মনির হোসেন, বরিশাল ব্যুরো: আসেন ভাই আসেন, একটা খাইয়া যান। একবার খাইলে আরেকবার খাইতে মন চাইব। ছিইল্লা-কাইট্টা লবণ লাগাইয়া দিমু, মাত্র ৫ টাকা। এভাবেই চিৎকার করে ক্রেতাকে আমড়া খেতে আহবান জানাচ্ছিলেন বরিশালের লঞ্চ ঘাট এলাকার হকার রমজান মিয়া।
কথা হয় রমজান মিয়ার সাথে,তিনি একজন সিজনাল হকার। যখন যে ফলের মৌসুম, সেই ফল ফেরি করে বিক্রি করেন।
এখন আমড়ার সিজন চলছে তাই তিনি আমড়া বিক্রি করছেন। সিজনাল ফলের ব্যবসায় নাকি লাভ বেশি। বরিশালের আমড়া অনেক মিষ্টি ও সুস্বাদু ফল। নৌ, সড়ক কিংবা সড়কপথে রওয়ানা হলে হকারদের এসব শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। কাকডাকা ভোর থেকে শুরু করে মাঝরাত পর্যন্ত চলে ওদের ডাকাডাকি। কিছুটা বিরক্ত লাগে। তবে কাঠিতে বসানো আমড়া নিয়ে যখন আশেপাশে ছুটাছুটি করে তখন জিব্বায় জল রাখা দায়। ফলগুলোকে ওরা বিশেষভাবে কেটে পরিবেশন করে। দেখতে দারুণ! এক বিশেষ আকর্ষণ। মনে হবে, এ যেন শিল্পীর কারুকাজ। লুফে নিতে ইচ্ছে করবে বার বার। সে আমড়া বাঙালির অতি প্রিয় একটি ফলের নাম। টক-মিষ্টি মিশ্রণে ভিন্ন এক স্বাদ। কচি অবস্থায় টক। পরিপক্ক হলে খেতে বেশ লাগে। পাকা ফল খুবই মিষ্টি। আমড়ার সিংহভাগ কাঁচা খাওয়া হলেও ভর্তা, আচার, চাটনি আর পরিপক্ব ফল দিয়ে তৈরি করা যায় জুস, জেলি এবং মোরব্বার মতো লোভনীয় খাবার। গ্রামাঞ্চলের কেউ কেউ গোশতের সাথে আমড়া রেঁধে খান। ডালের সাথেও খাওয়া যায়। আমড়ার শঁশাস সাদা। পাকলে হলুদ রঙ ধারণ করে। যে কারণে একে গোল্ডেন আপেল বলে। মাঘ-ফাল্গুনে আমড়ার মুকুল আসে। এর পরে ফল। কচি অবস্থায় ফলের বিচি নরম থাকে। পরিপক্ক হলে আঁটি বেশ শক্ত হয়।-অগ্রহায়ণে ফল পাকে। পাকা ফলের গন্ধ চমৎকার। আমড়া সারা দেশেই চাষ করা যায়। তবে বরিশালের আমড়া সারাদেশে নামকরা।
দক্ষিণাঞ্চলের মাটি ও পানির জন্য এর ফলন ও গুণগতমান কাক্সিক্ষত হয়। প্রসিদ্ধ হিসেবে সবাই বরিশালের আমড়া বললেও আসলে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি (নেছারাবাদ) আমড়ার রাজধানী বলা যায়। কারণ, ওখানকার ফলন হয় সবচেয়ে বেশি। ঝালকাঠি, বরিশাল, ভোলা এবং বরগুনায়ও আমড়া ভালো জন্মে। বাংলাদেশে দু’প্রজাতির আমড়া চাষ হয়। দেশি এবং বিলাতি। বিলাতি আমড়ার অপর নাম বরিশালের আমড়া। দেশি আমড়া খেতে টক, বিচি বড়। বিলাতি আমড়া খেতে মিষ্টি, বিচিও ছোট। ভালো ফলনের জন্য আমড়ার উচ্চফলনশীল জাত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বারি আমড়া-১ এবং বারি আমড়া-২। বারি আমড়া-১ বারোমাসি। গাছ বামনাকৃতির হয়। তাই বাড়ির ছাদেও লাগানো যায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একটি জাত উদ্ভাবন করেছে। নাম এফটিআইপি বাউ আমড়া-১।
