জকিগঞ্জে দালালদের হাতে জিম্মি পল্লী বিদ্যুৎ অফিস; সিন্ডিকেটের প্রধান ডিজিএম
25, April, 2021, 1:41:37:PM
জকিগঞ্জ প্রতিনিধি: জকিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ জোনাল অফিসের বিরুদ্ধে দালাল মারফত গ্রাহক হয়রানি অভিযোগের শেষ নেই। প্রতিনিয়ত এ অফিসের বিরুদ্ধে গ্রাহক হয়রানির নানা অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা। নতুন মিটার সংযোগে গ্রাহক হয়রানিসহ দালাল চক্রের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিভিন্ন অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার একাধিক অভিযোগ উঠেছে এ অফিসের বিরুদ্ধে। দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন এ উপজেলার নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ আবেদনকারীরা।
এ সিন্ডিকেট চক্র অফিস খোলা থাকলে প্রতিদিন সকাল থেকে অফিস ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সামনে চায়ের দোকানে ঘুরাফেরা করতে দেখা যায়। এসকল দালাল কোনো অপরিচিত ব্যক্তিকে দেখলেই তার দিকে দৌঁড়ে আসেন। অভিযুক্ত এ দালাল চক্রকে অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারী সুযোগ করে দিচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগে অর্থ আদায় সহ গ্রাহক হয়রানির সাথে জড়িত থাকেন এই দালাল চক্রের সদস্যরা। দালালরা নিজস্ব মোটরসাইকেলে লাইনম্যানদের মতো পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের ব্যাগ, প্লাস, ব্যাল্ট লোহার রোড ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। এমনটাই জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
জানা যায়, অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তারা নির্ধারিত সময়ে অফিসে আসেন না। আবার কেউ কেউ সকালে কিছু সময় অফিসে বসে নিজের ব্যক্তিগত কাজে বাহিরে চলে যান। সামান্য কাজের জন্য গ্রাহকদের ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। নতুন মিটারের আবেদন করতে আসলেই দালাল মুখি করে দালালদের ফোন নাম্বার দিয়ে অফিসের বাহিরে চায়ের দোকানে পৌঁছে দেন অফিস কর্তৃপক্ষ। অফিসে গেলেই দেখা যায় ওয়্যারিং পরিদর্শক অফিসারের চেয়ারের পাশে কম্পিউটার নিয়ে বসে আছেন রাজু আহমদ নামের এক কর্মচারী। রাজু আহমদের দায়িত্ব ওয়ান পয়েন্ট বা অনলাইন সিরিয়ালের কাজে দায়িত্ব পালন করা। কিন্তু তার ভাবভঙ্গিতে মনে হয় তিনি পল্লীতের প্রধান কোন দায়িত্বে রয়েছেন। গ্রাহকদের যাবতীয় কগজপত্র হাতিয়ে নিয়ে দালাল চক্রের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন তিনি। তার মাধ্যম ছাড়া নতুন সংযোগ নিতে গেলই হয়রানি হওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। এতে দীর্ঘদিন থেকে কর্মরত ইলেকট্রিশিয়ানদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
জকিগঞ্জ জোনাল অফিসের অধীনস্থ শাহগলী, ও কালীগঞ্জ অফিস একইভাবে দালাল চক্রের দখলে বলে জানা যায়। দালালরা অফিস থেকে মিটার নিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে লাইনম্যান ছাড়া তারাই সংযোগ দিয়ে থাকেন। তাদের ব্যক্তিগত মোটরসাইকেলে অফিসের সকল সরঞ্জামও রয়েছে। অফিসের সকল অবৈধ সংযোগ তাদের মাধ্যমে হয়ে থাকে। জোনাল অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে রয়েছে এই দালাল চক্রদের গোপন যোগাযোগ। জকিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের বিরুদ্ধে এসব অনেক অভিযোগ ভোক্তভোগী গ্রাহকদের।