অতিমাত্রায় টিকটক নামক অ্যাপস এর ব্যবহার একটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। ২০১৭ সালে বেইজিংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্স কিশোরদের অন্যতম জনপ্রিয় অ্যাপ মিউজিক্যালি কিনে নেয় এবং নাম দেয় টিকটক। যদিও টাইম টাইপাসের জন্য এই অ্যাপসটি তৈরি করা হয় কিন্তু বর্তমানে এটি একটি ব্যধিতে রূপ নিয়েছে। সম্প্রতি মানুষের মধ্যে বিশেষ করে উঠতি বয়সের শিশুর কিশোরীদের মধ্যে এই আচার-ব্যবহার বিপুলভাবে বেড়েছে।
প্রত্যেক মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি হলো অন্যের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলা। অতীতে মানুষ নিজের মেধা, বুদ্ধি, আচার-আচরণ ও ব্যক্তিত্ব না দর্শনগত উপস্থাপনার মাধ্যমে অন্যের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করত। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তির অভাবনীয় পরিবর্তনের ফলে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরীর জন্য প্রযুক্তিগত পন্থাকে ব্যবহার করা হয়। এসকল পন্থার মধ্যে অন্যতম হলো মোবাইল অ্যাপস টিকটক। এই অ্যাপস এর মাধ্যমে ১৫ সেকেন্ডের যেকোনো ভিডিও তৈরি করা যায় এবং যা খুব সহজে অন্য কোনো সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা যায়। অন্য কারো তৈরি করা কোন গান বা অভিনয়ের মধ্যে ঠোঁট মিলিয়ে নিজের অভিনয়শৈলী প্রকাশ করা যায় টিকটকের মাধ্যমে।
টিকটক একটি মোবাইল অ্যাপস হলেও এর নেতিবাচক দিক অনেক বেশি। তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের বাস্তবতা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে টিকটক। শুধু তাই নয় তাদের মধ্যে উগ্রত, অশালীনতা, অশ্লীলতা, কল্পনাপ্রবনতার মতো বিভিন্ন জটিল মানসিক রোগ তৈরি করছে। যারা ক্রমাগত এই অ্যাপস ব্যবহার করে তাদের মধ্যে বিশেষ মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছে। অতিরিক্ত টিকটকের ব্যবহারের ফলে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, বাস্তবতার প্রতি বিমুখতা, মনস্তাত্ত্বিক অবক্ষয় ও চারিত্রিক অবনতির মত ভয়ানক জটিল মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। সামগ্রিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে।
টিকটক অ্যাপস এর ব্যবহারের কারণে এমন কিছু নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছে যার ফলে ভিডিও আপলোডকারীকে জীবনের ইতি টানতে হয়েছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে আপলোডকারী বিভিন্ন ধরনের হয়রানি শিকার হয়েছে। কিছুদিন আগে ভারতীয় এক যুবক মেয়েদের পোশাক পরে মেয়েদের রূপে অভিনয় করে ভিডিও আপলোড করে । সাধারণ মানুষজন ছেলেটিকে মেয়ে রূপে দেখে তাকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মজা করতে থাকে। সবার মজা এমন একটি পর্যায় চলেযায় যা ছেলেটি শেষপর্যন্ত না নিতে পেরে আত্মহত্যার পথে চলে যায়। ইয়েঙ্ক নামে চায়নার লাইভ স্ট্রিমিং গার্ল তার সুরেলা কন্ঠে লাইভ গান গেয়ে টিকটকে ভিডিও বানিয়েছিল এবং লাখো মানুষের মন জয় করে নিয়েছিল। যখন ইয়েঙ্কে চায়নার জাতীয় সঙ্গীত একটু ভিন্নভাবে গেয়ে একটি ভিডিও প্রকাশ করে। যেটি চায়নার মানুষ খুবই অপছন্দ করে এবং তাকে জাতীয় সংগীতের অবমাননার দায়ে পাঁচ দিন জেল খাটতে হয়েছিল। ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের চিফ মিনিস্টার নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে একটি ছেলে টিকটকের ভিডিও প্রদান করে। সেই ভিডিওটির এডিটিং দেখে মনে হয়েছিল চিফ মিনিস্টার কিছুটা নেশাগ্রস্থ অবস্থায় আছে কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই নয়। এই ভিডিওতে চিফ মিনিস্টারের ভাবমূর্তি নষ্টের জন্য বিভিন্ন ধারায় ছেলেটাকে শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল। চায়নাতে মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ির লোগো খুলে ফেলার ট্রেন্ড তৈরি হয়েছিল টিকটকের মাধ্যমে। এসব ভিডিও দেখে অনেকে অন্যের গাড়ির লোগো চুরি করা শুরু করেছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে হুয়োং নামের একজনকে গ্রেফতার করা হয়।
এসব উদাহরনের মাধ্যমে টিকটকের ভয়াবহতা আন্দাজ করা যায়। সব ক্ষেত্রে বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে মজা করার আগে ভেবে নিতে হবে সবকিছুর একটি পরিসীমা রয়েছে। সীমা ছাড়িয়ে কোনকিছু করলে তা সবসময় অকল্যাণ বয়ে আনে। সোশ্যাল মিডিয়াতে যা কিছুই প্রকাশ করা হয় না কেন তা ডিলিট করে দিলেও পৃথিবীর কোথাও না কোথাও সেটা থেকে যায়। পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্তে কেউ-না-কেউ ওকে ডাউনলোড করে রাখতে পারে এবং সময় মতো ব্যবহার করতে পারে। তাই এ ধরণের মানসিক ব্যাধি থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি বর্তমানে টিকটক অ্যাপ এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। বর্তমানের বাজারমূল্য ৭ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।
লেখক - আরিফা আক্তার সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তৃতীয় বর্ষ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়