পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয় সমুদ্রকে। সমুদ্রের তলদেশের ভূপ্রকৃতি বৈচিত্র্যময় এবং প্রাণ প্রাচুর্যের অমিত সম্ভাবনাময় ভরপুর এক জগৎ। বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় বিষয়টির প্রথম ধারণা দেন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক, অধ্যাপক গুন্টার পাউলি। ২০১০ সালে জাতিসংঘের আমন্ত্রণে পরিবেশ-বান্ধব টেকসই অর্থনৈতিক রুপরেখা প্রণয়নের ধারণাটি প্রকাশ পায় তার বক্তব্যে।
সমুদ্রের জলরাশি, সমুদ্র সম্পদ ও সমুদ্রকে ঘিরে গড়ে উঠা অর্থনীতিকে বলে ব্লু-ইকোনমি। ব্লু-ইকোনমি বলতে বোঝায়, সমুদ্রের রং নীল। আর সেকারণেই সমুদ্রকেন্দ্রিক যে অর্থনীতি তাকে সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু-ইকোনমি বলে। সুনীল অর্থনীতির মূল উপাদানগুলো হচ্ছে খনিজ সম্পদ, পানি সম্পদ, পরিবহন সেবা, জ্বালানি সম্পদ, পর্যটন শিল্প ইত্যাদি। এগুলোর পরিকল্পিত ব্যবহার এবং টেকসই উন্নয়নে সমুদ্রের অর্থনীতির সুবিশাল সম্ভাবনা বয়ে আনবে। বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর মতো বাংলাদেশও তার সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পারবে।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ঐতিহাসিক সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ-মিয়ানমার ও ভারতের সাথে বঙ্গোপসাগরের সীমানা বিরোধ নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে ২০১২ সালের ১৪মার্চ তারিখে ১,১৮,১৮৩ বর্গকিলোমিটার এলাকার জলসীমায় নিরস্কুশ কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সমুদ্রের তলদেশের ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সব ধরণের সম্পদের পূর্ণ অধিকার পেয়েছে। আমাদের দেশের দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরে যে খনিজ সম্পদ রয়েছে তা পৃথিবীর অন্যকোনো সাগর বা উপসাগরে নেই এবং বলা হয়ে থাকে যে, বঙ্গোপসাগর যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ তার হাতে থাকবে। এইজন্য পরাশক্তিগুলো বঙ্গোপসাগরকে দখল করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
বিশ্বে বর্তমানে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি। ২০৫০ সালের পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯৫০ কোটি। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের যোগান দিতে বাধ্য হয়েই সমুদ্র সম্পদের দিকে ঝুঁকতে হবে। বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো সমুদ্র সম্পদকে ইতিমধ্যে কাজে লাগাচ্ছে এবং তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করছে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির ৯০ ভাগ সমুদ্রনির্ভর এবং সে দেশের সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ ইতিমধ্যে নিয়েছে যে, তারা যদি সফল বাস্তবায়ন হয় সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদের মূল্য বাজেটের ১০গুণ হবে। অস্ট্রেলিয়া তাদের সমুদ্র সম্পদ থেকে বর্তমানে ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদের আঁধার বঙ্গোপসাগরে সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু-ইকোনমির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কেমন, বাংলাদেশ কীভাবে ব্লু-ইকোনমির মাধ্যমে কর্মসংস্থান করতে পারবে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি কেমন হবে??
বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে গিরিখাতের মতো একটি অঞ্চল রয়েছে, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭ কিলোমিটার এবং এটি মাছের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। বঙ্গোপসাগরে ৪৫০ প্রজাতির মাছ, ৩৩৬ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ৭ প্রজাতির কচ্ছপ, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ১০ প্রজাতির ডলফিন, ৫ প্রজাতির লবস্টার রয়েছে। এদের মধ্যে শামুক, ঝিমুক, শ্যালফিস, কাঁকড়া, অক্টোপাস, হাঙ্গরের অর্থনৈতিক চাহিদা রয়েছে এবং বিভিন্ন দেশে এগুলো খাদ্য হিসেবে ব্যাপক বিবেচিত হয়। এছাড়াও রয়েছে সামুদ্রিক আগাছা, লতা, গুল্ম। বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক আগাছা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরি করা হয় এবং এসব আগাছার মধ্যে ইসপিরুলিনা সবচেয়ে মূল্যবান যেটি চীন, জাপান, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খাদ্য হিসেবে খেয়ে থাকে। সামুদ্রিক মাছ থেকে খাবার, মাছের তেল দিয়ে বিভিন্ন প্রকার সস, বিটোসন ইত্যাদি তৈরি করা সম্ভব, এর ফলে কর্মসংস্থান হবে এবং বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে। এছাড়াও বঙ্গোপসাগরের টুনা মাছেরও বিদেশে অনেক চাহিদা আছে।
বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের মতে, সমুদ্র সৈকতের বালিতে মোট খনিজের মজুত ৪৪ লাখ টন। এর মধ্যে প্রকৃত মজুত ১৭লাখ ৪৪ হাজার টন। বঙ্গোপসাগরের ১৭ প্রকার খনিজের মধ্যে ১৩ টি স্থানে প্রায় ১০ লাখ টন খনিজবালি উত্তোলনের সম্ভাবনা রয়েছে। গভীর সমুদ্রের তলদেশে মলিবডেনাম, ম্যাঙানিজ, ক্রাস্ট, তামা, সিসা, জিংক, সালফাইডের অস্তিত্ত্ব রয়েছে এবং সাগরের তলদেশে ৩০ থেকে ৮০ কিলোমিটার গভীরে সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ক্লের সন্ধান পাওয়া গেছে। খনিজ বালির মধ্যে মোনাজাইট অতিমূল্যবান পদার্থ এবং এ পদার্থ পারমাণবিক বোমা ও পারমাণবিক চুল্লিতে ব্যবহ্রত হয়। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ম্যাঙ্গানিজ এডিউল, ফসফরাস ডেপোজিট, পলিমেটালিক সালফাইড নামক আকরিক রয়েছে। এইসব আকরিক পরিশোধনের মাধ্যমে কোবাল্ট, লেডসহ দুর্লভ ধাতু পাওয়া যায় এবং এইসব ধাতু জাহাজ নির্মান ও রাসায়নিক কারখানায় ব্যবহার করা যাবে। এছাড়াও মণি, মুক্তো, সোনা, রুপা, প্রবালসহ বিভিন্ন ধরণের মহামূল্যবান ধনরত্ন রয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের গভীর ও অগভীর সমুদ্রে মহামূল্যবান ধাতু ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের সন্ধান মিলেছে। সমুদ্রের উপকূলে উত্তম ব্যবসা লবণ উৎপাদনে যদি উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয় তাহলে ১-৫মেট্রিক টন লবণ রপ্তানি হবে বলে আশা করা যায়। কক্সবাজারের মহেশখালী, টেকনাফ, নিঝুম দ্বীপ, কুয়াকাটায় কালো সোনা পাওয়া যায় যা আমাদের অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করছে।
বঙ্গোপসাগরে রয়েছে গ্যাসক্ষেত্রের আঁধার। বঙ্গোপসাগরের ২৩টি ব্লকে ২০০ট্রিলিয়ন কিউবিক ঘনফুট গ্যাসের আধার রয়েছে যা থেকে কোটি কোটি টাকা অর্জন সম্ভব।
বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে রয়েছে সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে এবং বিপুল কর্মসংস্থান হবে। বঙ্গোপসাগরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য লক্ষ লক্ষ পর্যটক ছুটে আসবে।
বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ তৈরি করে বিদেশে তা রপ্তানি করছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশ জাহাজ রপ্তানিতে ৩য় অবস্থানে রয়েছে। এছাড়াও জাহাজ ভাঙা শিল্প বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করছে।
সাগর থেকে আহরিত সম্পদের মাধ্যমে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবসা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। কক্সবাজার ও কুয়াকাটার মার্কেটগুলোতে স্থানীয় পণ্যের চাহিদা বেশী পর্যটকদের কাছে। পণ্যের গুণগত মান আরও উন্নত করলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাহিদা আরও বেড়ে যাবে।
ব্লুইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি কেবল সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতির প্রসার ঘটায় তা নয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি হ্রাসকরণের মধ্য দিয়ে পরিবেশবান্ধব নবদিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। এছাড়াও দারিদ্র্য বিমোচন, পুঁজির প্রবাহ বৃদ্ধি, বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ সহায়ক অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বেকারত্ব হ্রাস, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আঞ্চলিক ও লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ তথা টেকসই উন্নয়নে সাগরের ভূমিকা অপরিসীম। মানুষের খাবার ও জীবনযাত্রা এবং বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ৮০শতাংশ সমুদ্র পরিবহনের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়।
বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের সম্পদকে যথাযথ কাজে লাগিয়ে সুনীল অর্থনীতির বাস্তবায়ন সম্ভব। বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের ‘রত্নাগার’ হিসেবে ধরা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রাণকেন্দ্র বঙ্গোপসাগর তাই বিভিন্ন দেশে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় বাণিজ্যিক গুরুত্ব অনেক বেশী। সুনীল অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে কক্সবাজার জেলায় ‘ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেছে। আবার বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা -২১০০ এর মহাপরিকল্পনায় সমুদ্র অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ২০১৪সালে ব্লুইকোনমি সেল গঠন করা হয়েছে। তাই বঙ্গোপসাগরের তলদেশের সম্পদের যথাযথযোগ্য ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড়াবে এবং ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল সম্ভাবনাময়।
তামান্না ইসলাম ১ম বর্ষ,আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।