আরবদের সাথে ইসরায়েলের দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়; বেশ পুরনো। বিংশশতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত বেশ কয়েকটা বড়সড় যুদ্ধও হয়েছে। ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ মানুষের প্রাণ কেঁড়ে নেয় এবং প্রকৃতিকে সর্বস্বান্ত করলেও দীর্ঘমেয়াদি একটা সমাধান দিয়ে যায়। উভয় পক্ষই শান্তি আলোচনা করে কিংবা চুক্তি স্বাক্ষর করে। যাতে বার বার যুদ্ধের দামামা না বেজে ওঠে। ইতিহাসের বড় বড় যুদ্ধগুলোর দিকে তাকালে আমরা সেই প্রমাণই দেখতে পাই। পৃথিবীর ইতিহাসে দুটি বিশ্বযুদ্ধও কিন্তু শেষ হয়েছে—শান্তির সমাধান দিয়ে। কিন্তু আরব-ইসরায়েলের যুদ্ধগুলো বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে শেষ হলেও তাদের বিরোধ এখনও বিরাজমান।
যাযাবর ইহুদিদের দীর্ঘদিনের লক্ষ্য ছিল জেরুজালেমে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তাদের জায়োন আন্দোলনের জোরালো ভূমিকায় ১৯৪৮ সালে তা বাস্তবতার মুখ দেখে। বস্তুত, ব্রিটেনের তৎকালীন (১৯১৭) পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর বিষয়টি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রথসচাইল্ডকে। তৎকালীন ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সে চিঠি ইতিহাসে ‘বেলফোর ডিক্লারেশন’ হিসেবে পরিচিত। অস্ট্রিয়ার ইহুদী সাংবাদিক ও জায়োন আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ থিয়োডর হার্জেলের ষড়যন্ত্রমূলক প্রচেষ্টা ইসরায়েলে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পিছনে বেশ ইন্ধন জোগায়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বনেতৃবৃন্দের সহানুভূতি কুঁড়িয়ে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের ভূমি দখলের নোংরা খেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। শুরু হয় ফিলিস্তিনি ভূমি গ্রাসের অবৈধ প্রতিযোগিতা। যার প্রলয়লীলা আজও চলছে। পশ্চিমা বিশ্বের মদদপুষ্ট হয়ে দিনের পর দিন ইসরায়েল তার ষড়যন্ত্রমূলক সব কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বেশিরভাগ কাজেই আন্তর্জাতিক আইনের নিয়মিত লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। এমনকি জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাকেও কোন তোয়াক্কা করছে না। আমেরিকা শুধু মদদ দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না ইসরায়েলর অবৈধসব কার্যক্রমকেও প্রত্যক্ষ সমর্থনও দিয়ে যাচ্ছে। মধ্যস্থতার নামে একতরফা এ রকম সব সিদ্ধান্ত দিয়ে যাচ্ছে।
২০১৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিসংঘ, আরব ও মুসলমান-অধ্যুষিত দেশ, এমনকি মার্কিন মিত্রদের আপত্তি উপেক্ষা করে পবিত্র জেরুজালেম শহরকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এবং খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে তেল আবিব থেকে তাদের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করেন। বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝর ওঠলেও তারা তাতে কোন কর্ণপাতই করেননি। চলতি বছরের শুরুর দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিচুক্তির নামে আরও একটি নাটক মঞ্চায়িত করেছেন। ফিলিস্তিনিদের প্রবল বিরোধিতা উপেক্ষা করে ‘ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি’র নামে প্রহসনমূলক একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন ট্রাম্প। ইহুদী ঘেঁষা তথাকথিত শান্তিচুক্তিতে ফিলিস্তিনিদের অধিকার হরণ করা হয়েছে। মার্কিন-ইহুদিবাদী এই পরিকল্পনায় ঐতিহাসিক জেরুজালেমর আল-কুদস শহরকে ইসরাইলি ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেইসাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত ফিলিস্তিনি শরণার্থীদেরকে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া, জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের অবশিষ্ট অংশ ও গাজা উপত্যকা নিয়ে একটি দুর্বল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছে। বস্তুত, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ইহুদিরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের মাধ্যমে তাদের দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রমূলক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলছে। তাদের এই ষড়যন্ত্রের ইতি কবে ঘটবে তা ভাবনার বাইরে।
