্ভর ওই জেলায় ১৯টি পাটকল আছে। যার সবই বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার মধ্যে সচল রয়েছে ১৩টি। দেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি খাতের পাটকল করিম জুট মিল এই ফরিদপুরেই অবস্থিত। ইতোমধ্যেই ৭০ শতাংশ পাট কৃষক ঘরে তুলেছে। যাদের টাকার খুব প্রয়োজন তারা বিক্রি করে দিচ্ছে। আবার বেশি দামের আশায় অনেকে মজুদ করে রাখছে। ফরিদপুরের বিভিন্ন হাটে এবার প্রতিমণ ভাল মানের পাট আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
বেসরকারি খাতের পাটকলগুলোতেই দেশে উৎপাদিত পাটের ৫০-৫৫ লাখ বেল ব্যবহার হয়। স্থানীয় বাজার থেকে ফড়িয়া এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সারা বছরের পাট সংগ্রহ করে বেসরকারি খাতের মিলগুলো। তবে সরকারি পাটকলের মতো বড় গুদাম না থাকায় মৌসুমে তাদের পক্ষেপ্রয়োজনীয় পাট কেনা সম্ভব হয় না। সরকার চাইলে রফতানি করতে পারে। গত কয়েক বছরে পাট রফতানি বাড়েনি। বিগত ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখ বেল কাঁচাপাট রফতানি হতো। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮-৯ লাখ বেলে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর রফতানি হয় ৮ লাখ বেল। সদ্যসমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে আরো কমে তা ৬ লাখ ১৪ হাজার বেলে দাঁড়িয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিজেএমসির চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ জানান, প্রধানমন্ত্রী বন্ধ হওয়া পাটকল দ্রুত চালুর বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। ওই লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকার করিম জুট মিলসের ১ হাজার ৭৫৯ শ্রমিকের পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
একই প্রসঙ্গে বেসরকারী পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান জাহিদ মিয়া জানান, এখন শুধু বস্তা, চট ও থলে নয়, পাটসুতাসহ পাটের তৈরি নানা ধরনের পণ্য বাংলাদেশ থেকে রফতানি হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে পরিবেশের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসায় বিশ্বে পাট পণ্যের চাহিদা নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। এই সুযোগটি যদি নেয়া যায় তাহলে এ খাতের রফতানি অনেক বাড়বে; এই মহামারীর বছরেই পাটের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।