শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যবহারিক শিক্ষার সংযোজনে ঘুচবে বেকারত্ব
12, February, 2021, 2:03:53:PM
মাইন উদ্দীন হাসান: বেকারত্ব একটা অভিশাপের নাম। দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬-২৭ লাখ। দেশের জনগণের এতো বড় একটা অংশ বেকার থাকার পিছনে কোন বিষয়টা আসলে দায়ী?
একটা মানুষের চাকরীর ক্ষেত্রে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা মূখ্য ভূমিকা পালন করে। সেই শিক্ষাব্যবস্থায় তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি প্রয়োজন ব্যবহারিক শিক্ষা। ব্যবহারিক শিক্ষা বলতে মূলত বুঝায় তাত্ত্বিক জ্ঞানের হাতে-কলমে প্রয়োগ। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যবহারিক শিক্ষা তেমন নেই বললেই চলে। তাই বেকার সৃষ্টির পিছনে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এমন অবস্থাকে দায়ী করা যায়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির মূল উদ্দেশ্য হলো কর্মক্ষেত্রের জন্য শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত জনবল প্রস্তুত করা। তবে আমাদের দেশ শিক্ষিত জনবল তৈরী করতে পারলেও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরী করতে পারছে না। কারণ আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তাত্ত্বিক জ্ঞানে সীমাবদ্ধ। ব্যবহারিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার নেই কোন তেমন একটা ব্যবস্থা।
শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে জরুরী বাজেট বরাদ্দের বিষয়টা। যেখানে কেনিয়ার মতো দেশ তাদের মোট বাজেটের ৪৫ শতাংশ শিক্ষার জন্য ব্যয় করে, সেখানে আমাদের দেশের শিক্ষার ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ ১১-১২ শতাংশ। শিক্ষা ব্যবস্থায় এতো কম বাজেট আমাদের দেশকে পিছিয়ে রেখেছে। কারণ বাজেট কম বরাদ্দ দেয়াতে ব্যবহারিক শিক্ষার পিছনে যে টাকা ব্যয় করা দরকার, তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো করতে পারছে না।
শিক্ষা হলো মূল বিনিয়োগের জায়গা। এই কাজের বড় অংশজুড়ে যেহেতু থাকবে ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং, প্রবলেম সলভিং, কমিউনিকেশন দক্ষতা, তাই শিক্ষাকেও বের করতে হবে মুখস্থ, গতানুগতিক প্রশ্ন-উত্তরের কবল থেকে। এই খাতে তাই বেশি বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। যার ফলে সম্ভব হবে ব্যবহারিক শিক্ষা অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত ল্যাব স্থাপন এবং আইটি সরঞ্জার ক্রয় করার। এতে পড়ালেখা শেষ করে বসে থাকতে হবে না কোন শিক্ষার্থীকে। এই ব্যবহারিক শিক্ষা তাকে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করবে।
তাত্ত্বিক জ্ঞানের সঠিক প্রয়োগ হয় ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে। একটা জাতি ব্যবহারিক শিক্ষায় যত শক্তিশালী হবে, সেই জাতি নিজের বেকারত্ব দূর করার মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে দেশকে তুলে ধরতে সাহায্য করবে। তবে আমাদের দেশের ব্যবহারিক শিক্ষা অর্জনের ব্যবস্থা কম থাকার কারণে দেশ পিছিয়ে রয়েছে এবং পিছিয়ে রয়েছে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। যার ফল স্বরুপ পৃথিবীর এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই আমাদের দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ের তালিকা প্রস্তুতের সময় বিশ্লেষণ করা হয় ৫টি মানদন্ড। যেমন:শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণার সংখ্যা ও সুনাম, গবেষণার উদ্ধৃতি, এখাত থেকে আয় এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। এই মানদন্ড গুলো শিক্ষাব্যবস্থায় যত বেশি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে, আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয় তত সামনের দিকে অবস্থান করবে। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় সব মানদন্ডের দুর্বল অবস্থা এবং তার সাথে পিছিয়ে রয়েছে গবেষণার দিক থেকেও। গবেষণায় বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৬তম এবং বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকেও খারাপ অবস্থা দেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯তম। উচ্চশিক্ষার এই বেহাল দশার কারণ হলো মান যাচাই না করে যে কোন নিম্ন মানের কলেজকেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভূক্ত করা এবং প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। বরং সরকারের উচিত যত্রতত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করে, যে বিশ্ববিদ্যালয় গুলো আছে সেই গুলোর গবেষণার দিকে নজর দেওয়া।
আজকের পৃথিবীতে ইউরোপের দেশ গুলোর এতো উন্নতি ও প্রসারে ভূমিকা পালন করছে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা। কারণ তারা তাত্ত্বিক শিক্ষার পাশাপাশি ভালো সুযোগ তৈরী করে রেখেছে ব্যবহারিক শিক্ষা অর্জনের। এতে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে আমাদের দেশের গ্রাজুয়েটদের মতো বেকারত্বের কষাঘাতে জর্জরিত হতে হয় না। তারা সার্টিফিকেটএ নয়, কাজে বিশ্বাসী। ব্যবহারিক শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের স্বাবলম্বী করতে সক্ষম হচ্ছে এবং দেশকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে যাচ্ছে এক অনন্য উচ্চ মর্যাদায়।
বর্তমান সময়টা প্রযুক্তির যুগ। প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে তৈরী হচ্ছে প্রযুক্তির নানান দিক। যে গুলোতে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে আয়ের বিভন্ন উৎস। তাই প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী ও জুতসই প্রযুক্তির শিক্ষা দেয়া। যে শিক্ষা বেকার তৈরী করার পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের তৈরী করতে পারবে দেশের সম্পদ হিসেবে।
তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি বাস্তবধর্মী ও ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব দক্ষ মানবসম্পদ তৈরী করার। যেটার মাধ্যমে দূরে হবে বেকারত্ব। এতে কোন শিক্ষার্থীকে ঝরে পড়তে হবে না চাকরীর বাজার থেকে। তাই শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। পুঁথিগত মুখস্থ বিদ্যার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে হাতে-কলমে দক্ষতা অর্জনের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এর সাথে সরকারের মনোনিবেশ করতে হবে চাকরীর বাজারের দিকে এবং গ্রাজুয়েটদের জন্য ব্যবসায়ের উদ্দশ্যে সহজ ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। চাকরীর বাজার সৃষ্টিতে বেসরকারী বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে হবে। যাতে তাদের বিনিয়োগের মাধ্যমে অধিক চাকরীর ক্ষেত্র তৈরী হয়।
মানসম্মত জাতি তৈরী করতে প্রয়োজন প্রশিক্ষিত জনশক্তি। আর ওই প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরী করতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যবহারিক শিক্ষায় গুরুত্বআরোপ করতে হবে। এতে অনেকটা গুছে আসবে বেকারত্ব।