নিজস্ব প্রতিবেদক : নতুন বছরে সরকার প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিদ্যুৎ রফতানির উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। ওই লক্ষ্যে ভারতের একাংশ ছাড়াও নেপাল ও ভুটানে বিদ্যুৎ রফতানির চিন্তা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ভারত এবং নেপালের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ভুটানের কাছেও বিদ্যুৎ রফতানির প্রস্তাব দেয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। এখন প্রতিবেশী দেশগুলো প্রস্তাবে সাড়া দিলেই রফতানির উদ্যোগ চূড়ান্ত করা হবে। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এদেশে গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা বাড়লেও শীতে একেবারেই কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে শীতের সময় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য সিকিম, অসম, অরুণাচল, মনিপুরে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। শীতে ওই অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য নির্মিত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে পানির প্রবাহ কমে যায়। আবার ওসব অঞ্চলে প্রচণ্ড শীতের কারণে হিটিংয়ের (উষ্ণায়ন) জন্য বাড়তি বিদ্যুতের চাহিদা সৃষ্টি হয়। নেপাল এবং ভুটানের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ফলে ওসব এলাকায় শীতে বিদ্যুতের যে সঙ্কট তৈরি হয় তা বাংলাদেশ থেকে পূরণ করা সম্ভব।
সূত্র জানায়, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে মাত্র এক যুগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। দেশে এখন গ্রীষ্মেই চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। উৎপাদন শুরু করেছে পায়রা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। আগামী ৩ বছরের মধ্যে মাতারবাড়ি, রূপপুর এবং রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসছে।
তাতে করে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট বাড়বে। বর্তমানে দেশে গ্রিড সংযুক্ত বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার ৫৯৫ মেগাওয়াট। এখন দিনেরবেলায় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ৭ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। আর সন্ধ্যায় ৮ হাজার ৯০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। অর্থাৎ দিনেরবেলায় ১৩ হাজার ১৯৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থাকছে আর সন্ধ্যায় বসে থাকছে ১১ হাজার ৬৯৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র। গত গ্রীষ্ম মৌসুমে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। ইতিমধ্যে দেশের ৯৯ ভাগের বেশি মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। তাছাড়া দেশে এখন বেজ লোড পাওয়ার প্লান্ট উৎপাদনে আসছে। ফলে আগামী কয়েক বছরে যে হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে সে হারে দেশের চাহিদা বাড়বে না। ফলে বাড়তি বিদ্যুতের ব্যবস্থাপনা এখন পিডিবির বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যানে বিদ্যুতের চাহিদার যে প্রক্ষেপণ দেখানো হয়েছে বাস্তবে ওই হারে চাহিদা বাড়েনি। সরকার সারাদেশে ১০০ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ জোন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। ধারণা করা হয়েছিল ওসব বিশেষ শিল্পপার্ক প্রতিষ্ঠা হলে বাড়তি বিদ্যুতের চাহিদা সৃষ্টি হবে। দেশের ব্যাপক শিল্পায়নের জন্য বিদ্যুতের সংস্থান আগেভাগেই করতে হয়। কিন্তু ওসব প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করতে না পারায় দেশে শিল্প বিদ্যুতের চাহিদা ওভাবে বাড়েনি। ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে অলস বসে থাকতে হচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশ এখন দুদিক দিয়ে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করে। তার মধ্যে ভেড়ামারা দিয়ে এক হাজার মেগাওয়াট এবং কুমিল্লা দিয়ে আর ১৬০ মেগাওয়াট। তার বাইরে ভেড়ামারা-বহরামপুরে আরেকটি সাবস্টেশন নির্মাণের কথা রয়েছে। সেটি নির্মাণ করা হলে ভারত থেকে যেমন এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনা সম্ভব হবে., সেভাবে এক হাজার মেগাওয়াট ভারতে পাঠানোও যাবে। বিদ্যুৎ রফতানি করতে হলে ব্যাক টু ব্যাক সাবস্টেশন নির্মাণ কিংবা আমদানিকারক দেশের নির্দিষ্ট এলাকাকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সঞ্চালনের উপযোগী সাবস্টেশনের মতো করে রূপান্তর করা যায়।
ভারতে তাদের একাংশ থেকে অন্য অংশে বিদ্যুৎ নেয়ার জন্য দীর্ঘদিন থেকে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে চাইছে। বাংলাদেশ এ বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু নেপাল এবং ভুটানের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিক্রির দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করার ক্ষেত্রে গ্রিড লাইন নির্মাণ করতে হলে ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহারের প্রয়োজন পড়বে। তার আগে ভারত আঞ্চলিক গ্রিড লাইন নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করলে ভারতীয় কোম্পানির মাধ্যমে তা করতে হবে এমন শর্ত জুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন ভারত প্রতিবেশীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে ওই শর্ত শিথিল করেছে। ফলে শুধু ভারতীয় অংশ দিয়ে প্রবাহের সময় তাদের হুইলিং চার্জ প্রদান করেই বিদ্যুত রফতানি করা সম্ভব হবে।
অন্যদিকে নেপাল এবং বাংলাদেশের কাছে ভারত বিদ্যুত রফতানি করে। তার বাইরে নেপালে ভারতীয় একটি কোম্পানির নির্মাণ করা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছ থেকে বাংলাদেশ ৫০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। তাছাড়া নেপাল এবং ভুটানের জলবিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশ এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। জলবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কম হওয়াতে আশা করা যায় বাংলাদেশ লাভবান হবে। আবার একইভাবে শীতের সময় দেশের বিদ্যুতে চাহিদা কমে গেলে ওই সঞ্চালন লাইন বিদ্যুৎ রফতানির জন্য ব্যবহার করা সম্ভব হবে। বিগত ২০০৯ সালে দেশে ২৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছিল। এখন দেশে ১৪০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে।
অর্থাৎ ১১৩টি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এখন দেশে গ্রিড সংযুক্ত উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। তবে গ্রিডের বাইরে শিল্প প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব উৎপাদনের জন্য আরো তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। সরকার বলছে, ২০০৯ সালে মাত্র ৪৭ ভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ ছিল। এখন ৯৯ ভাগের বেশি মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আগামী মার্চ মাসের মধ্যে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন শেষ করা হবে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশই শতভাগ বিদ্যুতায়িত দেশের তালিকায় স্থান করে নিচ্ছে। এ অঞ্চলের সব থেকে বড় দেশ ভারতও এখনো পর্যন্ত এ দাবি করতে পারেনি।
বিদ্যুৎ রফতানি প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ বিভাগের বাইরে সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে বিদ্যুৎ রফতানির উদ্যোগ বাস্তবায়নে আলোচনা হওয়া দরকার। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকের মাধ্যমে দেশে বিদ্যুৎ আমদানির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। শুরুতে ২৫০ মেগাওয়াট আমদানির কথা থাকলেও এখন ভারত থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট আমদানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ অল্প পরিমাণ বিদ্যুৎ রফতানির মাধ্যমে একবার শুরু করলে আস্তে আস্তে রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
এ প্রসঙ্গে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জানান, বাংলাদেশ-ভারত সচিব পর্যায়ের স্টিয়ারিং কমিটিতে বিদ্যুৎ রফতানির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোভিডের কারণে বিষয়টি আর অগ্রসর হয়নি। একইভাবে নেপালের সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতে সহায়তা সম্প্রসারণের সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করার সময় তুলে ধরা হয়েছে কিভাবে শীতের সময় তাদের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। তবে ভুটানের সঙ্গে এখনো এ বিষয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।