স্বাধীন বাংলা প্রতিবেদক : নতুন করে দাম বাড়ানো হয় সয়াবিন তেলের। শনিবার থেকে নতুন দাম কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও বৃহস্পতিবার দাম বাড়ানোর ঘোষণার পরপরই বাজার থেকে প্রায় ‘উধাও’ হয়ে যায় রান্নার এই গুরুত্বপূর্ণ পণ্যটি। সরজমিন রাজধানীর কাওরান বাজারসহ বেশকিছু এলাকায় বেশির ভাগ দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি। কিছু দোকানে মিললেও দোকানি হাঁকেন বাড়তি দাম। আবার তা ক্রেতার চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। অথচ ভোজ্য তেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের দাবি বাজারে তেলের কোনো সংকট বা ঘাটতি নেই।
এদিকে সয়াবিন তেলের দাম এক লাফে ৩৮ টাকা বাড়ানোর পর এবার সরিষার তেলের দামও বাড়ছে। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই খোলা তেল লিটারে ৬০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন মিল মালিকরা। আগামী রোববার থেকে নতুন দর কার্যকর হতে পারে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১৭-১৮ সালে দেশে তৈল বীজের মোট উৎপাদন হয়েছিল ১০.২৬ লাখ টন, যা ওই বছরের মোট চাহিদার মাত্র ৩৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন হয়েছিল ৯.৭২ লাখ টন, যা ওই বছরের মোট চাহিদার মাত্র ১১.৭৫ শতাংশ
বাকিটা আমদানি করে বাজারে সরবরাহ করা হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, গত মার্চ ও এপ্রিল- এই দুই মাসে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৯২ হাজার টন। আমদানি কমেছে পাম তেলেরও। গত মার্চ ও এপ্রিল- দুই মাসে পাম তেল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৩১ হাজার টন। একই সময়ে বাজারজাত হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয় ২ লাখ ৬৭ হাজার টন। আর বাজারজাত হয় ২ লাখ ৯৮ হাজার টন। সব হিসাবে আগের তুলনায় আমদানি ও বাজারজাত দুটোই কমেছে।
এনবিআর তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০২১ সালে ইন্ডাস্ট্রিয়াল (শিল্প খাতে) সুবিধায় আমদানি হওয়া ১৮ লাখ ১৮ হাজার টন (পরিশোধিত ও অপরিশোধিত) ভোজ্য তেলের শুল্কায়ন করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। শুল্কায়ন বিবেচনায় টিকে গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপের অধীনে আমদানি হয়েছে ভোজ্য তেলের ৮৮ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার দাম বাড়িয়ে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯৮ টাকায় আর প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৮০ এবং পাম সুপার ১৭২ টাকা দরে বিক্রি করতে ঠিক করে দিয়েছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন। ভোজ্য তেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান মালিকদের এই সংগঠনের ঘোষণা অনুযায়ী শনিবার থেকে নতুন দামে ভোজ্য তেল বিক্রির কথা। তবে ক্রেতাদের অনেকেই ভোজ্য তেল কিনতে এসে না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সয়াবিন তেল না পেয়ে তাদের কেউ কেউ সরিষার তেল, রাইসবার্ন, সূর্যমুখী তেল কিনেছেন। তবে এসব তেলের দাম বেশি হওয়ায় হাতেগোনা কিছু ক্রেতাকেই সেগুলো কিনতে দেখা গেছে।
ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. সাইদুর রহমানের মতে, আমদানিনির্ভরতা নয়, তৈলবীজের উৎপাদন বাড়ানো জরুরি। দেশে ভোজ্য তেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৫২ লাখ টন। এর অধিকাংশই আমদানিনির্ভর। বছরে ৪৮ লাখ টন ভোজ্য তেল আমদানি করতে হয়।
শীর্ষ আমদানিকারক টিকে গ্রুপ, সিটি গ্রুপ ও মেঘনা গ্রুপের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা যথেষ্ট পরিমাণে তেল সরবরাহ করছেন। সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, তারা প্রতিদিন ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টন সয়াবিন ও পাম তেল সরবরাহ করেন। গত এপ্রিলের ২৬ দিনে সয়াবিন ও পাম তেল মিলিয়ে ৪৭ হাজার ৭৮৮ টন সরবরাহ করেছি। তার প্রশ্ন এই তেল কোথায় যায়?
