সিলেটে ছাত্রীকে ধর্ষণ: শিক্ষক উধাও, মাদরাসায় তালাবদ্ধ
13, June, 2021, 9:02:36:PM
স্টাফ রিপোর্টার : সিলেটের জৈন্তাপুরে এক মাদরাসা ছাত্রী শিক্ষকের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অভিযুক্ত মাদরাসার শিক্ষকের সঙ্গে ধর্ষিতাকে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িতে বিয়ে করিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। তবে বিয়ের আগেই পালিয়ে যায় মাদরাসার মুহতামিম ও শিক্ষক। এরপর এলাকাবাসীর দাবীর প্রেক্ষিতে মাদরাসায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় ইউপি চেয়াম্যান।
অভিযোগ রয়েছে, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আড়াই বছর যাবত মেয়েটিকে নিয়মিত ধর্ষণ করা হয় উপজেলার চারিকাটা ইউনিয়নের ভিত্রিখেল পশ্চিম গ্রামে অবস্থিত কুব্বাতুল ইসলাম দারুল হুদা কামালপাড়া কওমি মাদরাসায়।
ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত ওই মাদরাসা শিক্ষকের নাম হাফিজ মৌলভী এনায়েত হুসাইন লাবিব (৩০)। তিনি এই মাদরাসার হিফজ বিভাগের শিক্ষক এবং একই উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের হরিপুর এলাকার বাগেরখাল গ্রামের আব্দুল জলিলের ছেলে।
জানা যায়, অভিযুক্ত এই শিক্ষক স্থানীয় একটি মাদরাসার ৮ম শ্রেণীর ছাত্রীকে অনেকদিন যাবত অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে আসছিলেন। পরে তিনি অপরাধের কথা স্বীকার করলে স্থানীয় শালিসের মাধ্যমে বিচার করে তাদেরকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু শনিবার (১২ জুন) রাত ১০টা পর্যন্ত ওই মাদরাসার মুহতামিম ‘ধর্ষক’ শিক্ষককে নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িতে হাজির না হওয়ায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভিযুক্ত শিক্ষক ও মাদরাসার মুহতামিম এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। আর অভিযুক্ত মাদরাসা শিক্ষকের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অসুস্থতার অজুহাতে সালিশে আসেননি।
এদিকে, এ ধরণের অনৈতিক কাজ মাদরাসার ভেতরে নিয়মিত চলার কারণে সংক্ষুব্ধ গ্রামবাসীকে নিয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মাদরাসায় তালা লাগিয়ে দেন।
ধর্ষিত মেয়ে, তার বাবা ও তাদের কিছু স্বজনের অভিযোগ, এই মাদরাসায় ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী থাকাকালীন মেয়েটিকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ান মৌলভী এনায়েত হুসাইন লাবিব। বর্তমানে মেয়েটি একই উপজেলার রওজাতুল ইসলাম চাক্তা কওমি মাদরাসার ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী।
চারিকাটা ইউপি সদস্য ফয়জুল হক বলেন, ‘মেয়েটির সাথে অবৈধ সম্পর্কের বিষয়টি হাফিজ লাবিব নিজেই স্বীকার করেন শালিস ব্যক্তিদের কাছে। তবে তিনি নাকি দুই বছর আগে মাত্র তিন মাস এই অনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছিলেন। এরপর মেয়েটিকে আর পাত্তা দেননি যদিও মেয়েটি তাকে বার বার আহ্ববান জানাতো।’
অন্যদিকে, মেয়েটির বাবার দাবি, ‘এনায়েত সেই শুরু থেকেই বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার মেয়ের সাথে অনৈতিক কাজ করে আসছে। এরই মধ্যে কয়েক মাস আগে মেয়েটি একবার গর্ভ ধারণ করে এবং তিন মাসের গর্ভ নষ্ট করা হয়।’
ফয়জুল হক মেম্বার আরও বলেন, ‘শুক্রবার তার বাড়িতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে চারিকাটা ইউপি চেয়ারম্যান ও ফতেহপুর ইউপি চেয়ারম্যানও উপস্থিত ছিলেন। বিস্তারিত আলোচনার পর বিষয়টি তারা দুই চেয়ারম্যানের উপর ছেড়ে দেন। দুই চেয়ারম্যান চারিকাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের বাড়িতে শনিবার বৈঠকে বসে ফাইনাল একটা সমাধানে আসার কথা ছিল।’
অভিযুক্ত শিক্ষক মৌলভী এনায়েত হুসাইন লাবিব মাদরাসা ছেড়ে পালিয়ে গেলেও অনেকবার চেষ্টার পর তাকে একবার ফোনে পাওয়া যায়। অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের সাথে কথা বলেন’। জানতে চাইলে নিজের নাম উল্লেখ না করে ভাই পরিচয়দানকারী ওই লোকটি বলেন, ‘মেয়েটি খারাপ চরিত্রের। অন্য অনেকের সাথে তার অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এখন ছলে-বলে-কৌশলে হাফিজ লাবিবের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে তার কাছে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা এমন বিয়েতে রাজি নই।’
অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি অস্বীকার করলেও মেয়েটির সাথে হাফিজ লাবিবের কয়েক মাসের প্রেমের সম্পর্ক ছিল বলে স্বীকার করেন। তাদের নিজস্ব এক লোক পুলিশে চাকরি করেন এমন কথা উল্লেখ করে ফোন কেটে দেন। এরপর আরও একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও হাফিজ লাবিবের তিনটি মোবাইল নম্বরই বন্ধ পাওয়া যায়।
যোগাযোগ করা হলে জৈন্তাপুর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ রবিবার (১৩ জুন) বলেন, ‘হাফিজ লাবিবের সাথে মেয়েটিকে বিয়ের দেওয়ার চেষ্টা মেয়ে এবং তার গ্রামের লোকজন করলেও করতে পারে, কিন্তু তিনি বিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কিছুই জানেন না। শালিস বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং তার কাছে যেটা প্রতীয়মান হয়েছে যে, এনায়েত হোসেন লাবিব নয়; অন্য অনেকের সাথে মেয়েটির অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়েছে। মৌলভী মুসা নামে ওই মাদরাসার এক শিক্ষক ও ইমামের সাথে মেয়েটির অনৈতিক সম্পর্কের রেকর্ডও তারা শুনেছেন। হাফিজ লাবিবের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য মেয়েটি ও তার স্বজনেরা এখন ধর্ষণের নাটক সাজাচ্ছেন।’
চারিকাটা ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আলম তোফায়েলের বাড়িতে বিয়ে করিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তোফায়েল বলেন, ‘অভিযোগ আসার পর একাধিকবার বসা হয়। অভিযুক্ত শিক্ষককে ওই মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা সৈয়দুর রহমানের জিম্মায় দেওয়া হয়। শনিবার সর্বশেষ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। এই বৈঠকে ফতেহপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসেন নাই। অন্যদিকে, অভিযুক্ত শিক্ষক ও মুহতামিমের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।’
তোফায়েল আরও বলেন, ‘অনেকে এই দুইজনকে বিয়ে করিয়ে দেওয়ার কথা বললেও আসলে আইনি কিছু জটিলতা আছে। মেয়েটির বয়স কম।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘একজন মাদরাসার শিক্ষকের কাছ থেকে এমন গর্হিত কাজ কিভাবে সংঘঠিত হয়?’ অভিযুক্ত শিক্ষককে নিয়ে মুহতামিম পালিয়ে যাওয়ায় এলাকাবাসীকে নিয়ে তিনি মাদরাসায় তালা দিয়ে দিয়েছেন বলে জানান এই ইউপি চেয়ারম্যান।
জানা যায়, সর্বশেষ গত ৮ জুন (মঙ্গলবার) দিবাগত রাত ১টার দিকে স্থানীয় দু’একজন লোক ১৫ বছর বয়সী মেয়েটিকে মাদরাসার বারান্দায় দেখতে পান। মেয়েটি বলে, ওই রাতে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার কথা বলে গভীর রাতে তাকে মাদরাসায় নিয়ে যায় হাফিজ লাবিব। বাড়ি থেকে বের করিয়ে আনার পর সে কথা না রাখায় মেয়েটি নাকি মাদরাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। এই অবস্থায় তাকে এলাকার কিছু লোক উদ্ধার করেন এবং তখন থেকে শালিস বৈঠক শুরু হয়।
পলাতক মুহতামিমকে না পাওয়ায় যোগাযোগ করা হয় তার ভাই ভিত্রিখেল গ্রামের আব্দুর রহমানের সাথে। তিনি তার ভাইয়ের বিষয়ে কিছু উল্লেখ না করে বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষক হাফিজ লাবিবকে তারা খোঁজে পাচ্ছেন না। শালিস বৈঠকে বিয়ে দেওয়ার কথা থাকায় সম্ভবত সে পালিয়েছে। হাফিজ লাবিবকে তারা হন্যে হয়ে খোঁজছেন।
ভিত্রিখেল গ্রামের বাসিন্দা, শালিস ব্যক্তত্ব মনির আহমদ নামে একজন অভিযোগ করে বলেন, ‘এই মাদরাসায় নিয়মিত ধর্ষণ ও বলাৎকারের ঘটনা ঘটে। এই মেয়েটির সাথে ওই মাদরাসার মুসা নামে আরেকজন শিক্ষকেরও অনৈতিক সম্পর্ক ছিল। মাদরাসায় যেসব ছোট ছোট ছেলেমেয়ে পড়ে তাদের বেশির ভাগের সাথে অনৈতিক কাজ করেন শিক্ষকরা। যেখানে নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া হবে সেখানে যদি এতো আকাম চলে, তাহলে এমন মাদরাসা দিয়ে কী হবে?’
মনির আহমদসহ ভিত্রিখেল গ্রামের কয়েকজন দাবি করেন, অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে যাতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং তাকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা হয়।