গতকাল স্বাধীন বাংলাসহ বেশ কয়েকটি সহযোগী দৈনিক পত্রিকা, ফেসবুক এবং অন্যান্য ইলেকট্রোনিক প্রচার মাধ্যমে সরকারী প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিএ ভবনের সামনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদানের খবর ফলাও প্রচার পেয়েছে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধারা সুদীর্ঘ আটচল্লিশ বছর আগে তাদেরই আত্মত্যাগের এক ঐতিহাসিক নিদর্শন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থায়ী সংরক্ষণের দাবীতে সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে সমবেত হয়েছিলেন এ মানববন্ধনে।
খবরসূত্রে জানা যায়, ‘১৯৭১ সালের ৩০ অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসী নৌ-কমান্ডোরা দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করে চাঁদপুর নদীবন্দরে শত্রুবাহিনীর সমরাস্ত্র বোঝাই অপদখলীয় জাহাজ এম ভি ইকরাম সাফল্যের সাথে লিম্পেট মাইন বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত করেছিলেন। মুক্তিযুুদ্ধ শেষ হলে পর দেশের নৌ-নিরাপত্তার জন্য নৌ-কমান্ডোদের সুইসাইডাল অপারেশনে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, মোংলাসহ দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথের বিভিন্ন স্থানে বিধ্বস্ত জাহাজ, পন্টুন এবং অন্যান্য নৌ-স্থাপনা সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে উদ্ধার ও অপসারণ করা হলেও চাঁদপুর নৌবন্দরে ডুবে থাকা এম ভি ইকরাম উদ্ধারে ৩৭ বছরেও এগিয়ে আসেননি কেউ।
১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে নিমজ্জিত জাহাজটি ‘যেখানে যে অবস্থায় আছে’ ভিত্তিতে নিলাম ডাকে বিক্রী করেন এর মালিক বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক। অতঃপর ২০০৭ সাল পর্যন্ত জাহাজটির মালিকানা আরও পাঁচবার হাতবদল হলেও পানি-মাটির তলায় পড়ে থাকা জাহাজটি উদ্ধারে কেউ সফল হননি। ২০০৭ সালের শেষ দিকে এর মালিকানা শেষবারের মত হাতে পান নারায়ণগঞ্জ সোনাকান্দার একটি স্যালভেজ অপারেশন গ্রুপ। এ গ্রুপটি মাত্র এক বছরে বিপজ্জনকভাবে ডুবে থাকা বিধ্বস্ত জাহাজটি সাফল্যের সাথে উদ্ধার করে ২০০৮ সালের অক্টোবর মাসে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে আসেন।’
এ খবর জানাজানি হলে বীর মুক্তিযোদ্ধা- বিশেষ করে নৌ-কমান্ডোরা জাহাজটি মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণের দাবী তোলেন। জানা যায়, তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অবঃ) এম এ মতিন বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের এই দুর্লভ নিদর্শন সংরক্ষণে উদ্যোগী হন এবং বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর এক চিঠিতে নিদর্শনটি ‘পরবর্তী ফয়সালা’ পর্যন্ত সংরক্ষিত রাখার অনুরোধ করে উদ্ধারকারী গ্রুপকে। কিন্তু ওই পর্যন্তই শেষ, তারপর আর কেউ খবর নেননি এম ভি ইকরামের।