বিশেষজ্ঞদের মতে পুষ্টিগুণ: আমড়ায় পুষ্টিগুণে টইটম্বুর। ভিটামিন-সিথর পাশাপাশি রয়েছে প্রচুর পরিমাণ লৌহ। লৌহের অভাবে আমাদের রক্তস্বল্পতার সৃষ্টি হয়। যদিও প্রাথমিক অবস্থায় এ উপসর্গ দেখা দেয় না। অভাব বেশি হলেই কেবল শারীরিক দূর্বলতা, অল্প পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া, ঘন ঘন অসুস্থতা এসবের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তখন বড়দের কর্মক্ষমতা কমে যায়। অপরদিকে শিশুদের মস্তিষ্ক হয় বাঁধাপ্রাপ্ত। ফলে স্কুলের পড়া সহজে শিখতে পারে না। অথচ বাচ্চাসহ বড়রা লৌহসমৃদ্ধ অন্য খাবারের পাশাপাশি আমড়া খেলে এসব সমস্যা এড়ানো সম্ভব। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, এর প্রতি ১০০ গ্রাম ফলে (আহারোপযোগী) শর্করা ১৫ গ্রাম, আমিষ ১ দশমিক ১ গ্রাম, চর্বি ০ দশমিক ১ গ্রাম, খনিজ পদার্থ ০ দশমিক ৬ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৫৫ মিলিগ্রাম, লৌহ ৩ দশমিক ৯ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ৮০০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-‘বি১থ ১০ দশমিক ২৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-‘বি২থ ০ দশমিক ০৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-‘সিথ ৯২ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে ৬৬ কিলোক্যালরি।
ভেষজগুণ : আমড়ায় আছে যথেষ্ট ভেষজগুণ। কফ ও পিত্ত নিবারণের পাশাপাশি মুখে রুচি আনা এবং কন্ঠস্বর পরিষ্কারে এর ভূমিকা রয়েছে। জ¦র, সর্দি, কাশি, এমনকি ইনফ্লুয়েঞ্জার জীবাণুকে প্রতিরোধ করে। দাঁতের মাড়ি শক্ত রাখে। দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত ও পুঁজপড়া বাঁধা দেয়। স্ট্রোক এবং হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ করে। পেকটিনজাতীয় আঁশ থাকায় বদহজম, পেট ফাঁপা, কোষ্ঠকাঠিন্যে দূরীকরণে সহায়তা করে। মুখের রুচি বাড়ায়। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় আমড়া ক্যান্সার প্রতিরোধক। ভাইরাল ইনফেকশনের বিরুদ্ধে কাজ করে। রক্ত আমাশয় হলে আধা কাপ পানিতে ৩/৪ গ্রাম আমড়ার কষ, সেই সাথে ১ চা-চামচ গাছের রস এবং একটু চিনি মিশিয়ে খেতে হবে। ব্রণ, ফুস্কুড়ি কমাতে এবং ত্বক মোলায়েম ও উজ্জ¦ল রাখতে এর অবদান বেশ। আমড়ার পাতা, ছাল, শিকড় এবং বীজে ঔষষিগুণ আছে। পাতার তৈরি ‘চাথ জ¦র ও শরীরের ব্যথা দূর হয়। চা বানানোর জন্য পাতাগুলো ভালোভাবে ধুয়ে রোদে শুকানোর পর গুঁড়োকরে ব্যবহার করতে হবে। গাছের ছাল ছত্রাকজনিত সংক্রমণ প্রতিহত করার উপাদান রয়েছে। ফলের বীজ উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এর শিকড় প্রজননজনিত রোগ নিরাময়ে অবদান রয়েছে। ভেষজবিদদের মতে, আমড়ায় গর্ভপাত হওয়ার উপাদান থাকায় গর্ভবতী নারীদের এ ফল খাওয়া নিষেধ। ডায়াবেটিস রোগীরা কাঁচা আমড়া খেতে পারবেন। পাকা ফল নয়।
‘ফল খাই বল পাইথ এ কথা সবাই জানি। তারপরও প্রয়োজনমতো খাওয়া হয় না। অসচেতনতা আর প্রাপ্তির অভাবই এর কারণ। তবে পর্যাপ্ত সুযোগ আছে। শুধু প্রয়োজন ইচ্ছেশক্তি এবং পরিকল্পনা। আপনার পছন্দমতো যে কোনো ফল বাগান তৈরি করতে পারেন। চাষাবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পাশে আছেন উপজেলা কৃষি অফিসার, উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা। তাই আসুন, প্রতিটি বসতবাড়িতে অন্য ফলের পাশাপাশি দুথচারটি হলেও আমড়াগাছ লাগাই। এ ব্যাপারে অপরকে ও করি উৎসাহিত।