মহামারী করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর থেকে কখনো ‘শারীরিক দূরত্ব’ আবার কখনো ‘সামাজিক দূরত্ব’ প্রত্যয় দুটি ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এটি নিয়ে যে কোন মতপার্থক্য নেই এমনটি নয়। ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে এটি শারীরিক দূরত্ব, সামাজিক দূরত্ব নয়। সুক্ষ্ম কিন্তু বিশ্লেষণধর্মী বিষয় দু’টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক দূরত্ব বলতে সাধারণত বিভিন্ন গোষ্ঠী বা শ্রেণি একে অপরের থেকে দূরত্বে অবস্থান করা বুঝায়। সামাজিক দূরত্ব বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করতে ভারতীয় জাতিভেদ প্রথার উদাহরণ যথেষ্ট হবে। ভারতীয় বর্ণপ্রথা অনুযায়ী নিম্ন শ্রেণির মানুষ, অর্থাৎ বৈশ্য ও শুদ্র, উচ্চ শ্রেণিতে থাকা ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারে না। তাদের উচ্চ ও নিম্ন বর্ণের মধ্যে বিয়ে, আদান প্রদান তো নেই বরং এমনও নিয়ম আছে নিম্ন বর্ণের কোন ব্যক্তির ছায়া যদি উচ্চ বর্ণের কেউ মাড়ায় তবে তাকে গোসল করার মাধ্যমে পবিত্র হতে হবে। এখানে নিম্ন বর্ণ এবং উচ্চ বর্ণের মাঝে যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তাকে সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক দূরত্ব বলেছেন।
অন্যদিকে শারীরিক দূরত্ব বলতে কোন একজন ব্যক্তি থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করা বোঝায়। যেমন সাধারণত আমাদের পরিবারে কারো ফ্লু হলে সে সদস্য থেকে আমরা কিছুটা দূরত্ব মেনে চলার চেষ্টা করি। এটি কেবলমাত্র কিছু সময়ের জন্য ব্যক্তি থেকে দূরে অবস্থান করা বুঝায়, যা সামাজিক দূরত্ব নয় বরং শারীরিক দূরত্ব।
আলোচ্য দুটি বিষয়ের মধ্যে যুক্তিশীল পার্থক্য তুলে ধরেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর সামাজিক দূরত্ব কথাটি খুব বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে মহামারি প্রেক্ষিতে ব্যবহারের জন্য কথাটি সামাজিক দূরত্ব নয় বরং শারীরিক দূরত্ব হবে। অর্থাৎ মহামারি থেকে রক্ষা পেতে আমাদেরকে শারীরিক নৈকট্য পরিহার করতে হবে। সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে তিন বা চার ফুট দূরে অবস্থান করতে হবে। এক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্ব কথাটি ব্যবহার করতে হবে। কারণ সমাজবিজ্ঞানে সামাজিক দূরত্ব বলতে, একটি বর্ণ থেকে অন্য একটি বর্ণ কিংবা একটি গোষ্ঠী থেকে অন্য একটি গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরী করা বোঝায়। উদাহরণস্বরূপ সাদা-কালো ভেদাভেদ কিংবা উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে বৈষম্য। সামাজিক দূরত্ব এটা নয় যে একজন ব্যক্তি অন্য একজন ব্যক্তি থেকে অসুস্থতা বা কোন শারীরিক সমস্যার কারণে দূরে অবস্থান করবে। তবে ক্ষুদ্র অর্থে সামাজিক দূরত্ব বলা যেতে পারে, যখন আমরা খুব বেশি ভিড়ের মধ্যে যাচ্ছি না অথবা বাসে, ট্রেনে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখছি। তবে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাকল্পে এটি শারীরিক দূরত্ব, সামাজিক দূরত্ব নয়। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে এটি হওয়া উচিত শারীরিক দূরত্ব, সামাজিক নয়। আলোচ্য প্রত্যয়টি সামাজিক দূরত্ব হওয়া উচিত নয় তার অন্যতম একটি কারণ সামাজিক দূরত্ব আমাদেরকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করবে, মানসিকভাবে একাকীত্ব সৃষ্টি করবে এটা কাম্য নয়। আমাদের উচিত শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা। বৈশ্বিক মহামারির এ সময়ে আমরা যদি সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করি তাহলে আমরা বিভিন্ন গ্রুপ, দল, সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো। এছাড়াও সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি হলে ক্রমে আমাদের সামাজিক সংহতি নষ্ট হতে শুরু করবে। ‘শারীরিক দূরত্ব’ কথাটি আমরা সাধারণত তখনই ব্যবহার করি যখন আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার ভয় থাকে।
সুতরাং করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সামাজিক দূরত্ব কথাটি সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ভুল ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। করোনা মহামারি থেকে খুব শীঘ্রই একেবারে মুক্ত হওয়া যাবে কথাটি বলা শক্ত। হয়তো অন্য ভাইরাসগুলোর সাথে যেভাবে মানিয়ে চলতে হচ্ছে করোনা ভাইরাসের সাথে সেভাবে চলতে হবে। তাই সামাজিক দূরত্ব প্রত্যয়টি সর্বদা ভুলভাবে ব্যবহৃত হতে থাকলে সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। তাই মহামারি প্রেক্ষিতে সামাজিক দূরত্ব কথাটি ব্যবহার করা ঠিক হবে না, শারীরিক দূরত্ব কথাটি ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সঠিক শব্দটি নির্বাচন করতে হবে।’
মুতাসিম বিল্লাহ মাসুম শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা