আনোয়ার হোসেন: এবার নিয়ে ইংল্যান্ডে তৃতীয়বারের মতো এবং ব্রিটেনে মোট সাত বার কমনওয়েলথ গেমস হতে চলেছে। ১৯৯৮ সালে এ গেমসে ছিল ক্রিকে, ২৪ বছর পর আবার কমনওয়েলথ গেমসে ফিরেছে ক্রিকেট। মজার ব্যাপার হলে- এবার অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের টিকিট বিক্রি! এদিকে লক্ষ্যহীন অংশগ্রহণ বাংলাদেশের। এবারের আসরের স্লোগান “গেমস ফর এভরিওয়ান”।
৭২টি দেশকে নিয়ে ২৮ জুলাই জমকালো চোখ ধাঁধাঁনো এক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম আলেকজান্ডার স্টেডিয়ামে পর্দা উঠলো ২৩তম কমনওয়েলথ গেমস ২০২২ এর। ৮ আগস্ট আরেক জমকালো এক অনুষ্ঠানে একই ভেন্যুতে পর্দা নামবে বিশাল এ ক্রীড়া মহাযজ্ঞের। সমাপনী দিনে গেমসের পতাকা তুলে দেওয়া হবে আগামী আসরের আয়োজক ভিক্টোরিয়ার প্রতিনিধির হাতে। ২০২৬-এ আয়োজন করার দায়িত্ব পেয়েছে অস্ট্রেলিয়ার দঃ-পশ্চিম রাজ্য ভিক্টোরিয়া। এবারের কমনওয়েলথ গেমসে মোট ২০ ধরনের খেলায় মোট ২৮০টা ইভেন্টে খেলা হবে। ৫০৫৪ জন অ্যাথলিট এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছেন। গেমসের উদ্বোধনী মার্চপাস্টে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা বহন করেন সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমসে স্বর্ণজয়ী ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই। তিনি তার বক্তব্যে খেলাধুলার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপনের বিষয়টিকে স্বাগত জানান এবং শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।
এদিকে, ইংল্যান্ডের অলিম্পিকজয়ী ডাইভার টম ড্যালে সমকামিতার প্রতি সমর্থন প্রদর্শন করে একটি পারফর্ম করে দেখান। এরপরই সমাপ্তি ঘটে কমনওয়েলথ গেমসের ব্যাটন রিলে। অবশ্য কমনওয়েলথের ৫৬টি দেশে রয়েছে সমকামিতার বিষয়ে কড়াকড়ি। অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক আয়োজনের প্রায় পুরোটার দায়িত্বে ছিলেন পিকি ব্লাইডার্সের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভেন নাইট। যিনি বিশ্বব্যাপী কোটি দর্শককে আগামী ১১ দিনের জন্য মনোমুগ্ধকর এক আয়োজনের আগাম বার্তাই দিয়ে রেখেছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অন্যতম চমক ছিলো প্রায় ১০ মিটার লম্বা ষাঁড়ের আগমন। তবে সরাসরি জীবন্ত বড় ষাঁড় স্টেডিয়ামে চলে আসেনি। অনুষ্ঠানের মাঝে কৃত্রিম এই ষাঁড়ের আগমন ঘটিয়ে বার্মিংহাম ও কমনওয়েলথের বাহারি সংস্কৃতির দিকটি তুলে ধরা হয়। পরে অ্যাথলেটদের প্যারেডে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ওয়েলসকে স্বাগত জানানো হয়। স্বাগতিক ইংল্যান্ড দল কনফেত্তির ভেলায় চড়ে প্যারেডে অংশ নেয়। এসময় ব্যাকগ্রাউন্ডে দর্শকরা গলা মেলান ‘উই উইল রক ইউ’ গানে। এবারের বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সামাজিক পরিবর্তন। মালালা কিংবা ড্যালে ছাড়াও, যেকোনো ক্রীড়াবিদকে নিজ নিজ জায়গা থেকে ইতিবাচকভাবে সামাজিক পরিবর্তনের দিকটি বিবেচনার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়।
প্রায় ৩০ হাজার দর্শকের সামনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই বলা হয়, অন্ধকারের সময়ে আমরাই স্বপ্ন দেখার আলো বহন করবো। যা আমাদের সবাইকে একত্রিত করবে। গেমসের সর্বশেষ আসরের চেয়ে ১৮৯ মিলিয়ন পাউন্ড কম খরচ হচ্ছে বার্মিংহামে। এই আসরের বাজেট ৭৭৮ মিলিয়ন পাউন্ড। জমকালো এ আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল অসংখ্য গাড়ির নাচ। সবাইকে চমকে দিয়ে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করে উইলিয়াম শেকসপিয়ারের প্রায় ৪ মিটার লম্বা পুতুল। এছাড়া আরও তিনটি বিশাল আকৃতির পুতুল নেওয়া হয় স্টেডিয়ামে। যেগুলো আলো-আধারের অদ্ভুত সংমিশ্রণ ঘটানো হয়। শুক্রবার প্রথম দিনে মাঠের লড়াইয়ের বাছাইপর্বে বাংলাদেশ নামে জিমন্যাস্টিকস, টেবিল টেনিস, সাঁতার ও বক্সিং ইভেন্টের খেলোয়াড়রা।
এই নিয়ে ৯২ বছরের ইতিহাসে ইংল্যান্ডে তিন বার ও ব্রিটেনে সাত বার কমনওয়েলথ গেমস হতে চলেছে কমনওয়েলথ গেমস। ইংল্যান্ডে এর আগে ১৯৩৪ সালে লন্ডনে এবং ২০০২ সালে ম্যাঞ্চেস্টারে দু’বার এই গেমস অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে কার্ডিফে, ১৯৭০ ও ১৯৮৬-তে এডিনবরায় এবং ২০১৪-য় গ্লাসগোয়। এ বারের ২২তম কমনওয়েলথ গেমস অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বার্মিংহামে। ১৯৩০ সালে কমনওয়েলথ গেমস শুরু হওয়ার পর থেকে চার বছর অন্তঃর এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়ে থাকে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে এই গেমস অনুষ্ঠিত হয়নি। বার্মিংহাম-সহ ওয়েস্ট মিডল্যান্ড রিজিয়নের ১৫টি জায়গায় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। তার মধ্যে ম্যারাথনের রুট-সহ ৭টি জায়গা বার্মিংহাম শহরে। কমনওয়েলথ গেমসের মূল আসর বসবে বার্মিংহামের আলেকজান্ডার স্টেডিয়ামে। এই প্রথম স্বাধীন দেশ হিসাবে বার্বাডোজ প্রতিযোগিতায় যোগ দিচ্ছে।
এদিকে, কমনওয়েলথ গেমসে বাংলাদেশের এ পর্যন্ত পাওয়া ৮ পদকের মধ্যে সবগুলোই এসেছে শ্যুটিং থেকে। এর মধ্যে দুটি করে স্বর্ণ ও ব্রোঞ্জ এবং চারটি রৌপ্য। এবারের গেমসে নেই শ্যুটিং। অতএব এবারই প্রথম পদক জয়ের আশা বাদ দিয়েই গেমসে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশি খেলোয়াড়রা। গ্লাসগো ২০১৪ কমনওয়েলথ গেমস এ বাংলাদেশের একমাত্র অর্জনটি ছিলো ১০ মিটার এয়ার রাইফেলস শ্যুটিংয়ে আব্দুল্লাহ আল বাকি রৌপ্য পদক লাভ। আর গত সর্বশেষ ২০১৮ সালে গোলকোস্ট কমনওয়েলথ গেমসে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলস শ্যুটিংয়ে আব্দুল্লাহ আল বাকি এবং শাকিল আহমেদ ৫০ মিটার পিস্তলে রৌপ্য পদক লাভ করেন। এবার বার্মিংহামে বাংলাদেশের কেউ নেই শ্যুটিং ইভেন্টে।
