পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাই একমাত্র ভাষা, যার স্বীকৃতী লাভের জন্য সংগ্রাম করেছে পুরো একটি জাতি। প্রাণপণে সর্বোচ্চ দিয়ে লড়ে গেছে আপামর জনতা, অকালে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে টকবগে যুবক থেকে থুরথুরে বৃদ্ধ পর্যন্ত, হাসিমুখে শাহাদাত বরণ করেছে অগণিত মানুষ। একমাত্র বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠা সংগ্রাম জন্ম দিয়েছে একটি স্বাধীন-স্বার্বভৌম দেশ। বাঙালি মুসলমানদের দুটি বড় অহংকারের জায়গা রয়েছে, একটি তার দেশ, অন্যটি ভাষা।
বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে মোটামুটিভাবে দশম-একাদশ শতকে। সুনীতিকুমার, ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ ভাষাতাত্ত্বিক বাংলা ভাষার যে বংশাবলী নির্মাণ করেছেন তাতে দেখা গেছে, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাই কালের বিবর্তনে বাংলা ভাষায় রূপ নিয়েছে। পন্ডিতদের মতে, বাংলা ভাষার প্রাচীন রূপ দেখতে পাওয়া যায় বৌদ্ধ মরমি সাধকদের রচিত বৌদ্ধ গান ও দোহার মধ্যে। সেসময় বাংলা ভাষা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার আমলে ছিল কিন্তু সে আমল দীর্ঘদিন স্থায়িত্ব লাভ করতে পারেনি। একাদশ শতকে পালদের পরাজিত করে সেন রাজত্ব উঠে আসে এবং বাংলার পরিবর্তে সংস্কৃত ভাষা রাজভাষা হিসেবে কায়েম হয়। সাথে সাথে সমস্ত কাজকর্মে একদিকে যেমন সংস্কৃতের জয়গান উঠে আসে অপরদিকে বাংলা ব্যবহারে নিরুৎসাহিতার রূপ ফুটে ওঠে। রাজপুরুষদের চাপে পড়ে ব্রাক্ষণ পন্ডিতরা ফতোয়া জারি করলেন: “অষ্টাদশ পরাণাননি রাম্যস্যস চবিতনিচু/ভষায়ং মানং শ্রুত রৌরবং নরক ব্রজেং”। অর্থাৎ, অষ্টাদশ পুরাণ ও রামায়ণ যে মানব রচিত বাংলা ভাষায় শ্রবণ করবে, সে রৌরব নরকে নিক্ষিপ্ত হবে।
১২০৩ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে এ অঞ্চলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠত হয়। এতে উপমহাদেশে নতুন আলোর মিনারের সূচনা ঘটে। যার প্রভাবে একদিকে যেমন জাতিভেদ-লাঞ্ছিত বাংলার সমাজদেহে নীরব বিপ্লব দেখা দেয় অপরদিকে বিলীন হওয়া বাংলা ভাষা চর্চাতে নয়াদিগন্তের বিপ্লব ঘটে। এ সম্বন্ধে বিখ্যাত গবেষক ড. দীনেশচন্দ্র সেন বলেন: “হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর অপেক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা খনির মধ্যে থাকিয়া যেরূপ ডুবরীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বাংলা ভাষা তেমনি কোন শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনায়ন করিল”। মুসলিম শাসনামলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার লালনে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের অনুরাগী সাহিত্যসেবকগণ রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্টপোষকতা লাভ করেন। মুসলিম শাসনের পতন যুগে উত্তর ভারতের মুসলিম শিক্ষিত সমাজের উদ্যোগে আরবি হরফ, আরবি-ফারসি শব্দভান্ডারে এবং হিন্দি উচ্চারণকে কেন্দ্র করে ‘উর্দু’ নামে একটি ভাষার জন্ম হয় এবং অল্পদিনের মধ্যেই তা উত্তর ভারতের সংস্কৃতিবহুল হিন্দুদের ব্যবহৃত হিন্দি ভাষার মুসলিম বিকল্প হিসেবে দাঁড়ায়।
১৭৫৭ সালে পলাশী বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত ঘটে যায়। উনিশ শতকের শুরুর দিকে ইংরেজ শাসকরা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা থেকে মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত আরবি-ফারসি শব্দ বাদ দিয়ে সংস্কৃত কণ্টকিত অভিনব বাংলা ভাষা গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালালে সেসময়কার মীর মোশারফ হোসেন, শেখ আব্দুর রহিম, মহাকবি কায়কোবাদসহ প্রমুখ মুসলিম কবি-সাহিত্যকগণ তা প্রতিহত করতে সক্ষম হন।
বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ-ভারতে স্বাধীনতা-আন্দোলন ধীরে ধীরে সাফল্যমন্ডিত ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকলে নতুন করে বাংলা ভাষার ভাবিষৎ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন কংগ্রেস নেতা এম.কে.গান্ধী রবী ঠাকুর কে ভারতবর্ষ স্বাধীনের পর সাধারণ ভাষা কী হতে পারে তা জানতে চাইলে তিনি হিন্দির পক্ষে অভিমত জ্ঞাপন করেন। ১৯৭১ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন এ বিষয়ে আবার আলাপ-আলোচনা শুরু করেন ঠিক সময় ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন, ভারতবর্ষে বাংলা, উর্দু ও হিন্দি সাধারণ ভাষা হওয়ার যোগ্যতা রাখে। এরই উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সুস্পষ্টরূপে বলে দেন, “ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে যে ভাষাই হোক না কেন, বাংলাদেশে বাংলা ভাষাই হবে সরকারি ভাষা’।
ইতিহাস পর্যালোচনার করে আমরা স্পষ্টাক্ষরভাবে জানতে ও বুঝতে পারি বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠায় মুসলিমদের অবদান কতখানি। বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠায় মুসলমান সমাজ যেভাবে অকাতরে পরিশ্রম ও যুদ্ধ করে গেছে তার তিনটি পয়েন্ট উল্লেখ করলেই জাজ্বল্যমান মুখপ্রান্ত সত্য সবার নিকটে উঠে আসবে। প্রথমত, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ থেকে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সেদিন বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবির সুউচ্চ দীপ্ত কন্ঠে উথাপিত হলেও হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাকে ভারতের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার কোন দাবি উত্থাপিত হয়নি। দ্বিতীয়ত, বাহান্নর ফ্রেবুয়ারিতে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে যে তরুণেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে এ আন্দোলন বেগবান, গতিশীল এবং পাকাপোক্ত ভিত্তির উপরে দাঁড় করিয়েছিলেন তাদের সবাই ছিল মুসলিম। তৃতীয়ত, ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে আটচল্লিস ও বাহান্নের মধ্যে দিয়ে ছাপ্পান পর্যন্ত পদার্পণে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় না হওয়া পর্যন্ত প্রধানত পূর্ববঙ্গের তরুণ মুসলিম সমাজ-ই এই নেতৃত্ব দান করেন।
বাংলা ভাষার শৈশব, কৈশোরে এই ভাষার স্নেহ, লালন এবং উন্নয়নে যেরূপ এই মুসলিম অধ্যুষিত তরুণ সমাজ চোখধাঁধানো অবদান রেখেছিল ঠিক একইভাবে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভের সংগ্রামেও একই ভূমিকা মুসলিম তরুণরাই পালন করে। বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বুকের তাঁজা রক্ত ঢাকার রাজপথে বিলিয়ে দিয়েছে তাঁরা সবাই ছিলেন মুসলিম তরুণ। সর্বোপরি বলা যায়, বাংলা ভাষার শিশু বয়স হতে আজ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্র বেগবান, গতিশীল, লালন এবং উন্নয়নে রয়েছে মুসলমানদের গৌরবজনক অবদান।
সূত্র- বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মুসলমান(অধ্যাপক আবদুল গফুর), শুবাচ (ড.হায়াৎ মামুদ, ড.মোহাম্মদ আমীন), ইন্টারনেট। মোহম্মদ শাহিন শিক্ষার্থী, সুলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়।