স্বাধীন বাংলা ডেস্ক দেশের অর্থনীতিতে এখনও করোনার প্রভাব রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থায় চলছে সংকট। ফলে পণ্যমূল্যে বড় ধরনের ঊর্ধ্বগতি মানুষকে বিপাকে ফেলেছে। আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে চলতি হিসাবে রেকর্ড ঘাটতি তৈরি হয়েছে। কমে গেছে রেমিট্যান্স। এতে বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে সামষ্টিক অর্থনীতি। আসছে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী এসব সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন। তবে সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে সমন্বিত পদক্ষেপ তেমন একটা চোখে পড়েনি। বিশেষত মূল্যস্ম্ফীতি মোকাবিলায় বাজেটে জোরালো পদক্ষেপ নেই; বরং উল্টো জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম পর্যায়ক্রমে বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে।
অবশ্য অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণই প্রধান চ্যালেঞ্জ। ডলার সংকটের কথাও বলেছেন। তবে প্রধান এ দুটি সংকট মোকাবিলায় বাজেটে তেমন সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেই। আবার মূল্যস্ম্ফীতির চাপ মোকাবিলায় দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষকে জোরালো সমর্থনের উদ্যোগ নেই। গরিব মানুষের জন্য সরকারের ভাতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়েনি। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে কম দামে চাল পাওয়ার সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর কোনো ঘোষণা দেননি। আবার এই চালের কেজি ১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫ টাকা নির্ধারণের ঘোষণা দিয়েছেন। এখানে সুবিধাভোগী পরিবারের সংখ্যা আগের মতো ৫০ লাখই রয়ে গেছে। অন্যদিকে মূল্যস্ম্ফীতির চাপের কারণে সাধারণ ব্যক্তি করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর যে দাবি ছিল, সেদিকেও দৃষ্টি দেননি অর্থমন্ত্রী। মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভর্তুকি ছাড়া বিশেষ কোনো কৌশল বাজেটে নেই। অর্থমন্ত্রী কর্মসংস্থান বাড়ানোর প্রয়োজনীতার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কর্মসংস্থান কীভাবে বাড়ানো হবে, তার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেননি। রপ্তানি খাতকে এর আগে দেওয়া বিভিন্ন সহায়তার উদাহরণ দিয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধের প্রভাবে যখন তৈরি পোশাকের অর্ডার কমে আসছে, তখন রপ্তানি খাতে উৎসে কর দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এ প্রস্তাব কার্যকর হলে রপ্তানি খাত আরও সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। আগে থেকে পোশাক খাতে করপোরেট কর কম ছিল। এবার অর্থমন্ত্রী অন্যান্য রপ্তানিমুখী খাতে করপোরেট কর কমিয়ে সমতা এনেছেন।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আমদানি সহনীয় পর্যায়ে রাখা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা হবে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজনীতার কথা বলেছেন। অথচ বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাতের প্রাক্কলন আগের মতোই আছে। ফলে বিনিয়োগে জোর দেওয়ার বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর অভিপ্রায় নিয়ে সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠবে। অন্যদিকে সরকারের ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা অনেক বাড়ানো হয়েছে, যা মূল্যস্ম্ফীতিকে উস্কে দিতে পারে।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আমদানিনির্ভর এবং কম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয় বন্ধ করা বা স্থগিত রাখা হবে। তবে কম গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী নয় এমন বেশ কিছু প্রকল্প এডিপিতে রয়েছে। রাজনৈতিক বা অন্য কারণে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে আমদানি ব্যয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা ও মূল্যস্ম্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
বিনিয়োগের জন্য করপোরেট করে ছাড়সহ কিছু কর সংক্রান্ত উদ্যোগ থাকলেও ব্যবসা ও বিনিয়োগের জন্য সংস্কারমূলক সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের ঘাটতি রয়েছে। কর্মসংস্থানের জন্য প্রণোদনা ও নীতি সহায়তারও ঘাটতি আছে। রপ্তানির জন্য লজিস্টিকস উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য লক্ষ্যভিত্তিক উদ্যোগ নেই। বর্তমানে বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে রপ্তানি বাজারে বেশ কিছু ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এসব ঝুঁকি প্রশমনে এ খাতে বিশেষ নজর দেওয়া হয়নি।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে দেশের ৫১তম বাজেট পেশ করেন। এটি অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুস্তফা কামালের চতুর্থ এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ১৪তম বাজেট। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম `কভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন`। বাজেট বক্তব্যের শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ বঙ্গমাতাসহ ১৫ আগস্টের কালরাত্রির সব শহীদকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে `শেখ হাসিনা :এক ফিনিক্স পাখির গল্পগাথা` শিরোনামে প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের বিভিন্ন অর্জনের তথ্য দেন।