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার মানিকপুর ইউনিয়নের সাজাপুর এলাকার ব্রিজের পাশে কিছুদিন পূর্বে অর্থের বিনিময়ে একটি দোকানে অবৈধ ট্রান্সফর্মার লাইন স্থাপন করে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়। দোকানের মালিক আনোয়ার মিয়া বর্তমানে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। উপজেলার কাজলসার ইউনিয়নের পশ্চিম গোটারগ্রামের সাজ্জাদ আলীর ছেলে জাহেদ আহমদ অভিযোগ করে বলেন, কয়েকদিন আগে আমি অফিসে গিয়ে একটি নতুন খুঁটির আবেদন করি। সকল তদন্ত শেষ হলেও আজ পর্যন্ত খুঁটি স্থাপন করা হয়নি। কিন্তু উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় খুঁটি ও মিটার সংযোগ থাকা সত্ত্বেও গ্রাহকের সুবিধার্থে খুঁটি স্থাপন করা হচ্ছে। লাইনের কাজের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ থাকলেও উপজেলার বীরশ্রী ইউনিয়নের উজিরপুর গ্রামের বিজয় পাল, সজিত পাল, চন্দন পাল, রনজীত পাল, নজির আহমদের বাড়ীতে দীর্ঘ ২০ বছর যাবত আর্তিং ছাড়া একটি লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। তারা বলেন, আমাদের টিনের চালে হাত দেওয়া যায় না এমন ঝুঁকি নিয়ে দিন যাপন করছি কিন্তু কর্তৃপক্ষকে বারবার অবগত করলে কোনো পদক্ষেপ নেননি।
উপজেলার সুলতানপুর ইউনিয়নের সাতঘরি গ্রামের আব্দুল জলিলের ছেলে আব্দুর রকিব বলেন, গত বছরে বর্ষাকালে ঝড় তুফানে আমার সহ বেশ কয়েকটি ঘর পড়ে যায়। ঘর পড়ে যাওয়ার বিষয়টি এলাকার লোকজন মোবাইল ফোনে অফিসকে অবগত করলে অফিসের লাইনম্যান আমর খুঁটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন করেন। সংযোগ বিছিন্ন করার পর থেকে আমার বাড়িতে বিদ্যুৎ বিল দেয়ার বিধান নেই বলে দেওয়া হয়নি। এমনকি সপরিবারে প্রায় একবছর আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে দিন যাপন করি। ৯-১০দিন ধরে নতুন ঘর তৈরির কাজ শুরু করি। এমতাবস্থায় পল্লী বিদ্যুতের কর্মরত লাইনম্যান আমার মিটারটি অফিসে খুলে নিয়ে যায়। পরে অফিসে গেলে অফিস কর্তৃপক্ষ নিজে মিটার ভেঙেছি বলে আমাকে মিটারের মূল্য ১৩৫০ টাকা ও সাধারণ জরিমানা ৫৭৫ টাকা লিখে দেন। প্রাকৃতিক কারণে মিটার নষ্ট হয়েছে বলে দাবি করলে অফিস কর্তৃপক্ষরা বলেন, তোমার মিটারের কোন তথ্য আমরা দিতে পারবো না। টাকা দিতে হবে। এমনকি মামলার হুমকিও দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
খবর নিয়ে জানা যায়, নতুন মিটার সংযোগ ক্ষেত্রে আবাসিক মিটারের জন্য ৫৬৫ টাকা ও বাণিজ্যিক সংযোগ ক্ষেত্রে ৮৬৫ টাকা অনলাইনের মাধ্যমে জমা করতে হয়। দালালরা তিন চার হাজার টাকা ছাড়া মিটার সংযোগ দেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় ইলেকট্রিশিয়ানদের মাধ্যমে জানা যায়, তাদের মজুরি ও বৈধ টাকার মাধ্যমে নতুন সংযোগ দিয়ে যাচ্ছেন। অবৈধ টাকা না দেওয়ায় তারাও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু দালালের মাধ্যমে কালো টাকার বিনিময় দ্রুত মিটার সংযোগ দেওয়া হয়। এসব দালালদের একমাত্র আশ্রয়স্থল জকিগঞ্জ জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ। উনার কারণে অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তারাও তটস্থ। অফিসে সিসি ক্যামেরা থাকায় অবৈধ লেনদেন হচ্ছে সিসি ক্যামেরার আওতার বাহিরে। যথাযত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুতের খুঁটির আবেদনকারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। কিন্তু কালো টাকার বিনিময়ে প্রয়োজন ছাড়াও বিদ্যুতের খুঁটি স্থাপন করা হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়।
