তানভীর হোসাইন: বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দেশীয় ইভ্যালি অনেকটা গর্জন দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। তবে, গ্রাহকদের আলোচনা-সমালোচনায় তীরবিদ্ধ এই প্রতিষ্ঠান এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। কোম্পানির সিইও মোহাম্মদ রাসেল দাবি করেন, দ্রুত ফান্ড সংগ্রহ করে চলমান সংকট সমাধান করা হবে।
২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক সংখ্যা কোটি ছুঁই ছুঁই হলেও সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় অভিযোগ যেনো পিছু ছাড়ছেই না। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইভ্যালির মোট দেনা ৪০৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করলেও মোহাম্মদ রাসেল দাবি করছেন ইভ্যালি অবৈধ কোন ব্যাবসায়িক মডেল অনুসরণ করছে না। গ্রাহক সংখ্যা বাড়াতে প্রথমে লস দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও পর্যায়ক্রমে তারা লাভবান কোম্পানিতে পরিণত হবেন। এছাড়াও তিনি বিদেশি নামিদামি ই-কমার্স গুলোর স্টার্টিং পজিশনও ইভ্যালির মতো লস দিয়ে শুরু হয়েছিলো বলে দাবি করেন তিনি।
৪০৭ কোটি টাকা দেনার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সিইও বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বড় বড় সেলারদের ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি পেমেন্ট দিয়েছি। আর পণ্য ডেলিভারি করা হয়েছে এর চেয়েও অনেক বেশি টাকার। এত বিপুল পরিমাণ পণ্য লস দিয়ে ডেলিভারি করায় আমাদের কিছুটা কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। তবে এই সংকট দ্রুতই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
তিনি আরো বলেন, ইভ্যালি কখনোই এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা করে না এবং ভবিষ্যতেও করবে না। আমরা যদি এমএলএম সিস্টেম ফলো করতাম তাহলে সরকার অনেক আগেই আমাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিত। এমএলএম পদ্ধতির অনেক উদাহরণ আছে দেশে, তাদের বিজনেস স্ট্র্যাটেজির সাথে আমাদের কোনো মিল নেই।
পুরনো গ্রাহকদের পণ্য অথবা রিফান্ড এর টাকা কেন দ্রুত পরিশোধ করা হচ্ছে না এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সাইক্লোন বন্ধ করে দিয়েছি। সরকার নতুন ই-কমার্স নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এখন থেকে গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেয়া সম্ভব নয়। তবুও আমরা গত ২ সপ্তাহে পুরাতন অর্ডার থেকে ৪০ কোটি টাকার পণ্য ডেলিভারি দিয়েছি। বড় বড় কোম্পানিগুলো আমাদের সাথে কাজ করতে আগ্রহী। স্যামসাং, রিয়েলমি এবং ওয়ালটন এর মত প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের সঙ্গে রয়েছে।
লসের ঘাটতি পূরণ করা হবে কিভাবে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি ফান্ড রেইজ করার জন্য। দেশের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে আমরা যোগাযোগ করছি। তারা আমাদেরকে ফান্ড সরবরাহ করলে নির্দিষ্ট টাইমলাইন অভার হওয়া অর্ডারগুলো আমরা দ্রুত ডেলিভারি করব। আজ পুঁজি সংগ্রহ করতে পারলেই কাল সবাই আমাকে হিরো বলবে।
করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের চলমান কঠোর লকডাউন শিথিল করা হলেও ঈদের আগে খোলা হয়নি ইভ্যালির প্রধান কার্যালয়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা আপাতত বাসা থেকেই কাজ করছি। সব কাজ সুন্দরভাবে চলছে। ৬ টি ওয়্যারহাউজে দিনরাত ডেলিভারির কাজ চলমান রয়েছে। ঈদের পরে দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হলেই আমরা প্রধান কার্যালয়ে উপস্থিত থেকে কাজ করব।
ইভ্যালি অফিসের হট লাইন নম্বরে (০৯৬৩৮১১১৬৬৬) নম্বারে ফোন করে গ্রাহকরা যোগাযোগ করতে পারছেন না, এমন অভিযোগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই পোস্ট করছেন। এ অভিযোগের বিষয়ে মোহাম্মদ রাসেল বলেন, হটলাইন নম্বর চালু রয়েছে, একসঙ্গে অনেক গ্রাহক কল করায় সংযোগ স্থাপন হতে একটু সময় লাগে।
ফেসবুক গ্রুপে ইভ্যালির গ্রাহকদের অভিযোগের পাল্লা এত ভারী কেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি পণ্য সরবরাহ করেছি। যারা পণ্য পেয়ে সন্তুষ্ট তাদের সবাই পজেটিভ রিভিউ দেয় না। কিন্তু যাদের পণ্য ডেলিভারি পেতে একটু সময় লাগছে তারা প্রতিনিয়ত অভিযোগ করে যাচ্ছে। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আমাদের দুই তিন মাস সময় লাগবে।
এছাড়াও প্রায়োরিটি শপে আমরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য সরবরাহ করছি এবং ইভ্যালির নতুন ক্যাম্পেইন টি-টেন এ ৫-১০ কর্ম দিবসের মধ্যে পণ্য দিচ্ছি। এখানে অভিযোগের মাত্রা অনেক কম। অল্প কিছুদিন আগে হওয়া নতুন নীতিমালার আলোকে ইভ্যালির সেলস ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
দৈনিক স্বাধীন বাংলা পত্রিকাকে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইভ্যালি শুধুমাত্র নিজের মার্কেটপ্লেস বড় করছে না, দেশের কর্মসংস্থানেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে ইভ্যালির কর্মী সংখ্যা ১৬০০ এর অধিক।
শুক্রবার (১০ জুলাই) নিজের ফেসবুক ওয়ালে তিনি একটি স্ক্রিনশট শেয়ার করে দাবি করেন, ঐদিন চলা টি-টেন ক্যাম্পেইনে একদিনেই অর্ডার পড়েছে ২০০ কোটি টাকার অধিক। গ্রাহকের আস্থা না থাকলে কঠিন সংকটময় মুহুর্তে এত অর্ডার আসতো না বলে দাবি তার।
গতকাল (১৬ জুলাই) মোহাম্মদ রাসেলের ফেসবুক স্ট্যাটাসের কমেন্টে অন্তু করিম নামের এক গ্রাহক লিখেন, ‘পাশে যেভাবে ছিলাম, তার থেকেও আরো ভাল ভাবে আছি, থাকব ইনশাল্লাহ। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এগিয়ে যান ভাই’।
তবে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ইভ্যালি সহ অন্যান্য ই-কমার্সের বিষয়ে কঠোর নজরদারি করছে ই-ক্যাব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক এবং সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এরমধ্যে ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরীন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাসেলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, ইভ্যালির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রতিযোগিতা কমিশন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরেও চিঠি পাঠানো হয়েছে।
সরকারি সংস্থাগুলো এসব নজরদারিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি বলেন, এটা স্বীকার করতেই হবে যে আমরা কঠিন সংকটময় মুহুর্ত পার করছি। আমরাও কঠোর মনিটরিংয়ের মধ্য দিয়ে কাজ করতে চাই। দ্রুত আমরা সংকট কাটিয়ে উঠব এবং দেশের কেউ ইকমার্স লিড দিবে, এটা আমি শতভাগ নিশ্চিত- বলেন মোহাম্মদ রাসেল।