গরিবের বাজারে ২৪০ টাকা লিটার তবুও মিলছে না সয়াবিন রাজধানীর তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ায় অবস্থিত গরিবের বাজার। অসহায় আর খেটে খাওয়া মানুষের সুপারশপ। এখানে ১০ টাকায়ও পণ্য মেলে। ছোট ছোট প্যাকেটে হরেক রকম নিত্যপণ্যের পসরা সাজানো থাকে এই বাজারে। যার প্রতি প্যাকেট মূল্য ৫ টাকা, ১০ টাকা বা ২০ টাকা। সারা দেশে ভোজ্য তেলের সংকটেও গরিবের বাজারের দুই দোকানে মিললো খোলা সয়াবিন। এর মধ্যে এক দোকানির নাম হাছিনা বেগম। প্রতিবেদক তার কাছে ১০ টাকার তেল চাইতেই যেন আকাশ থেকে পড়লেন এই বিক্রেতা। বললেন, ‘এখন ১০-২০ টাকার সয়াবিন তেল আছে? তেলের দাম আড়াইশ’। ৬০ টাকার নিচে তেল নেই। ২৫০ গ্রাম ৬০ টাকা।’ অথচ এক বছর আগেও এখান থেকে ১০ টাকা দিয়ে তেল কিনতে পারতেন নিম্নআয়ের ক্রেতারা। তবে এখন সেই সুযোগ আর নেই।
হাছিনা বেগম এক কেজি খোলা সয়াবিন তেলের দাম হাঁকালেন ২৪০ টাকা। তবুও তার কাছে পর্যাপ্ত তেল নেই। তিনি বলেন, ‘সকালে ৩ ঘণ্টা কাওরানবাজার ঘুরছি। ৩০ কেজি গেলান লইয়্যা ঘুরতে ঘুরতে অবস্থা কাহিল হইয়্যা গেছি। কেউ তেল দিতে চায় না। পরে ঘরে খাওয়ার কথা বলে পাঁচ কেজি কিনে আনছি। এখন তা বেচতাছি। ২১৬ টাকা কেজি কিনে আনছি। গাড়িভাড়া দিয়া ২২২ টাকা পড়ছে। ’
তার পাশেই ছোট আরেকটি দোকান মাহাবুবের। দোকানে ছোট ছোট প্যাকেটে ডাল, হলুদ-মরিচের গুঁড়া, ডাবলি, ছোলা, বাদাম, সরিষাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য সাজিয়ে রেখেছেন। এসব পণ্যের মূল্য মাত্র ১০ টাকা করে। তিনি জানান, গরিব মানুষের সুবিধায় এগুলো বেধে রাখা হয়। যারা বেশি টাকা দিয়ে পণ্য কিনতে পারেন না তারা এই পণ্যগুলো কিনেন। তবে ভোজ্য তেলের জন্য কোনো প্যাকেট করেননি তিনি। জানতে চাইলে মাহাবুব বলেন, ‘এত দামের মধ্যে আবার তেল ১০ টাকা প্যাকেট! পাল্লায় ওজনও দেয়া যায় না। বিক্রি করবো কীভাবে।’ গরিবের বাজারের এই বিক্রেতার কাছেও পর্যাপ্ত তেল নেই। যতটুকু আছে তা অল্প অল্প করে বিক্রি করছেন। তিনি সর্বনিম্ন ৮৫ গ্রাম তেল বিক্রি করছেন ২০ টাকায়। এতে এক কেজি সয়াবিন তেলের দাম দাঁড়ায় প্রায় ২৪০ টাকা। তবে শুক্রবার কাওরানবাজার থেকে তার তেল কিনতেই ২১০ টাকা খরচ হয়েছে বলে দাবি করেন। মাহাবুব জানান, ঈদের আগে থেকেই হুনছি দাম বাড়বো। এখন বাড়াই দিছে। কাওরানবাজার থেকে শুক্রবার ২১০ টাকায় কিনছিলাম। আজ শুনি হোলসেল বিক্রি করে ২২০ টাকা। বোতলের তেলও রাখতে পারি না। রোজার আগের থেকে কোম্পানি তেল দেয়া বন্ধ করে দিছে।
এই বাজারের আশেপাশে কোথাও ভোজ্য সয়াবিন তেল মেলেনি। খোরশেদ জেনারেল স্টোরের সাইফুল ইসলাম জানান, তার দোকানে ঈদের আগে থেকেই তেল শেষ হয়েছে। এরপর নতুন করে তেল কিনতে পারেননি। কোম্পানির কাছে তেল চেয়েও পাননি। পাইকারদের কাছ থেকেও খোলা তেল কিনতে পারেননি। তিনি বলেন, পাইকারগো কাছে গেলে এক বোতল তেল ধরায় দেয়। এই তেল এনে কি করবো। এখন দাম ১৯৮ টাকা, তাও তেল নেই। কোম্পানির সঙ্গে কথা হইছে। এখন দাম বাড়ছে, তাই তারা বলছে তেল দিবে।’
নতুন করে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ করার পরও দোকানে পণ্যটি না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ক্রেতারা। শফিক মিয়া নামের এক ক্রেতা বলেন, ‘ঈদের আগে তেল কিনেছিলাম। এরপর দু’দিন ঘুইরা গেছি। তেল পাইনি। আজকে পাওয়া যাবে বলছিল। কিন্তু তাও পাইলাম না।’ ফরিদ উদ্দিন নামের আরেক ক্রেতা বলেন, তেলের দাম বাড়ানোর জন্য মাঝেমধ্যেই তেল আটকে রাখে। দাম বাড়ার পর আবার সব ঠিক হয়। দোকানদাররা বলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ছে। আমাদের আয় তো আন্তর্জাতিক বাজারের মতো বাড়ে না।
এ ব্যাপারে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সয়াবিন তেলের সরবরাহ বৃদ্ধি করার জন্য সরকারের নিজস্ব কোনো সক্ষমতা নেই। সরকারকে নির্ভর করতে হয় যারা সয়াবিন রিফাইন করে তাদের ওপর। সরকার তাদের প্রস্তাবিত মূল্যই অনুমোদন দেয়। আমরা আশা করি এই নির্ধারিত দামেই বাজারে তেল পাওয়া যাবে। যদি পাওয়া না যায় তাহলে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’