বর্তমানে আমরা নিজেদের উন্নত ও সভ্য সমাজের নাগরিক দাবি করি। সময়ের ব্যবধানে আমাদের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন হয়েছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, রুচিসহ সব কিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। স্বাধীনতা লাভের সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৮ কোটি হলেও বর্তমানে তা বেড়ে ১৮ কোটির অধিকে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে দেশের প্রথম জাতীয় বাজেটের পরিমাণ ৭৮৬ কোটি টাকা থাকলেও বর্তমানে তা বেড়ে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটিতে পরিণত হয়েছে। নব্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার সময় মাত্র ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও বর্তমানে পাবলিক ও বেসরকারী মিলিয়ে প্রায় তা দেড় শতাধিক! দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি সাধন হয়েছে; পরিবর্তন ঘটেনি শুধু আমাদের মনুষ্যত্বের। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের সময় বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য সাড়ে সাত কোটি কম্বল আনলাম। কিন্তু আমার কম্বল কই? সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেলাম চোরের খনি’। সত্যিই যেন তাই! স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও আমরা নৈতিকতার প্রশ্নে উর্ত্তীণ হতে পারিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নয়নের দিকে ধাবিত করছেন, তখন তিনিও একই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন যেমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন তার পিতা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্মুখীন হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর বারবার দূর্নীতি নামক কঠিন শিলায় বাংলাদেশের স্বাভাবিক অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্থ হয়েছে।
সারাবিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশ আজ চরম সংকটময় পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। করোনাভাইরাসে কাজ হারানো, অসহায়, দুঃস্থ হতদরিদ্রদের জন্য সরকার ত্রাণ সহায়তা পাঠাচ্ছে দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে। কিন্তু আমাদের দেশের কতিপয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নৈতিকতা এতটা নি¤œ থেকে নি¤œতর পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অসহায়, দুঃস্থদের ত্রাণ সামগ্রী পর্যন্ত আত্মসাৎ করে নিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কর্তৃক সরকারের স্বল্পমূল্যের চাল চুরির ঘটনা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। দুস্থ ও বিধবাদের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত নিয়মিত যে ভাতা আসে তাও গো-গ্রাস করেছেন অনেক ইউপি চেয়ারম্যান। এছাড়াও সরকার সমর্থক নাগরিক না হলে স্থানীয় নেতাদের থেকে ত্রাণসামগ্রী না পাবারও অভিযোগ উঠে এসেছে। আবার দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ সরকার দলীয় সংগঠনের স্থানীয় নেতাকর্মীদের দ্বারা ত্রাণ ছিনতাইয়েরও অভিযোগ প্রায়ই পত্রিকায় শোভা পাচ্ছে। স্বাধীন দেশে এমন দিনডাকাতি সরকারের ভাবমূর্তিকে চরম মাত্রায় ক্ষুন্ন করছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দূর্নীতিই যেন এখন সমাজের অনেক জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের মূলনীতিতে পরিণত হয়েছে।
স্বাধীনতার পর ৭৫ পরবর্তী সময় থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতির অবস্থা মোটেও স্থিতিশীল নয়। বারবার নোংরা রাজনীতির কাছে আমারদের হেরে যেতে হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজমান মনে হলেও মোটেও তা নয়। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা ও প্রায় দুই বছর দলীয়প্রধান কারাগারে থাকায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সাংগঠনিকভাবে নেতিয়ে পড়েছে। অন্যদিকে তাদের মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধপরাধের দায়ে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে ফাঁসির মঞ্চে বিদায় জানালেও তারা বসে নেই। তবে তারা সুযোগ পেলেই যে তারা ক্ষমতার লড়াইয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করবে সেটিও প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়। আমাদের দেশে রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য ক্ষমতার গদিতে আসীন হওয়া। এজন্য একটি প্রবাদ বলা হয়ে থাকে- বাংলাদেশের রাজনীতিতে যদি আয়ের উৎস না থাকত, তবে দেশের ৯০ শতাংশ রাজনীতিবিদ রাজনীতি ত্যাগ করতো।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বলা হয় আদর্শ নাগরিক তৈরির কারখানা। আর শিক্ষকরা আদর্শ নাগরিক তৈরির কারিগর হিসেবে পরিচিত হন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষকদের নৈতিকতার অবক্ষয় পুরো জাতিকে হতবাক করেছে। ভিকারুন নূন নিসা স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক পরিমল জয়ধরের উত্তরসূরী যেন চেপে বসেছে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি যেন ডাল ভাতে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়। বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার কেন্দ্রস্থল হলেও মুষ্টিমেয় শিক্ষক তা করছেন। কাঁচা টাকার গন্ধে সন্ধ্যাকালীন কোর্সের গভীর থেকে গভীরতর মনোযোগ দিচ্ছেন। অপরদিকে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বহু পুরাতন নোট-পত্র বিতরণ করেই নিজ দায়িত্ব শেষ করছেন।