এবারের বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক, বক্সিং, জিমন্যাস্টিকস, সাঁতার, ভারোত্তোলন, কুস্তি ও টেবিল টেনিস- এই ৭ ডিসিপ্লিনে অংশ নিচ্ছে। ২৯ জন ক্রীড়াবিদ ও ২১ জন অফিসিয়াল সহ মোট ৫০ সদস্যের বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুর রকিব মন্টু। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র আছেন। সেখান থেকে বার্মিংহামে যান। এর মধ্যে প্রবাসী জিমন্যাস্ট আলী কাদের হক নিউজিল্যান্ড থেকে তার কোচ ডেভিড মাইকেলকে নিয়ে গেমস ভেন্যুতে পৌঁছেন। এছাড়া বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মিডিয়ার বেশ কয়েকজন ক্রীড়া সাংবাদিকরাও এ গেমস কাভার করতে সেখানে গেছেন। বাংলাদেশের ১৯ ক্রীড়াবিদরা হলেন- বক্সিংয়ে- হোসেন আলী, সুর কৃষ্ণ চাকমা, সেলিম হোসেন। জিমন্যাস্টে শিশির আহমেদ, আবু সাইদ রাফি। সাতাঁরে- আসিফ রেজা, সুকুমার রাজবংশী, সোনিয়া খাতুন, মাহমুদুন নবী নাহিদ, মরিয়ম আক্তার। ভারোত্তোলনে- মারজিয়া আক্তার ইকরা, মাবিয়া আক্তার সীমান্ত, মনিরা কাজী, আশিকুর রহমান। টেবিল টেনিসে- খেলোয়াড় মোহতাসিন আহমেদ হৃদয়, রিফাত মাহমুদ সাব্বির, মুফরাদুল খায়ের হামজা, রামহীম রিয়ন বুম, সোনাম সুলতানা সোমা ও সাদিয়া রহমান মৌ। যারা যাচ্ছেন তাদেরই কেউই পদক জয়ের আশার কথা শোনাতে পারছেন না। তবে সবাই নিজের সেরা পারফরম্যান্স করার লক্ষ্য নিয়েই যাচ্ছেন।
এই নিয়ে ইংল্যান্ডে তিন বার ও ব্রিটেনে সাত বার কমনওয়েলথ গেমস হতে চলেছে। ১৯৯৮ সালে কমনওয়েলথ গেমসে ছিল ক্রিকেট, কে জিতেছিল সেই প্রতিযোগিতা? ২৪ বছর পর কমনওয়েলথ গেমসে ফিরছে ক্রিকেট, প্রায় শেষ ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচে টিকিটও।
গত সর্বশেষ ২০১৮ গোল্ডকোস্ট কমনওয়েলথ গেমস আসরে অস্ট্রেলিয়া সর্বোচ্চ ৮০ স্বর্ণ, ৫৯ রৌপ্য ও ৫৯ ব্রোঞ্জ পদক সহ সর্বমোট ১৯৮ পদক পেয়ে শীর্ষ স্থান পায়। ইংল্যান্ড ৪৫ স্বর্ণ, ৪৫ রৌপ্য, ৪৬ বৌঞ্জসহ মোট ১৩৬ পদকে ২য় স্থান। আর ভারত পেয়েছে ২৬ স্বর্ণ, ২০ রৌপ্য ২০ ব্রৌঞ্জ সহ মোট ৬৬ পদক পেয়ে ৩য় স্থান লাভ করে। এবার বার্মিংহামের একটি এলাকা পেরি বারের নামেই এর নামকরণ। ১৯৩০ সালে কানাডার হ্যামিল্টনে এককালের ব্রিটিশ রাজ্যভুক্ত ১১টি দেশের অংশগ্রহণে শুরু হয় কমনওয়েলথ গেমসের। যেখানে অংশ নেয় ৪০০অ্যাথলেট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে গেমসটি আয়োজিত হয়নি। এরপর থেকে ফের নিয়মিত সেটি আয়োজিত হয়ে আসছে।