পুরান ঢাকার সদরঘাটে অবস্থিত বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। জগন্নাথ কলেজকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যাএা শুরু করে। ১৮৫৮সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম স্কুলের পরিবর্তিত রূপই আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৭২ সালে বালিয়াটির জমিদার কিশোরী লাল রায় তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে এই বিদ্যাপীঠের নামকরণ করেন।
১৮৮৪ সালে এটি একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর কলেজ ও ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণীর কলেজে পরিণত হয়।
তখন এটিই ছিল ঢাকার উচ্চ শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কার্যক্রম বন্ধ করে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনমিত করা হয়। তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের ডিগ্রির শিক্ষক, শিক্ষার্থী, গ্রন্থাগারের বই পুস্তক ও জার্নাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সাজাতে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ গ্রন্থাগারের ৫০ ভাগ বই দান করা হয়। ১৯৪৮ সালে পুনরায় এই কলেজে স্নাতক কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৫ সালে দীর্ঘদিন ধরে ছাএদের আন্দোলন আর সংগ্রামের ফলস্বরূপ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন - ২০০৫ পাশ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ষোলো বছর হলেও এই প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য সুদীর্ঘ দেড়শ বছরের।
শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টির সকল বিভাগে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু রয়েছে। অনেক আগেই ইউজিসির প্রতিবেদনে এ-গ্রেড ভুক্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
বিসিএসসহ সকল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরিতে সক্ষমতা অর্জন করেছেন এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। স্পেনের সিমাগো ইনস্টিটিউশন র্যাঙ্কিং-২০২২ এর প্রকাশিত ফলাফলে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে রসায়ন বিষয়ে গবেষণা সূচকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ষষ্ঠ সেখানে মাএ ১৬ বছরেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছে।
কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো এই, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে এখনো অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লজ্জা বহন করতে হয়। ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে কিছু দিন পরপর হলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের রাজপথে নামতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১টি হল দখল করে রেখেছে স্থানীয় দখলদাররা। অবকাঠামোগত সমস্যা ও বাজেট বৈষম্যের শিকার বিশ্ববিদ্যালয়টি। পর্যাপ্ত বাজেটের অভাবে শিক্ষকদের খাতা দেখার সম্মানিও আটকে থাকতে দেখা যায়। ২১ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য নেই পর্যাপ্ত পরিবহন ও ক্যান্টিন সুবিধা। সব মিলিয়ে এক সময় বাংলার আলীগড় খ্যাত বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হল না থাকায় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি মানবেতর জীবনযাপন করছে।
এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির একসময় ১৪টি হল ছিল আর বর্তমানে সেগুলোর একটাও নেই সব স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে। একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল কিভাবে অসাধু মানুষ অবৈধভাবে দখল করে নিতে পারে তার উওর মেলানো বড় দায়। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই কম হোক বেশি হোক ছাএ ছাএী উভয়দের জন্য হলের ব্যবস্থা রয়েছে। শুধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ই বাংলাদেশের একমাএ অনাবাসিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। রাজধানীতে অবস্থিত মাএ ষোল বছর বয়সী এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এত দুরবস্থা ও সংকটের মধ্যে ও পিছিয়ে নেই। শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নিজেদের জানান দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন জবির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অধ্যয়নরত বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই জানেন যে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এতদিন কোনো হল ছিল না সম্প্রতি ২০২০ সালে একটি ছাএী হল "বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল" নির্মিত হয়। কিন্তু তারা এটা জানে না যে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের এক সময় ১৪টি হল ছিল যা এখন সব স্থানীয় প্রভাবশালী অসাধু কিছু লোকের দখলে।
ছাএীদের তুলনায় সিট সংখ্যা সীমিত হওয়ায় একটি মাএ ছাএী হলে সব ছাএীদের সিট দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাএ ও অধিক সংখ্যক ছাএীদের আলাদা বাসা ভাড়া দিয়ে থাকতে হচ্ছে পড়াশোনার জন্য। যেহেতু প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীই ঢাকার বাইরে থেকে এখানে পড়তে আসে। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসে। তাদের পড়াশোনা, খাওয়া দাওয়া চলাফেরার খরচসহ অতিরিক্ত বাসা ভাড়ার খরচ দিয়ে থাকতে হচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। অনেকে এ টাকা জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খান। কারো কারো পরিবার দিতে অক্ষম। কেউ বা আবার দিনরাত পরিশ্রম করে টিউশন ও পার্ট টাইম জব করে পড়াশোনার খরচ জোগাচ্ছেন। এত সংকট আর দূর্দশার মধ্যে দিয়ে কেন যেতে হবে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের?
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আর সরকার জোর দিয়ে বিষয়টি দেখলেই হয়তো হলগুলো উদ্ধার করা সম্ভবপর হতো। শিক্ষার্থীদের অনেক সমস্যার সমাধান হতো যদি আজ হলগুলো অন্যায়ভাবে দখল হয়ে না যেত। শিক্ষা দীক্ষায় আরো এগিয়ে যেতে পারতো বিশ্ববিদ্যালয়টি, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে যা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে দ্রুত কেরানীগঞ্জে ২০০ একরের নতুন ক্যাম্পাস স্থানান্তরের কথা থাকলেও এখনো নতুন ক্যাম্পাসের বাউন্ডারি দেওয়াই শেষ হয়নি। নির্মাণ কাজে এত দীর্ঘসূত্রতা সেটার দিকেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা সরকার কারোরই কোনো নজর নেই।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে একটি সুন্দর, সাজানো এবং বর্ধিত ক্যাম্পাস আশা করছি। যেখানে শিক্ষার্থীদের আবাসন, খাদ্য, প্রয়োজনীয় ইন্টারনেট, ক্লাসরুম, লাইব্রেরি, ল্যাব কোনো কিছুর কোনো সংকট থাকবে না। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকবে। নিরাপদ বাসস্থান ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য ও পানি সরবরাহ নিশ্চিত থাকবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের অবস্থান উল্লেখযোগ্য স্থানে নিয়ে যাবে জবি সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি। শত বাধা পেরিয়ে ও এগিয়ে যাক প্রাণের জবি।
লেখক : সুমাইয়া আক্তার শিক্ষার্থী : গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়