২০১৭ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে নতুন উদ্যোগ নেবার এক পর্যায়ে তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, এমপি নিদর্শনটি সংরক্ষণের দায়িত্ব নেন। প্রায় দুই বছরের চেষ্টায় তিনি উদ্ধারকারীদের জন্য অনুদান এবং সংরক্ষণের জন্য বাজেটে অর্থ সঙ্কুল করেন- যা গত মার্চ মাসে উত্তোলন করেছে বিআইডব্লিউটিএ। কিন্তু সে টাকা মালিকপক্ষকে পরিশোধ করা হয়নি; এমন কি- নিদর্শনটি সংরক্ষণের কোন উদ্যোগও দৃশ্যমান নয়। মুক্তিবাহিনীর দুনিয়া কাঁপানো নৌ-কমান্ডো অপারেশনের খুঁজে পাওয়া একমাত্র নিদর্শনটি শীতলক্ষ্যার পানিতে ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হতে থাকলে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে মুক্তিযোদ্ধা কমিউনিটিতেÑ যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গত মঙ্গলবারের স্মারকলিপি প্রদান ও মানববন্ধন আয়োজনের মধ্য দিয়ে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের উদ্ধারকৃত নিদর্শনটি একাত্তরে পাকিস্তানীদের পরাজয় নিশ্চিত করতে সুইসাইডাল অপারেশনে ডুবিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা- যা ছিল এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। জানা যায়, সুদীর্ঘ সাইত্রিশ বছর পানি-মাটির তলায় নিখোঁজ বিধ্বস্ত জাহাজটির বিস্ময়কর উদ্ধার ও সংরক্ষণ মিশনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা- সেটাও নিঃসন্দেহে আরেক যুদ্ধ। এখন স্থায়ী সংরক্ষণের জন্য অপেক্ষমান বিপদে পড়া এম ভি ইকরাম এবং এর ভূক্তভোগী উদ্ধারকারী মালিকদের সুদীর্ঘ এগার বছরের যন্ত্রণা অবসানেও দেখা যাচ্ছে মাঠে নামতে হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
সঙ্গত কারণে তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, এই বীর মুক্তিযোদ্ধারা যাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দের প্রত্যাশায় এদেশ স্বাধীন করেছিলেন- সেই সব সুবিধাভোগীদের কি তাহলে কোনই দায়িত্ব নেই? নিজেদের কীর্তি সংরক্ষণের দায়িত্বটিও কি তাহলে জাতির বীর সন্তানদেরই প্রতিপালন করতে হবে? আর তা নিয়ে সরকারী দফতরওয়ালারা যে ন্যাক্কারজনক অবহেলা, সময়ক্ষেপণ আর প্রতি পদে প্রতিবন্ধকতা রচনা করে সুদীর্ঘ এগারটি বছর অমাবিক যন্ত্রণায় বিদ্ধ করেছেন নিদর্শনটির সফল উদ্ধারকারী মালিকদের- তার কি কোন উত্তর চাওয়া যেতে পারে না? এক্ষেত্রে বিধিবিধানের প্রশ্ন উঠলে প্রয়োজনে নতুন বিধান তৈরী করতে হবে। কিন্তু বিধির অযুহাত তুলে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সুরক্ষা এবং তার অবিনাশী চেতনা উদ্দেশ্যমূলক ভাবে সংকুচিত, সীমায়িত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত করা যেতে পারে না। যেমনটি হয়েছে হতভাগ্য এম ভি ইকরাম এবং এর দুর্ভাগা উদ্ধারকারীদের বেলায়।
কথা আরও আছে। দেশের প্রতিটি জেলায়, উপজেলায় এবং দপ্তর-অধিদপ্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কত শত ‘কেস’ যে বছরের পর বছর অনিস্পন্ন অবস্থায় রয়েছে- কে তার হদিস করবে! কেবল মুক্তিযোদ্ধার কেস বলেই সেগুলো ফেলে রাখা হয়েছে সবার নীচে। কেন? যারা জীবন দিল- বুকের রক্ত ঢেলে তৈরী করলো নতুন জাতিরাষ্ট্র এবং তার গর্বিত ইতিহাসÑ তাদের কাজ কি এতটাই অ-দরকারী? আমরা মনে করি- এম ভি ইকরামই একমাত্র ইস্যু নয়, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যসব ইস্যু সমাধানের উদ্যোগও শীঘ্রই নেয়া দরকার। সরকারী সকল দপ্তরে কঠোর বার্তা দেয়া দরকার- যেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আইনানুগ কোন কাজ অযথা সময়ক্ষেপণের গোলকধাঁধাঁয় বিলম্বিত করা না হয়।