আগামী অর্থবছরের বাজেটের প্রাক্কলিত ব্যয় ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে জিডিপির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয়ের পরিকল্পনা ছিল। যদিও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে ব্যয়ের প্রাক্কলন চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৮৫ হাজার কোটি টাকা বেশি হলেও অর্থনীতির আকার বিবেচনায় একে সম্প্রসারণমূলক বা উচ্চাভিলাষী না বলে কিছুটা রক্ষণশীল বলা যেতে পারে। তবে আগামী অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের দিকে বিশেষত, ব্যাংকের দিকে নির্ভরতা বাড়ানোর প্রাক্কলন করা হয়েছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ চাহিদা বাড়লে সরকারের ঋণের কারণে উদ্যোক্তারা যদি পর্যাপ্ত ঋণ না পান, তাহলে কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে।
বাজেট বরাদ্দের অংশ হিসেবে কৃষি ও শিক্ষায় আগের বছরের চেয়ে বরাদ্দ বেড়েছে। বেশিরভাগ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়লেও বাজেট কিংবা জিডিপির অংশ হিসেবে চলতি অর্থবছরের চেয়ে কম। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ। শিক্ষা খাতে মাত্র ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। যদিও অর্থমন্ত্রী অগ্রাধিকারের মধ্যে এ দুটি খাতের নাম উল্লেখ করেছেন।
কভিডের প্রভাব কি কেটে গেছে :অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন, করোনার প্রভাব কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে দেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে এসেছে। জীবন ও জীবিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করা গেছে। অথচ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সাম্প্রতিক সময়ে বলেছে, বিশ্বব্যাপী কভিড থেকে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার জরিপ বলছে, মানুষের আয়, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কভিডের প্রভাব এখনও রয়ে গেছে। সম্প্রতি পিপিআরসি ও বিআইজিডির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, কভিডের কারণে এখনও দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ আগের অবস্থায় যেতে পারেননি। কভিড ও মূল্যস্ম্ফীতির প্রভাবে দেশের তিন কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে নতুন দরিদ্রদের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। তিনি দারিদ্র্যের হারের যে পরিসংখ্যান দিয়েছেন, তা কভিডের আগের।
ব্যবসায়ীরা কেউ খুশি, কেউ নন :বাজেটের বিভিন্ন কর, শুল্ক্ক ও ভ্যাট প্রস্তাবে ব্যবসায়ীদের কারও কারও জন্য সুখবর আছে। আবার দুঃসংবাদও আছে কোনো কোনো শ্রেণির জন্য। রপ্তানি বিলের ওপর উৎসে কর বাড়ানো হয়েছে, যা রপ্তানিকারকদের বিপাকে ফেলবে। তবে পোশাকের মতো অন্যান্য রপ্তানি খাতের করপোরেট কর কমিয়ে আনার পদক্ষেপ স্বস্তিদায়ক। বেশ কিছু পণ্যে নতুন করে শুল্ক্ক ও ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, যা এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। আবার কিছু ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে উৎসে কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে উৎসে কর কমানো হয়েছে। নতুন উদ্যোগ বা স্টার্টআপের জন্য কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে করপোরেট কর কমানো হয়েছে, যা বিনিয়োগের জন্য ইতিবাচক। অন্যদিকে বিদেশ থেকে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে `দায়মুক্তি` ঘোষণা সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করবে।
আয়ের লক্ষ্যমাত্রা :আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক অনুদানসহ মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব সংগ্রহ ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল ও সংশোধিত বাজেটে যা ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা ছিল। নতুন অর্থবছরে মোট কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের যে প্রবণতা রয়েছে, তাতে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় রয়েছে।
ব্যয় পরিসংখ্যান :আগামী অর্থবছরে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা ছিল। সংশোধিত বাজেটে যা কমিয়ে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। নতুন অর্থবছরে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ১১ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা।
ঘাটতি :আগামী অর্থবছরে অনুদানসহ ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা, যা দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে। অনুদানসহ বাজেট ঘাটতি হবে জিডিপির ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আর অনুদান বাদে ঘাটতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে সরকার বৈদেশিক উৎস থেকে নিট ঋণ নিতে চায় ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নিতে চায় ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা।
সংসদের পরিস্থিতি :করোনাভাইরাস মহামারি কাটিয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক পরিবেশে এবার বাজেট উপস্থাপিত হয়েছে। অবশ্য করোনাকালের বিগত দুটি বাজেট অধিবেশনের মতো এবারও দর্শক গ্যালারিতে কোনো অতিথিকে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি। সর্বত্র ছিল স্বাস্থ্যবিধি মানার বাধ্যবাধকতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভার বিশেষ সভায় বাজেট অনুমোদনের পর ওই প্রস্তাবে সই করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সংসদকক্ষে একসঙ্গে হেঁটে ঢোকেন সংসদনেতা শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল।
|