সম্প্রতি ইসরায়েলে লিকুদ পার্টির প্রধান বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট পার্টির প্রধান জেনারেল বেনি গান্তজ নতুন কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। চু্ক্িত অনুসারে নেতানিয়াহু ১৮ মাস ক্ষমতায় থাকবেন। কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত ১৭ এপ্রিল এক টেলিভিশন ভাষণে ‘অল্প কয়েক মাসের মধ্যে’ পশ্চিম তীরের ‘অবৈধ ইহুদি বসতি’ জোরপূর্বক ইসরায়েলের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার ঘোষণা দেন। পরক্ষণেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থন লুফে নেন। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে পশ্চিম তীর দখলের হুঙ্কার দেন এই যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী। বলেন, বড় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই নতুন করে ফিলিস্তিনের জর্দান নদীসংলগ্ন প্রায় দুই হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করবেন। নেতানিয়াহু যে এলাকাটি দখল করার ঘোষণা দিয়েছিলেন—সেটাকে ফিলিস্তিনিদের ‘খাদ্য বাস্কেট’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, পশ্চিম তীরের উৎপাদিত সবজির প্রায় ৬০ শতাংশই ওই এলাকায় উৎপাদিত হয়। ইসরায়েল কয়েকদিন আগে তাদের বিদ্বেষী চরিত্রের আরো একটি নগ্নরূপ প্রকাশ করেছে। এতদিন তো বসৎ বাড়ি, মসজিদ, পর্যটন কেন্দ্র দখল করেছে—কিন্তু এবার কবর স্থানও দখলে নিয়েছে। ফিলিস্তিনের বন্দর নগরী জাফার প্রাচীন একটি কবরস্থান গুঁড়িয়ে গত ১৫ জুন সেখানে বসতি স্থাপন করেছে ইসরাইল। ১৫ জুন সকালে কবরস্থানটি দখলদার ইসরাইল বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। শত শত কবর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়! এটা কোন ধরণের বর্ববরতা?
ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনি ভূমি পশ্চিম তীর ও জর্ডান সীমান্ত পর্যন্ত অংশ দখলের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। গত সপ্তাহের সুরক্ষা কাউন্সিলের ভার্চুয়াল বৈঠকের বক্তব্যে গুতেরেস বলেন, ‘ফিলিস্তিনের ভূমি ইসরায়েলের দখলের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত হবে। আমি ইসরায়েলি সরকারের প্রতি ফিলিস্তিনি ভূমি দখলের পরিকল্পনা বাতিল করার আহ্বান জানাচ্ছি। আর তারা যদি সেটা করে তাহলে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের সম্ভাবনা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। ফিলিস্তিনসহ আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে সমঝোতার বিষয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সেটি হুমকির মুখে পড়বে।’ কিন্তু ইসরায়েল এই আহ্বানে সাড়া দিবে কি? জাতিসংঘ থেকে এরূপ আহ্বান অতীতেও এসেছিল। কিন্তু তারা সে আহ্বানে সাড়া না দিয়ে একের পর এক ভূমি দখলের অবৈধ পদক্ষেপ নিয়েছে এবং নিচ্ছে। যে পদক্ষেপগুলো আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সম্প্রসারণবাদী ইহুদীরা ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই ধারণা লালন করে ফিলিস্তিনকে সংকুচিত করে ইসরায়েলকে প্রশস্ত করে তুলেছে। তাদের অবৈধ সম্প্রসারণবাদ বাস্তবায়নের পেছনে রয়েছে তাদের চিরাচরিত উগ্রবাদ। ফিলিস্তিনের জনগণের সুখ কেড়ে নিয়েছে এই উগ্রবাদী ইসরায়েল সরকার। কখন কোন স্থানে বিমান হামলা চালায়, সেনাবাহিনী এসে ধরে নিয়ে যায় সেই অসুখকর চিন্তা পাকড়াও করে বেড়ায় ফিলিস্তিনের প্রতিটি নাগরিককে। মাঝে মধ্যে কয়েকটি স্থানে ফিলিস্তিনিদের চলাচলের উপর বিধিনিষেধও আরোপ করে ইসরায়েল।