সুখের কথা, এম ভি ইকরাম সংরক্ষণের দাবীতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মানববন্ধনের খবর জেনে তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম মোজাম্মেল হক, এমপি। তিনি সেদিন বিকেলেই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কীত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি- নিদর্শনটি সংরক্ষণের প্রাণপুরুষ, সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, এমপি-কে সাথে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দায় রক্ষিত এম ভি ইকরাম পরিদর্শন করেন। এ ব্যাপারে অতিদ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহনের স্বার্থে তিনি পরিদর্শন টীমে আরও সঙ্গে নেন নৌপরিবহন এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তাদের।
এম ভি ইকরাম পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী এ নিদর্শন অবশ্যই যথাযোগ্য মর্যাদায় অতি শীঘ্র সংরক্ষণের কাজ শুরু করা হবে। জানা যায়, গোটা বিষয় অবহিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ভূক্তভোগী মালিকদের ফোন করে দীর্ঘ দুর্ভোগের জন্য তাদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। গণমানুষের কাতার থেকে উঠে আসা রাজনীতিক-মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত নিদর্শনটি সংরক্ষণের অবশিষ্ট কাজে উদ্যোগী হওয়ায় এবং দুর্দশাগ্রস্ত মালিকদের প্রতি তিনি যে সহমর্মিতার ঐদার্য দেখিয়েছেন- তাকে আন্তরিক সাধুবাদ জানাচ্ছি।
অনস্বীকার্য যে, এম ভি ইকরাম সাধারণ কোন যুদ্ধ-স্মারক নয়। একাত্তরে মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোদের দুনিয়া কাঁপানো নৌ-হামলাগুলোর সফলতা একেবারে বদলে দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের গোটা দৃশ্যপট। মুক্তিবাহিনীর সমর কুশলীদের কাছে পরাভূত হয়েছিল বর্বর পাকিস্তানী যুদ্ধবাজদের সমর-কৌশল। সে কারণে এম ভি ইকরাম হল বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয়ের ক্ষতচিহ্ন আর মুক্তিবাহিনীর বিজয় গৌরবের দূর্লভ স্মারক। মুক্তিবাহিনীর অকুতোভয় নৌ-কমান্ডোদের বিস্ময় জাগানো সেই নৌ-অপারেশনের খুঁজে পাওয়া একমাত্র নিদর্শন এম ভি ইকরাম। সে কারণে মুক্তিযুদ্ধের এ ঐতিহাসিক নিদর্শন জনবহুল কোন দর্শনীয় স্থানে উপযুক্ত মর্যাদায় সংরক্ষণ করার বিকল্প নেই। এ গণদাবীই গত পরশু ধ্বণিত-প্রতিধ্বণিত হয়েছে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কন্ঠে। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, মুক্তিযুদ্ধের সুবিস্তৃত সঠিক ইতিহাস জানে না বর্তমান প্রজন্ম। আমাদের ‘বিস্মৃতিপ্রবণ মনোবৃত্তি’র চোরাবালীতে হারিয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব করার মত অসংখ্য নিদর্শন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সে গৌরবগাথা ইতিহাস না জেনেই বড় হচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম; তাদের অন্তরে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে কিভাবে! এর সুচিন্তিত ও কার্যকর সমাধান অবশ্যই খুঁজে পেতে হবে। সুতরাং, আমরা বলতে চাই-মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী স্মারক এম ভি ইকরাম যেন অযত্ন-অবহেলায় হারিয়ে না যায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে নিদর্শনটির উদ্ধারকারী ভূক্তভোগী মালিকপক্ষও যেন বঞ্চিত না হন তাদের ন্যয্য পাওনা থেকে- সেটাও অবিলম্বে নিশ্চিত করতে হবে ন্যয়বিচারের স্বার্থেই। আর দায়িত্ব দেওয়া সত্ত্বেও এ কাজে যারা অবহেলা প্রদর্শন করেছেন তাদেরকেও খুঁজে বের করা দরকার- কেন এই ‘জাতীয় দায়িত’¡ প্রতিপালনে নিদারুণ গাফিলতি দেখানো হলো।