স্টাফ রিপোর্টার: শরীরে ভিটামিন নিয়ে রীতিমতো ফুলে-ফেঁপে উঠছে কোরবানির গরু। ঈদ বাজারে আর্থিকভাবে লাভবান হতেই গ্রামের গৃহস্থ থেকে শুরু করে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা আবারো ঝুঁকে পড়েছে এ পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণের দিকে। মুনাফার ধান্ধায় রুচির নাম করে অবলা এ পশুকে ফোলাতে পল্লী চিকিৎসকদের প্ররোচনায় খাওয়ানো হচ্ছে বিভিন্ন দেশীয় কোম্পানির হরেক রকমের ভিটামিন ইনজেকশন ও পাউডার। কোরবানির ঈদের আর মাত্র এক মাস বাকি থাকায় ময়মনসিংহের বিভিন্ন গ্রামে বিশেষ করে চরাঞ্চলে গরু মোটাতাজাকরণের এমন মহড়া চোখে পড়েছে। অবশ্য গরুকে স্বাস্থ্যবান করতে দু’নম্বরি পন্থায় ক্ষতিকারক স্টেরয়েড ইনজেকশন ব্যবহার করা হচ্ছে না বলে দাবি করেন গৃহস্থরা। একই রকম অভিমত দেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাও। তবে জেলায় কত সংখ্যক গরু মোটাতাজা করা হচ্ছে এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি। কোরবানির হাটে প্রতিবছর দেশি গরুর ব্যাপক চাহিদা থাকে। ফলে এ বাজার ধরতেই ছোট ঈদের পর থেকেই গরু মোটাতাজার কাজে নেমে পড়েন গৃহস্থ ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। কম দামে কম বয়সী গরু কিনে চড়া দামে বিক্রির টার্গেট নেন। প্রথম দিকে ভূষি, খৈল, ঘাস, আলু গবাদি পশুর খাবারের তালিকায় ঠাঁই পেলেও কোরবানি ঈদের আগেভাগে শুরু হয় ভিটামিন জাতীয় বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে গরুকে তরতাজা করা। শহরের গবাদি পশুর ওষুধের দোকানগুলোতেও এ সময় রেকর্ড পরিমাণ ওষুধ বিকিকিনি চলে। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর নিলক্ষীয়া ইউনিয়নের ভাটিপাড়া সরকার বাড়ি। এ গ্রামের বেশিরভাগ গৃহস্থ ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ গরু মোটাতাজাকরণের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই জড়িত। এ গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে প্রায় সবাই বছরজুড়ে গরু লালন-পালন করেন। কেউ কেউ কোরবানির হাটে তোলার আগে ওষুধ থেরাপির মাধ্যমে গরুকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলেন। কৃত্রিমভাবে গরু মোটাতাজা করার একই রকম চিত্র লক্ষ্য করা গেল সদরের চর ঈশ্বরদিয়া, গৌরীপুরের ভাঙনমারি ও ডেউয়াখলা ইউনিয়ন, ঈশ্বরগঞ্জের মরিচারচর ও ফুলপুরের বিভিন্ন গ্রামে। নিজের দু’টি ষাঁড় গরুকে স্বাস্থ্যবান করতে প্রতিদিন ভূষির সঙ্গে মিশিয়ে ক্ষুদ ও আলু খাওয়ান স্থানীয় ভাটিপাড়া সরকার বাড়ি এলাকার গৃহস্থ আবুল হাশেম (৪৫)। ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে তিনি দু’টি গরু বিক্রি করতে চান। কোরবানির ঈদের আর বেশিদিন না থাকায় দু’বেলা খাবারের সঙ্গে ২০ গ্রামের ডিজিটপ পাউডার মিশিয়ে খাওয়াচ্ছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ভিটামিন খাওয়ানির কারণে তাড়াতাড়ি গরু ফুলবো।’ ৩৫ হাজার টাকায় কোরবানির হাটে গরু বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্থানীয় গৃহস্থ এমদাদুল হক সরকার। তার ভাষ্যে, ‘গরুরে ফুলানোর লেইগ্যা এক মাস আগে থেইক্যা ভিটামিন খাওয়াতেই হয়। এতে গরুর রুম্বা ভালা থাহে। কাস্টমাররা এইরম গরু পছন্দ করেন। দামও ভালা পাওয়া যায়।’ গতবারের মতো এবারো স্থানীয় গৃহস্থদের কাছে গরু মোটাতাজা করতে ব্যাপক চাহিদা ‘বালতি’ হিসেবে পরিচিত ময়মনসিংহের আর.