বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রাম সহ্য করে ধীরে ধীরে তিনি পূর্ব বাংলার জনগণকে সংগঠিত করে চূড়ান্ত বিজয়ে উপনীত হন। বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙালি বঙ্গবন্ধুর আপসহীন নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করে বিশ্বের বুকে অনন্য নজির স্থাপন করেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনের মাধ্যমে নেতৃত্বের সামনের কাতারে চলে আসেন তৎকালীন ছাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১১ মার্চ ১৯৪৮ প্রথম ধাপের আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে ছাত্রদের সংগঠিত করেন। দ্বিতীয় ধাপ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন তারই পরিকল্পনা ও নির্দেশিত পথে এগিয়ে চলে।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। ওই অধিবেশনে কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারের পক্ষে একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন, পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষের ভাষা বাংলা। কাজেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিৎ। ২৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী তীব্র ভাষায় এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। দুঃখের বিষয়, মুসলিম লীগ দলের কোনো বাঙালি সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে সমর্থন করে কথা বলেননি। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও উর্দুর পক্ষ অবলম্বন করেন। গণপরিষদে বাংলা ভাষাবিরোধী সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে ঢাকায় ছাত্রসমাজ ২৬ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট পালন করে। বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২ মার্চ ফজলুল হক হলে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের একটি সভা আহ্বান করা হয়। কামরুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব বাংলায় ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ওইদিনে ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করা হয়। এ সভাতেই ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ কে সর্বদলীয় রূপ দেওয়া হয়। ১৯৪৮ এর ১১ মার্চ সকাল ১০টায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় ছেড়ে দেয়া হয়। আটক দিনগুলো সম্পর্কে তিনি বলেছেন ‘জেলের... দেয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল ১০টায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত আর চারটায় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হত না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘বন্দী ভাইদের মুক্তি চাই’ প্রভৃতি স্লোগান।
১৯৪৮ এর ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত আমতলায় শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে বাংলা ভাষার দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মিটিং শেষে তিনি ছাত্রদের নিয়ে স্মারকলিপি দেন। এ বিষয়ে তিনি বলছেন, ‘১৬ তারিখ আমতলায় এই প্রথম আমাকে সভাপতিত্ব করতে হলো।’ রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন শুধু ঢাকায়ই সীমাবদ্ধ ছিল না, দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিৎ। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দু দুটি রাষ্ট্রভাষা কার দাবি করেছিলাম।’ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় সাত মাস পর ১৯ মার্চ পাকিস্তানের জাতির পিতা গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে আসেন। ২ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতার অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করে তিনি ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ শেখ মুজিব তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘আমরা প্রায় চার-পাঁচশত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সে সভায়। অনেকে হাত তুলে জানিয়ে দিল মানি না, মানি না।’ ছাত্রসমাজের এ দ্বিধা দ্বন্দ্বের সময় কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে জিন্নাহর অবস্থানকে সমর্থন করে বক্তব্য দেন। এ সময় শেখ মুজিবের নেতৃত্বের দূরদর্শিতা লক্ষ করা যায়। তিনি বলেন, ‘নেতা অন্যায় করলেও ন্যায়ের স্বার্থে তার প্রতিবাদ করতে হবে। বাংলা ভাষা শতকরা ৫৬ জন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাবো।’ সাধারণ ছাত্ররা শেখ মুজিবকে সমর্থন করলেন। এরপর ভাষার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন, শোভাযাত্রা অব্যাহত থাকে।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খাজা নাজিমুদ্দিন প্রথম ঢাকায় আসেন ১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারি। ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ তার এ ঘোষণার পর জনগণ ১৯৪৮ সালের চেয়েও ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মঘট পালিত হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা করে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি। ওইদিন সন্ধ্যায় ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র ও তরুণদের বাইরে এটিই প্রথম সভা, যেখানে বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতারা সমবেত হন। তরুণ রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমদ তখন জেলে বন্দী ছিলেন। অসুস্থতার ভান করে শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলেন। হাসপাতাল থেকেই তিনি গোপনে মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুস সামাদ আজাদ, গোলাম মাওলা প্রমুখের সঙ্গে সভা করে জানিয়ে দেন ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে, হরতাল হবে এবং অ্যাসেম্বলি ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হবে।
এদিকে শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমেদ তাদের দীর্ঘ কারাবাস থেকে মুক্তির জন্য ১ ফেব্রুয়ারি সরকারের কাছে আবেদন করেন এবং জানান, ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাদের মুক্তি দেওয়া না হলে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তারা জেলের ভেতর অনশন ধর্মঘট করবেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি তাদের দু’জনকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন সাহেব ফরিদপুর জেলেই অনশন করলেন। দু’দিন পর অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে নিয়ে তাদের জোর করে নল দিয়ে তরল খাবার দেওয়া হলো। এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের অনশনের বিষয়টি ২০ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য আনোয়ারা খাতুন মুলতুবি প্রস্তাব হিসেবে উত্থাপন করলে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন নির্লজ্জভাবে এর বিরোধিতা করেন।
ইতোমধ্যে ঢাকায় ২০ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টার দিকে মাইকে ১৪৪ ধারা জারি করে পরবর্তী এক মাস ঢাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১০টা থেকে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমা হতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা কমিটির আহ্বায়ক আব্দুল মতিন জ্বালাময়ী বক্তৃতায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্তমত দশজন দশজন করে ছাত্র মিছিল করে অ্যাসেম্বলি ভবনের দিকে যেতে থাকে। বেলা প্রায় সোয়া ৩ টার সময় এমএলএ ও মন্ত্রীরা মেডিক্যাল কলেজের সামনে দিয়ে পরিষদ ভবনে আসতে থাকেন। পুলিশ বেপরোয়াভাবে ছাত্রদের ওপর আক্রমণ চালায়। বাধ্য হয়ে ছাত্ররা ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। পুলিশ ছাত্রদের লক্ষ করে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই রফিক উদ্দিন, আবদুল জব্বার শহিদ হন এবং আরও ১৭ জন গুরুতর আহত হন। রাতে আবুল বরকত মারা যান।
২১ ফেব্রুয়ারি রাতে শেখ মুজিব জেলে বসে ঢাকার ছাত্রদের ওপর গুলির খবর পেলেন। ফরিদপুরেও হরতাল হয়েছে। অবশেষে ২৭ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির ঘোষণা দিয়ে অনশন ভঙ্গ করানো হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান তাকে নিয়ে যেতে জেলগেটে আসেন। প্রকৃতপক্ষে এদেশে ১৯৪৭ থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্র গঠনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকাই তাঁকে এদেশের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছে।
লেখক : নাজমুন নাহার জেমি ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।