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন নায্য দাবি আদায়ে ছাত্ররাজনীতির প্রচলন হলেও তা নিতান্তই বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগঠনের স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে কিংবা দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রায়ই অস্ত্রের ঝংকারে কেঁপে উঠে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমানের অধিকাংশ ছাত্রনেতারা মাদক, ছিনতাই, টেন্ডার, চাঁদাবাজি, নারী কেলেঙ্কারীসহ বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িত। তারা যেন শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ এবং আবাসিক হলের স্বাভাবিক পরিবেশের হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার ধর্মীয় শিক্ষায় দীক্ষিত করে আদর্শ চরিত্রবান মানুষরূপে গড়ে তোলার ক্ষেত্র হচ্ছে মাদরাসাসমূহ। কিন্তু এখানেও নিরাপদ নয় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। প্রায়ই ঘটে যাওয়া মাদরাসার শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থী বলাৎকারের ঘটনাসমূহ সাধারণ মানুষের ধারণাকে ক্ষত বিক্ষত করেছে। আবার দাখিল, আলিম, ফাজিল, কামিলসহ বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষায় গ্রামাঞ্চলের প্রায় সকল মাদরাসা শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীদের নকল করতে সহযোগিতা করাও যেন অনেকটা সমাজস্বীকৃত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
দেশের মানুষের নীতি-নৈতিকতা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেও মাত্রাতিরিক্ত ধস নেমেছে। নরপশুদের লোলুপ কামনার শিকার হয়ে চলেছে শিশু ও নারী। বাংলাদেশ পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে ২০১৯ সালে দেশে ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা বা নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৫৪০০টি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৪১৩ জন নারী। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ধর্ষক কোন না কোন দিক দিয়ে সরকারদলীয় ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা আমাদের দেশের অপরাধমাত্রার অন্যতম কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মত দিচ্ছেন।
আমাদের দেশের ব্যবসায়ীসমাজও মাত্রাতিরিক্ত নীতিহীন। প্রতিবছর মুসলমানদের রোজা আসলেই বাড়তে থাকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য। এছাড়াও সিন্ডিকেট করে মাঝেমাঝেই চাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্য লাগামহীনভাবে বাড়ানো হয়। এতেই ক্ষান্ত হননা কেউ কেউ। খাদ্যে ভেজাল এখন আমাদের নিত্য সঙ্গী। গরীব-মিসকিনদের অধিকার কোরবানির পশুর চামড়া নিয়েও সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হতে হয়েছে দেশের মানুষকে। কিন্তু আমাদের দেশের অতীত ইতিহাস বলছে, এসব সিন্ডিকেটকারীরা অজানা কোন কারণে বিচারের আওতামুক্ত থেকে যায়। ফলে একই অপরাধ ঘটতে থাকে বারবার। জাতীয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর খাদ্যে ভেজাল ও বাজার তদারকির কাজ করে থাকলেও সেটি অপ্রতুল। লোকবল ঘাটতি এবং অদৃশ্য চাপের মুখে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনা সরকারি এই সংস্থাগুলো।
মাত্র কয়েক বছর আগেও ওয়াজ মাহফিল আমাদের দেশে উৎসবের আমাজের সৃষ্টি করতো। কিন্তু এখন ওয়াজ মাহফিল যেন বক্তাদের কাঁদা ছোড়াছুড়ি, ইসলামের নানা বিষয়ে নিজস্ব মনগড়া বক্তব্য দিয়ে অপব্যাখ্যার করা আর নারীর বিরুদ্ধে বিষেদাগার বক্তব্য প্রদানের স্থানে পরিণত হয়েছে। ওয়াজে কেউ আবার অবান্তর হাসি ঠাট্টায় মাতিয়ে ফেলছেন, দেখলে যেন মনে হবে এটি কোন কমেডি শো।
সরকারি অফিস সমূহের অবস্থা আরো করুণ। সেবা নিতে গিয়ে হয়রানি আর বিড়ম্বনার শিকার হননি এমন ব্যক্তিকে অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হবে। ঘুষ ছাড়া কোন কাজই যেন গতি পায় না। অন্যদিকে দেশের চাকুরী ব্যবস্থায় আর্থিক লেনদেন প্রায় সামাজিক স্বীকৃতি পেতে বসেছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন- আমরা যা বলি তা করিনা, যা করি তা বলিনা। তার এই উক্তি আজ বাস্তবে রূপ পেয়েছে। সমাজে আজ যে নেতা দিনের বেলায় বক্তৃতার মঞ্চে গরীব, দুঃখী, মেহনতি মানুষের জন্য গগন বিদারী আর্তনাদ করেন রাতের আঁধারে তিনিই ত্রাণ সামগ্রী এদিকে সেদিক করার পাঁয়তারা করেন। যে ছাত্রনেতা মাদক আর যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকেন, মিছিল শেষে একটু মাদক সেবন না করলে তার নিজেরই স্বস্তি মেলে না। রাতে নারীদের উত্ত্যক্ত না করলে তার ঘুম আসে না। এভাবে রাষ্ট্রের সর্বত্রই যেন অনিয়ম নিয়মে পরিণত হয়েছে। যতদিন আমাদের দেশের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার সুষ্ঠু পরিকল্পনা তৈরি করা না হবে, যতদিন সকল মতাদর্শের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জাতীয় ঐক্য গড়ে না তুলতে পারবেন, সমাজ বদলের জন্য নতুন স্লোগানের প্রচলন না করবেন, দেশ এক মরীচিকার পেছনে ছুটে চলবে। জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়বে, কিন্তু প্রকৃত মানুষ বাড়বে না; ফলস্বরূপ দেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়নও সম্ভব হবে না।
মোঃ আখতার হোসেন আজাদ শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ও সভাপতি বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।