বিবিসির তথ্যমতে, ইসরায়েল প্রতি বছর ৫০০ ফিলিস্তিনি তরুণকে ধরে নিয়ে যায়। যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ইউনিসেফ জানায়, পশ্চিম তীরে এমন নিষ্ঠুর ঘটনা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। পৃথিবীতে ইসরায়েল একমাত্র দেশ, যারা সামরিক আদালতের মাধ্যমে কিশোরদের বিচার করে। যাদের বয়স ১৮ হয়নি। নিজেদের দেশে নিজেরা স্বাধীনভাবে চলতে পারে না। নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে থাকতে হয়। যুগের পর যুগ ইসরায়েলি আগ্রাসন যদি এভাবে চলতে থাকে তবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রটির ভূখণ্ড টিকবে কি? কিংবা ফিলিস্তিন বলে কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকবে কি? ভূমি-ক্ষুধার্ত ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড গ্রাস করে উদরসাৎ করে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন করতে পাঁয়তারা করছে।
১৯৪৮ সালের মানচিত্র ও বর্তমান মানচিত্রের দিকে দৃষ্টি দিলে খুব সহজেই ইসরায়েলি দখলদারিত্বের নগ্নরূপ দেখতে পাই। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রটিকে বাঁচাতে এবং মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশ্ব নেতাদের এখনই এগিয়ে আসা প্রয়োজন। অন্যথায়, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রটি একসময় প্রাচীন রোম নগরীর মত ইতিহাস হয়ে যাবে। শুধু নিন্দা জ্ঞাপন ও ফিলিস্তিনি শান্তিকামী সংগঠন হামাস, পিএলও’র লড়াইয়ে সমর্থন দিলে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের অবসান ঘটবে না। ওআইসি, আরব লীগ ও জাতিসংঘ একত্র হয়ে উদ্যোগ নিলে ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্ব রক্ষা পাবে। শুধু এরদোয়ান কিংবা ইমরানখান সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিলে ইসরায়েলের একঘেঁয়েমি বন্ধ হবে না। প্রশ্ন থেকে যায় যে, ইসরায়েলের পরম মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে ইসরায়েলের স্বার্থ হানি হয় এমন বিলে কি ভেটো প্রদান করবে না? হ্যাঁ, ভেটো দেওয়ার সম্ভাবনা অনেক। কারণ ভেটো না দিলে তো তাদের কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র ব্যবসায় ধস নামবে! তবুও অনেকগুলো দেশ, সংগঠন এবং বাঘা বাঘা নেতৃত্ববৃন্দ মিলে যৌথ উদ্যোগ নিলে তা সফল হওয়ার সম্ভাবনাও কিন্তু ঢের। আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের জন্য ইসরায়েলের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় আনলে অন্তত নমনীয় হতে বাধ্য হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিকে যে ভাবে বশে আনা হয়েছিল সেই পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে ইহুদীবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের ব্যাপারেও। কারণ, ইসরায়েল শুধু ফিলিস্তিনের সাথেই দ্বন্দ্বে জড়ায়নি; ইসরায়েলের সীমান্ত ঘেঁষা সিরিয়া, জর্ডান, মিশর, লেনাননসহ কয়েকটি দেশের দেশের সাথেই বিরোধ রয়েছে। ইসরায়েলি দখলদারিত্বের সমাপ্তি টানতে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে জাতিসংঘের নেতৃত্বে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের জন্য ভূমি নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিৎ। নিজেদের সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষেরও তা মেনে নেওয়াটা সমীচীন হবে। অন্যথায়, বছরের পর বছর ইসরায়েল অবৈধভাবে শুধু দাবি করেই যাবে। হবে হামলা ও পাল্টা হামলা। দ্বন্দ্বেরও অবসান হবে না। পুরো পৃথিবী এক মেরুতে আর ইসরায়েল অন্য মেরুতে। তবুও তাদের অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারা পুরো পৃথিবীর জন্য ব্যর্থতাও বটে। ব্যর্থতার গ্লানি মুছে পৃথিবীর শান্তিকামী রাষ্ট্র, মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ রক্ষায় তৎপর এমন সংগঠন ও মানবতাবাদী সংগঠনগুলো ইসরায়েলি আগ্রাসন রুখে ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারবে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।
সাইফুল ইসলাম হাফিজ শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়