নাজমুন নাহার জেমি নৈতিকতা হলো নীতি সম্পর্কিত বোধ, এটি একটি মানবিক গুণাবলি যা অন্য আরো অনেক গুণের সমন্বয়ে তৈরি হয়। মানুষ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্মের ওপর ভিত্তি করে সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মনীতি খুব সচেতনভাবে মেনে চলে। সমাজ বা রাষ্ট্র আরোপিত এই সব নিয়ম-নীতি ও আচরণবিধি মানুষের জীবন যাপনকে প্রভাবিত করে। এই নিয়মগুলো মেনে চলার প্রবণতা, মানসিকতা, নীতির চর্চাই হলো নৈতিকতা। আগে মানুষ বিশ্বাস করতো ধনের চেয়ে মন বড়। অথচ এখন এই ধারণা পাল্টে গেছে। প্রত্যেকে এখন অবিরাম ছুটে চলেছে অর্থ সম্পদ ও বিত্তের পেছনে। একজনকে পেছনে ফেলে আর একজনের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা প্রত্যেককে করে ফেলেছে অন্ধ। প্রত্যেকে অবলীলায় বির্সজন দিচ্ছে নিজস্ব নৈতিকতা। তাই এখন সমাজের নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত সবটাই ডুবে গেছে দুর্নীতি, অপকর্ম আর অনৈতিক কর্মকান্ডে।
নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে মানুষ এমন করে নির্বাসিত করেছে যে, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় প্রধানরাও হরহামেশাই জেলে যাচ্ছে দুর্নীতির দায়ে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রই আজ নীতিহীনতায় জর্জরিত। মূল্যবোধের চর্চাকে এখন বোকাদের কাজ বলে বিদ্রুপ করা হয়। আমাদের দেশের যুব সমাজের দিকে তাকালে এই অবক্ষয়ের এক করুণ ও প্রত্যক্ষ চিত্র আমরা দেখতে পাই। লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী এই অবক্ষয়ের কারণে নিজেদেরকে ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারের পথে, আসক্ত হচ্ছে মাদকে। ছিনতাই, অপহরণ, গুম, খুন, হানাহানি, নষ্ট রাজনীতি আর সন্ত্রাসের প্রতি জড়িয়ে যাচ্ছে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে গলা টিপে হত্যা করে মূল্যবোধ আর নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে সব বয়সী মানুষ আজ চলেছে ধ্বংসের পথে। যে ছেলেটির হওয়ার কথা শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা প্রশাসক সে আজ হয়ে যাচ্ছে চোরাচালানকারী, মাদক ব্যবসায়ী কিংবা সন্ত্রাসী। যার দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সে আজ অন্যায় করে ব্যাহত করছে দেশের অগ্রযাত্রা। চলমান এই অবক্ষয় থামাতে হলে সবার আগে প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের চর্চা। যে ব্যক্তির মধ্যে নৈতিক শিক্ষা থাকে, মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে সে ব্যক্তি সকল অপরাধ থেকে বিরত থাকে।
শুধুমাত্র অবক্ষয় রোধের জন্যই নয় বরং জীবনকে সুন্দর করে তোলার জন্য ছাত্র জীবনেই নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি তার নীতিতে অটল থাকে। মূল্যবোধ ব্যক্তি পর্যায়ে যেমন একজন মানুষকে সঠিক ও শুদ্ধ মানুষ রূপে গড়ে তোলে তেমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও মানুষকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ থাকার কারণেই মানুষ তার নিজের, পরিবারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের প্রতি সকল দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে। ছাত্র সমাজকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে এবং নৈতিক শিক্ষার যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। আমাদের বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় এবং ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ্যসূচিতে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার উপযোগী বিষয়বস্তু থাকতে হবে। যে জাতি যতো বেশি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং নিজস্ব মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সে জাতি ততো বেশি সুসংহত। সব দিক দিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার বাড়ছে দিন দিন। কিন্তু শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে সমাজে বাড়ছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। খুন, গুম, ধর্ষণ, মাদকাসক্তি, দুর্নীতি ও অশ্লীলতার মতো অপরাধপ্রবণতাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অশিক্ষিত লোকের পাশাপাশি শিক্ষিত লোকেরাও এসব অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত।
শুধু কাগজে-কলমে শিক্ষিত লোকেদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে শিক্ষিত লোকেরা এ সমাজকে গ্রাস করে ফেলছে। অনৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রকঠামোতে আজ অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই নেতিবাচক প্রভাবকে প্রভাবিত করতে হবে ইতিবাচক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ দিয়ে। সামাজিক কৃষ্টি-কালচার, আচার-আচরণ, রীতিনীতিও শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলে। সারা জীবনের জন্য পরিকল্পনা করতে চাইলে মানুষের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে সুশিক্ষা বলতে নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে। নৈতিক শিক্ষা ও মানবিক শিক্ষার মিলনস্থল হলো সুশিক্ষা। সুশিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর নৈতিক মানদন্ডকে উন্নত করার পাশাপাশি তার ভিতরকার মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে। ক্লাসের শিক্ষা শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ও সৃজনশীল চিন্তার প্রসার ঘটাতে পারে এই দিকটি শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অভিভাবকের নজরে থাকতে হবে।
মূল্যবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশের প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার সকল স্তরে নিজ দেশের কৃষ্টি কালচার বিষয়ক নানা রকম অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীরা নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে অনেক সচেতন ও সজাগ হবে। বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজন নৈতিক চরিত্র বলে বলীয়ান, মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানবসম্পদের। এসব কারণেই নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষা বৃদ্ধিতে মনোযোগী হতে হবে।