মির্জাগঞ্জ (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি : ২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর। এ দিনে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াল, ভয়াবহ, বীভৎস সামুদ্রিক ঝড় ‘সিডর’ আঘাত হানে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ, বরগুনাসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায়। ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের ১শ’ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসে এবং ঝড়টি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন এলাকা অতিক্রম করবে বলে মনে করা হলেও আকষ্মিকভাবে তার গতিপথ উত্তরমুখী থেকে উত্তর-পূর্বমুখী হতে শুরু করে।
সন্ধ্যা ৬টার পরেই ঝড়টি উত্তর-পূর্বমুখী হয়ে বরগুনা এবং বাগেরহাটের মধ্যবর্তী পায়রা, বিশখালী, হরিণঘাটা-বুড়িশ্বর নদীর বঙ্গোপসাগর মোহনা দিয়ে মূল ভূখন্ডে অগ্রসর হতে শুরু করে। এসময় সিডরের গতি ছিল প্রায় ৩শ’ কিলোমিটারে ও অধিক। ঝড়টির ব্যাপ্তি মাত্র দেড়শ’ কিলোমিটারে সীমাবদ্ধ থাকলেও তার দৈর্ঘ্য ছিল অনেক। চৌদ্দ বছর পার হয়ে গেলেও এই বিভিষীকাময় রাত্রির কথা আজও ভুলতে পারেনি স্বজন, সম্পদ, বসতি-ভিটে হারা উপকূলের মানুষ। নভেম্বরে আকাশে বিন্দু পরিমাণ মেঘের ঘনঘটা দেখলেই চোখ ছল ছল করে ওঠে এখানকার মানুষগুলোর। ভারী কোনো হাতুড়ীর আঘাতে এদের বুকের পাঁজরগুলি চূর্ণ বিচূর্ণ করে ভেঙ্গে দিচ্ছে এমন অনুভূতির কথা প্রকাশ করেন পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের মেন্দিয়াবাদ-হাজীখালী, চরখালী, গোলখালীর একাধিক মানুষ।
সিডরের বর্ণনা দিতে গিয়ে মেন্দিয়াবাদ গ্রামের বেলাল সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে লেখেন; এইদিনটাকে অনেক ভুলে গেলেও সেদিন এই গ্রামের মানুষগুলো খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলো।
১৫ নভেম্বর ২০০৭ সালের এই দিনে মেন্দিয়াবাদ চরখালী গোলখালী হাজীখালী ঘূর্ণিঝড়ে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমাদের বাড়িতে চারজন মারা গিয়েছিলো যার মধ্যে শাজাহান আকন এর মেয়ে সালমা সেদিন তার মেয়েকে বাঁচিয়ে রেখে সে না ফেরার দেশে চলে গেছে। জাহাঙ্গীর আকন এর মেয়ের নাতি থৈ থৈ করা পানিতে ডুবে মারা গেছে এবং মা ও ছেলে গাছের জঙ্গলে দুই পাশে দুই জন আটকে যায়।
সিডরের মৃত্যুমূখ থেকে বেঁচে আসা ফোরকান মল্লিক স্মৃতিচারণ করে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘হঠাৎ দেখতে পাই ঘরের টিনের চালার উপরে পানি। ছোট্ট দুই সন্তানকে দুই হাতে নিয়ে ঝাঁপ দেই পানিতে। মেয়েটি গলা ধরে। ছেলেটি আমার হাতে। মেয়েটি শক্ত হাতে গলা চেপে ধরে। তখন আমরা পানির ভিতরে। মেয়েটি এতো জোরে আমার গলা চেপে ধরছে যে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো। ছেলেটিকে হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে মেয়েটির হাত দুটি সজোরে ছুঁটিয়ে ফেলে দেই পানিতে। টের পাই ছেলেটি পা ধরে আছে। তুলে নেই হাতে। হঠাৎ মনে পড়ে আমার মেয়ে কই। ডুব দিয়ে খোজ করি। দেখি মাটির সাথে মিশে আছে। তুলে নেই। আমিও তন্দ্রা হারিয়ে ফেলি। আবিস্কার করি একটা রেইন্ট্রি গাছের মগডালে বসে আছি। মহান আল্লাহ মুখ তুলে না তাকালে বাঁচতে পারতাম না। আজ আমার সেই মেয়ে অনেক বড়। বিবাহ দিয়েছি। নাতনীও হয়েছে।
সিডরের প্রত্যক্ষদর্শীরা আরো বর্ণনা করেন, দুই দিন আগ থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সাথে দমকা হাওয়া বইছিলো। আবহাওয়া অধিদপ্তর ঘোষণা করে, ১২ নম্বর মহা বিপদ সংকেত। রাত দশটা-এগারোটা নাগাদ হঠাৎ মনে হচ্ছিলো বঙ্গোপসাগরের সব পানি যেনো যমদূতের মতো ভেসে আসলো ভূ খন্ডের উপর। কয়েক মিনিটে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো ঘর বাড়ি, হাজার হাজার মানুষ, উপরে ফেলে দিয়ে গেলো গাছ পালা। লন্ডভন্ড হয়ে গেলো সব। পরের দিন দেখা গেলো চারদিকে শুধুই ধ্বংসলীলা। উদ্ধার করা হলো লাশের পর লাশ। দাফনের জায়গা নেই, চরখালীতে রাস্তার পাশে গণকবর করে চাপা দেওয়া হলো বহু হতভাগার লাশ। স্বজন আর সম্বল হারিয়ে মেন্দিয়াবাদ, চরখালী, গোলখালীতে নিঃস্ব হয়ে গেলো হাজার হাজার মানুষ। সমগ্র উপকূলী অঞ্চলসমূহের মধ্যে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে মেন্দিয়াবাদ, চরখালী, গোলখালী, হাজীখালীর উপর সিডর প্রকোপ এতোট ভয়াবহ ছিলো যে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শনে রাস্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিবর্গসহ তাৎক্ষণিকভাবে চরখালীতে ছুটে আসলেন তৎকালীন জাতি সংঘের মহাসচিব।