অভিযোগ রয়েছে, টাকা জমা না নিয়েইর অফিস কর্তৃপক্ষ কসকনকপুর ইউনিয়নে বিয়াবাইল গ্রামের শহীদুল মাস্টারের বাড়ীতে মিটার স্থানান্তর করে এবং কালাকুটা গ্রামের যাত্রী ছাউনির পিছনে অবৈধ খুঁটির স্থাপন করে মিটার সংযোগ দেওয়া হয়। খাশেরা গ্রামের হাসান আহমদের বাড়ির পাশে একটি বাড়িতে অন্য জায়গা থেকে একটি মিটার এনে নতুন বাড়িতে সংযোগ দেয়া হয়েছে। হানিফগ্রাম সাজাপুর স’মিলের পাশে আনোয়ার মাস্টার এর ছেলে সুয়েব আহমদের নামে অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন ও সিট তৈরি করে মিটার সংযোগ দেয়া হয়েছে। চেকপোস্ট রহমানীয়া কমিউনিটি সেন্টার উত্তরের বাড়ীতে পুরাতন খুঁটিতে অবৈধ সিট তৈরি করে মিটার সংযোগ দেয়া হয়েছে।
মানিকপুর ইউনিয়নের দেওয়ানচক গ্রামের মৃত মকদ্দছ আলীর ছেলে হাজী ফারুক আহমদ বলেন, মিটার না দেখে তাদের মনগড়া বিল তৈরি করে আমাকে বারবার হয়রানি করা হচ্ছে। অফিসে গিয়ে বিল সংশোধন করতে হয় নিয়মিত।
একই অভিযোগ উপজেলার কামালপুর গ্রামের আলহাজ্ব মাওলানা ইউসুফ আলীর। তিনি বলেন, আগের মাসের বিল পরিশোধের পরেও পরের মাসের বিলের সাথে উভয় বিল দিয়ে প্রায়ই মানুষকে হয়রানী করা হচ্ছে।
মানিকপুর ইউনিয়নের দরগাবাহারপুর গ্রামের মানিক মিয়ার ছেলে প্রবাসী নাজিম উদ্দিন বলেন, আমার বাড়ির পাঁশে একটি দোকানের বিদ্যুৎ বিল প্রতি মাসে নিয়মিত পরিশোধ করি। কিন্তু সম্প্রতি বিদ্যুৎ অফিস থেকে লোকজন এসে বলে ২০১৯ সালের বিল নাকি দেয়া হয়নি। এ টাকা পরিশোধ না করলে ওরা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দেয়। ডকুমেন্ট দেখাতে বললে হাতে লেখা একটি কাগজ দেখায়। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন এসব কোন ধরণের ডাকাতি?
একটি বিলের সাথে অন্য মাসের অনাদায়ী বিল সংযোগ করায় গ্রাহক হচ্ছে প্রতারিত। গ্রাহক স্থানীয় কোন ব্যাংকে বিল পরিশোধ করেছেন কিন্তু যথা সময়ে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ তথ্যটি না নিয়ে পরিশোধিত বিল নতুন বিলে সংযোগ করে দিচ্ছে। এতে গ্রাহকের দু’বার একই বিল প্রদান করতে বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশ সরকার করোনাকালীন শিক্ষার্থীদের লেখা-পড়া ও বিনোদনের জন্য সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে দিনে পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পিছিয়ে পড়া জকিগঞ্জের শিক্ষার্থীরা বিদ্যুতের অনিয়মের কারনে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। লেখা-পড়া থেকে ঝরে পড়া সহ মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা।
এসব বিষয়ে জানতে জকিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ জোনাল অফিসের জেনারেল ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি অফিসে গিয়ে সরাসরি কথা বলার অনুরোধ করেন। মোবাইলে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ১/২টি অভিযোগ সঠিক নয় জানালেও বেশ কিছু প্রশ্নের সঠিক উত্তর না দিয়ে অফিসে যাওয়ার অনুরোধ করেন।