এন ফার্মাসিউটিক্যালস’র এক কেজি ওজনের এমোভিট জি’র। ভূষি এবং খৈলের সঙ্গে দু’চামচ করে এ পাউডার মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। এরকম তথ্য জানান একই গ্রামের তরুণ গৃহস্থ মাসুদ রানা ও আবদুল কাদির। মাসুদ রানা দাবি করেন, মাত্র এক মাস বালতি খাওয়াইতে হয়। এইড্যা ভিটামিন। ক্ষতিকারক কিছু না। পশু ডাক্তর দিছে। দামও কম। মাত্র আড়াইশ’ টাকা। এগুলো খাইলে গরুর মুখে রুচি বাড়ে, শরীরও বাড়ে। গৌরীপুরের ভাঙনামারী ইউনিয়নের হেলাল (৩৫) অভিন্ন সুরে বলেন, বালতি খাওয়াইলে গরুর গজের মাংস বাড়ে। সব কৃষকই এইড্যা ব্যবহার করে। ময়মনসিংহ সদর, গৌরীপুর, ফুলপুর ও ঈশ্বরগঞ্জের গরু মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একমি গ্রুপের এসল, টেকনো’র মেটাফস, রেনেটা গ্রুপের ট্রেসল, নোভার্টিস কোম্পানির মেগাভিট ডি, ময়মনসিংহের আর.এন ফার্মাসিউটিক্যালস’র এক কেজি ওজনের এমোভিট জি ও ডিজিটপসহ বিভিন্ন ইনজেকশন ও পাউডারের কদর বেশি। স’ানীয় পল্লী চিকিৎসক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘শতকরা ৬০ ভাগ চাষী গরু স্বাস্থ্যবান করতে দেশীয় বিভিন্ন কোম্পানির ইনজেকশন ও পাউডার ব্যবহার করেন। ভিটামিন জাতীয় এসব ওষুধে ক্ষতিকারক কিছু নেই। গ্রামের এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে তিনি ও তার ছেলে এসব ইনজেকশন গরুর শরীরে পুশ করেন। এসব বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শরাফত জামান বলেন, এবার গরু স্বাস্থ্যবান করতে ময়মনসিংহের কোথাও কোনো গৃহস্থ বা মৌসুমি ব্যবসায়ী ক্ষতিকারক স্টেরয়েড জাতীয় হরমোন ইনজেকশন ব্যবহার করছেন না। তারা ভিটামিন জাতীয় ইনজেকশন বা পাউডার ব্যবহার করছেন। এছাড়া গরুর ওষুধের দোকানগুলোতেও পাম বড়ি বা ক্ষতিকারক কোনো ওষুধ বিক্রির সুযোগ নেই। প্রতিটি উপজেলায় স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার নেতৃত্বে ৫ সদস্যের তদারকি টিম নিয়মিত বাড়ি বাড়ি গিয়ে এসব তদারকি করছেন- বলেন শরাফত জামান। মোটাতাজা গরু কিনতে জোর প্রস্তুতি শুরু করেছেন বেপারীরা। কোরবানির ঈদে মোটা অঙ্কের লাভ গুণতে অবৈধ পন্থায় মোটাতাজা করা এসব গরু কিনতে বেপারীরা ঝুঁকে পড়েছেন। সোমবার রাতে শহরতলি শম্ভুগঞ্জ বাজার এলাকায় আলাপ হয় কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর থেকে আসা কয়েক বেপারীর সঙ্গে। ফুলপুরের হাট থেকে মোটাতাজা ৫ টি গরু কিনে স্থানীয় হোসেনপুরের কলাদিয়া হাটে যাচ্ছেন বেপারী আবদুল লতিফ (৪৫) ও সাত্তার বেপারী (৩৫)। প্রায় দেড় লক্ষ টাকায় তারা এসব গরু কিনেছেন। ১৭ বছর যাবৎ তারা এ ব্যবসা করে আসছেন। মোটাতাজা গরুর দিকে ইঙ্গিত করলে লফিত বেপারী বলেন, ‘ভিটামিন করা ভালো না। দমের জিনিস যাইতে পারে গা। এরপরেও রিস্ক লইয়্যাই অনেকেই গরু ফুলায়। ফুলা গরু এক হাটে ঘুরলে পশম ধারাইয়া থাকবো। তহন বোঝা যায় ভিটামিন করছে।’ কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের নান্দানিয়া গ্রামের এ বেপারী আরো কয়েকজনকে নিয়ে ঈদের ১০ থেকে ১৫ দিন আগে আরো ২০ থেকে ২৫ টি গরু কিনে ঢাকা, সিলেটের হাটে নিয়ে যাবেন।’ তাদের কেনা গরুগুলোও ভিটামিন দিয়ে মোটাতাজা করা কী না এ প্রশ্ন করতেই তিনি এড়িয়ে যান। বলেন, ‘গত বছর অনেক ফুলা গরু বিক্রি হইছে। এইবার এ প্রবণতাটা একটু কম।’