ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর শহরে প্রায় এক লক্ষ বাসিন্দার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে পচা আবর্জনার দুর্গন্ধে। ছোট্ট এ মফস্বল শহরটির টেংকের পূর্বপাড়সহ প্রায় সকল পাড়া-মহল্লার আনাচেকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ময়লা-আবর্জনা, যেগুলোর সিংহভাগই গৃহস্থালি ও হোটেল-রেস্তোরাঁর পচনশীল বর্জ্য পদার্থ এবং ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের ক্ষতিকর বর্জ্য তো রয়েছেই।
গুরুত্বপূর্ণ সড়কের মোড়ে মোড়ে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে-পেছনে, বাজারসংলগ্ন জায়গায়, পার্ক কিংবা অবকাশ যাপনের জায়গা এমনকি লোকজনের বাসাবাড়ির সামনেও দিনের পর দিন সেসব বর্জ্য পড়ে থাকে। কোনো কোনো বাড়ির সামনে বর্জ্যের স্তূপ পড়ে আছে মাসের পর মাস ধরে। উৎকট ও অসহ্য দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। মশা-মাছিসহ নানা রকমের বিষাক্ত ও ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের অবাধ বংশবিস্তার চলছে।
পৌরবাসীর অভিযোগ, দুর্গন্ধময় পচা আবর্জনায় ভরা রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে তাদের বমি আসে, মাথা ঘোরায় এবং শিশুরা খুবই অস্বস্তি বোধ করে। এমনকি আবর্জনার দুর্গন্ধে কোন কোন এলাকার বাসাবাড়িতে থাকাও তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে উঠেছে। শহরটির বাসিন্দারা অনেকবার লিখিতভাবে ও মৌখিকভাবে তাদের এই দুর্ভোগের কথা পৌরসভার কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বাসিন্দারা অভিযোগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। কিন্তু পৌর কর্তৃপক্ষ ভ্রুক্ষেপহীন রয়েছে। তবে এদিকে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে প্রতিদিন উৎপাদিত হচ্ছে নতুন নতুন বর্জ্য।
ইতিমধ্যে জমে ওঠা বর্জ্যের স্তূপের আকার দিন দিন বড় হচ্ছে। ফলে আরও অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠছে শহরটির পরিবেশ। উৎকট ও অসহনীয় দুর্গন্ধের তাৎক্ষণিক দুর্ভোগের পাশাপাশি এই দূষিত পরিবেশ সেখানকার শিশুসহ সব বয়সী মানুষের জন্য যে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সৃষ্টি করছে, তা আরও গুরুতর বিষয়।
অনুকরণীয় হতে পারে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার শহর যশোর: যশোর শহরে বর্জ্য এখন আর বোঝা নয়, সম্পদ। সেখানে বর্জ্য থেকে উৎপাদিত হচ্ছে বিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস ও উন্নতমানের কম্পোস্ট সার। যশোর শহরের কেউ কখনও স্বপ্নেও ভাবেননি, বাসায় পাইপলাইনে রান্নার গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। পরিমাণে অল্প হলেও এখন এই স্বপ্ন দেখছেন জেলার ঝুমঝুমপুর গ্রামের দুইশ’ পরিবার, যার একমাত্র কারণ আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এডিপির সহায়তায় প্রায় ২৪ কোটি টাকায় এ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত করে যশোর পৌরসভা।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পৌর কর্তৃপক্ষের দায় কতটুকু: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ (১) ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, জনস্বাস্থের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন। আরও আশার কথা এই যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে একটি ধারা যোগ করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে সংযোজিত নুতন এই ১৮ (ক) ধারায় বলা হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন’।
বাংলাদেশে পৌর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সর্ম্পকিত নিম্নলিখিত আইন, উপ-আইন, আদেশ ও বিধিমালাসমূহ রয়েছে:
পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত আইন, বিধিমালা ও আদেশ: ১) বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫। ২) বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন), ২০০০। ৩) বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন), ২০০২। ৪) বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন), ২০১০। ৫) পরিবেশ আদালত আইন, ২০০০। ৬. পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭। ৭. পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা (সংশোধিত ফেব্রুয়ারি), ১৯৯৭। ৮) পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা (সংশোধিত আগস্ট), ১৯৯৭। ৯) পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ (সংশোধিত ২০০৫)। ১০) পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ (সংশোধিত ২০১০)। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিধিমালা ও আদেশ : ১) চিকিৎসা-বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা, ২০০৮। ২) বিপদজনক বর্জ্য ও জাহাজ ভাঙ্গার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১১। ৩) ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক পণ্য হইতে সৃষ্ট বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১৭ (খসড়া)। ওজোনস্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যসংক্রান্ত বিধিমালা ও আদেশ : ১) ওজন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্য (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৪ (২০১৪ সংশোধনীসহ)।
অন্যান্য : ১. লেড-এসিড ব্যাটারী পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের পাশাপশি নিম্নে উল্লেখিত বেশ কিছু আইন রয়েছে যা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সর্ম্পকিত : পশু জবাই ও মাংসের মান নিয়ন্ত্রন আইন, ২০১১ (এই আইনে জবাইখানার বাইরে পশু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়েছে যার ফলে পশুবর্জ্য যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়বে না এবং এই আইনের অধীনে প্রণীত বিধি অনুয়ায়ী জবাইখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে।)। স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯। স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯।
উল্লেখ্য বর্জ্য সংগ্রহের কমহার, বর্জ্য সংগ্রহ ও স্থানান্তরের জন্য পরিবহনের অভাব, বর্জ্য পরিশোধন, রিসাইক্লিং ও ফেলার সুবিধার অভাব এসব জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে। পূর্বে ময়লা বা বর্জ্য বলতে ‘মূল্যহীন’ কিছু বস্তুসমূহকে বোঝানো হতো কিন্তু বর্তমানে গৃহস্থালী, শিল্প, বাণিজ্যিক, নির্মাণ কর্মকান্ডে সৃষ্ট বর্জ্য বা ময়লাকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর কর্তৃপক্ষের নিকট বাসিন্দাদের প্রত্যাশা শীঘ্রই শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি স্থায়ী ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি শহরবাসীরর কাছে দৃশ্যায়ন করবেন। শহরতলীর ছয়বাড়িয়ায় রাস্তার পাশেই অস্থায়ী ডাম্পিং স্টেশন।
নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা বিষয়ক সামাজিক সংগঠন ‘নোঙর বাংলাদেশ’র ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, পুরো পৌর এলাকাই এখন ময়লার ভাগার, আমি নিশ্চিত সারা শহরে পৌরসভা কর্তৃক সৃষ্ট ময়লা আবর্জনার যে কার্যক্রমটি চলছে তা কোন মহল ভালো চোখে দেখছেন না এবং এটা কোন সভ্য জাতি মেনে নেওয়ার কথা নয়! শহরে দুটি বিষয় প্রতীয়মান, একটি নাকচিপা-দমবন্ধ করে স্থান ত্যাগ করা, আরেকটি হলো পৌর কর্তৃপক্ষকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা! আমি জানিনা পৌর কর্তৃপক্ষ বিষয় দুটি কিভাবে নিচ্ছেন! কোথাও কোথাও ময়লা আবর্জনা দিয়ে নদী, খাল, পুকুর-জলাশায় ভরাটেও সহযোগিতার অভিযোগ শোনা যায় পৌরসভার ট্রাক-ট্রলি দিয়ে। পৌর এলাকায় এধরণের কার্যক্রম আমরা প্রত্যাশা করি না। আমরা জানতে পেরেছি ছয়বাড়িয়ায় ড্রাম্পিং স্টেশনের কাজ চলছে তাও ধীরগতিতে! ময়লা-আবর্জনা নিয়ে রীতিমতো ব্যবসা করছে উন্নত দেশগুলো অথচ আমাদের হিমসিম খেতে হচ্ছে! এখনই সঠিক পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে সরকারের সকল উন্নয়ন ভেস্তে যাবে। আশা করি পৌর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আন্তরিকতার সাথে বিবেচনা করবেন।
এবিষয়ে বক্তব্য জানতে দৈনিক স্বাধীন বাংলা’র পক্ষ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার মেয়র মিসেস নায়ার কবিরকে একাধিক বার মোবাইল ফোনে কল করেও বরাররের মতো কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।