সরকারি এক সংস্থাই ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ৪৬৮ কোটি টাকা
21, July, 2022, 10:39:55:PM
স্বাধীন বাংলা প্রতিবেদক সরকারের স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বিগত পাঁচ বছরে প্রায় ৪৬৮ কোটি টাকার মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। বিভিন্ন সেবার বিপরীতে দাবিকৃত ওই ভ্যাট আদায়ে চিঠির পর চিঠি দেওয়া হলেও দীর্ঘদিন ধরেই তা বকেয়া পড়ে আছে। বকেয়া বা ফাঁকি দেওয়া এই ভ্যাট আদায় করতে না পেরে রাজস্ব ঘাটতির অপবাদ নিতে হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। এনবিআরের মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অনুসন্ধানে ওই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির তথ্য উদঘাটিত হয়েছে। যদিও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি এনবিআর যে সময়ের ভ্যাটের কথা বলছে, সে সময়ে ভ্যাট বিভাগের কোনো নির্দশনা ছিল না।
ফলে বন্দর কর্তৃপক্ষ সেবাগ্রহীদের কাছ থেকে কোনো ভ্যাট সংগ্রহ করেনি। তাই ভ্যাট বিভাগ যে ভ্যাট দাবি করছে তা অযৌক্তিক। যখন থেকে এনবিআরের ভ্যাট সংগ্রহের আদেশ জারি করা হয়েছে, তারপর থেকে ভ্যাট সংগ্রহ করেছি এবং সরকারি কোষাগারে জমাও দেওয়া হয়েছে। আদেশের আগে ভ্যাট সংগ্রহের প্রশ্ন ছিল না। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক অন্যদিকে চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার মোহাম্মদ আকবর হোসেন সই করা চিঠি বলছে ভিন্ন কথা। গত ১৪ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন সেবা খাতের বিপরীতে ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে খাতওয়ারী নিরীক্ষা করে উদঘাটিত অপরিশোধিত মূসক বাবদ ৭৬ কোটি ২০ লাখ ৬০ হাজার ১৯০ টাকা আদায়ে ২০১৮ সালের ১ জুলাই দাবিনামা জারি করা হয়।
একই প্রক্রিয়ায় ওই একই দিনে ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের বকেয়া হিসাবে ৮৬ কোটি ৫৮ লাখ ৬৫ হাজার ১১০ কোটি টাকার ভ্যাট আদায়ে চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হয়। এছাড়া মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠানের ২০১৫-২০১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছর পর্যন্ত নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করে ৩০৪ কোটি ৯৯ লাখ ২৮ হাজার ৫১৬ টাকা অপরিশোধিত ভ্যাটের তথ্য উদঘাটন করে। বকেয়া রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রতিষ্ঠানের শুনানি গ্রহণ করে চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হয়। ওই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অনুক‚লে তা পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
আর তিনটি চূড়ান্ত দাবিনামায় অপরিশোধিত মূসকের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬৭ কোটি ৭৮ লাখ ৫৩ হাজার ৮১৬ টাকা। ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে দ্রুত তা পরিশোধের অনুরোধ করেছে ভ্যাট কমিশনারেট। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রাম ভ্যাট অফিস থেকে যে ভ্যাট দাবি করা হয়েছে, সেটা এখনও বকেয়া রয়েছে। যখন থেকে এনবিআরের ভ্যাট সংগ্রহের আদেশ জারি করা হয়েছে, তারপর থেকে ভ্যাট সংগ্রহ করেছি এবং সরকারি কোষাগারে জমাও দেওয়া হয়েছে। আদেশের আগে ভ্যাট সংগ্রহের প্রশ্ন ছিল না। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ভ্যাট কমিশনার সাহেবও আমাদের অফিসে এসেছিলেন। আমাদের চেয়ারম্যানসহ মিটিং করেছি।
সেখানে আমরা বলেছি, আদেশের আগে যেহেতু সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে ভ্যাট নেওয়া হয়নি, তাই জমা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। অফিস আদেশের পর থেকে নিয়মিত ভ্যাট পরিশোধ করা হচ্ছে। সমাধানের বিষয়ে জানতে চাইলে ওমর ফারুক বলেন, আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। এ বিষয়ে আমরা তাদের কাছে চিঠিও পাঠিয়েছি। এখন সরকারি পর্যায়ে যে সিদ্ধান্ত আসবে, আমরা সেটাই বাস্তবায়ন করব। অন্যদিকে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট ভ্যাট বিভাগে যোগাযোগ করা হলে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরে ৬৯ ধরনের সেবা গ্রহণ করা হয়, যার বিপরীতে ৫, ৯ ও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর হিসেবে এ বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সেবার বিপরীতে যে ভ্যাট আদায় হয়, তা সঠিকভাবে পরিশোধ করা হয় না বলে অভিযোগ পায় এনবিআর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের নির্দেশে ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর একটি নিরীক্ষা দল গঠন করে মূসক গোয়েন্দা। প্রতিষ্ঠানের সেবা প্রদান, দাখিলপত্র ও ভ্যাটসংক্রান্ত দলিল দিতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি চিঠি দেওয়া হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ কিছু কাগজপত্র দেয়। পরে চাহিদা মতো আরও কাগজপত্র যেমন- বন্দর কর্তৃপক্ষের বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন, ভ্যাট সংক্রান্ত দলিল, দাখিলপত্র (ভ্যাট রিটার্ন) প্রভৃতি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন তৈরি করে মূসক গোয়েন্দা।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ১৯৯১ ও একই আইনের বিধিমালা অনুযায়ী মূসক নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ভ্যাট-সংক্রান্ত দলিলাদি (মূসক চালান-১১, বিক্রয় হিসাব পুস্তক, দাখিলপত্র) সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ সেবা প্রদানের বিপরীতে বিক্রয় হিসাব পুস্তক সংরক্ষণ করেনি, যা মূসক আইনের ধারা ৩১ ও বিধি ২২ লঙ্ঘন।