স্বাধীন বাংলা ডেস্ক জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণে আইন থাকলেও প্রবিধান না হওয়ায় ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বিইআরসির আইন অনুযায়ী, দেশে জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের এখতিয়ার শুধু তাদের। দেশে গ্যাস, এলপিজি ও বিদ্যুতের মূল্য সংস্থাটির মাধ্যমে নির্ধারিত হচ্ছে। কিন্তু আইন থাকলেও বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের প্রবিধান না হওয়ায় আইনগত দায়িত্ব পালন করতে পারছে না বিইআরসি। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে সব ধরনের জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করছে সরকার।
আইনজীবীরা বলছেন, আইন হলেও তা প্রয়োগের জন্য প্রবিধান এখনও হয়নি। ফলে সরকার জ্বালানি তেলের যে মূল্য নির্ধারণ করছে এতে আইনের ব্যত্যয় না হলেও আইনে যে ফাঁকফোকর রয়েছে সরকার সে সুযোগ নিচ্ছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, বিইআরসি আইনের ২২ ও ৩৪ ধারামতে, এলপিজিসহ সব পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের মূল্য নির্ধারণের একক এখতিয়ার বিইআরসির। ২৭ ধারামতে, বিপিসি বিইআরসির লাইসেন্সি। ৩৪(৬) ধারামতে, ওপরের যেকোনো জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি বা পরিবর্তনের প্রস্তাব লাইসেন্সি হিসেবে বিপিসিকে বিইআরসির কাছে পেশ করতে হবে। ৩৪(৪) ধারামতে, স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষকে শুনানি দেওয়ার পর বিইআরসি মূল্য নির্ধারণ করবে। বিইআরসির আইন মতে, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ হয়। উচ্চ আদালতের আদেশ হওয়ায় এখন বিইআরসি প্রতি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারদর হিসেবে এলপিজির মূল্য নির্ধারণ করে।
বিইআরসি সূত্র জানায়, প্রথমে মূল নির্ধারণের জন্য সংশ্লিষ্টরা সব ধরনের কাগজপত্রসহ বিইআরসিতে আবেদন করবে। তারপর কারিগরি কমিটি এটা যাচাই করে একটা প্রস্তাব করবে। এ প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হবে। তারপর ৯০ দিনের মধ্যে মূল্য কমা-বাড়ার বিষয়ে বিইআরসি তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে। কমিশন প্রয়োজন মনে করলে একই অর্থবছরে একাধিকবার মূল্য পরিবর্তন করতে পারবে।
এ বিষয়ে বিইআরসি চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেন, বিইআরসি আইনে বলা আছে, এনার্জির মূল্য নির্ধারণ করবে বিইআরসি। সে হিসেবে পেট্রোলিয়াম পণ্যও এক রকম এনার্জি। আইনগতভাবে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব বিইআরসির। আইনের ৩৪ ধারায় বলা আছে, এই মূল্য নির্ধারণের আগে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে একটা প্রবিধান তৈরি করতে হবে। সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য আমরা ১০-১২ বছর আগে এ প্রবিধান তৈরি করে পাঠিয়েছি। সরকার এখনও সেটা চূড়ান্ত করেনি। ফলে বিইআরসি তার আইনগত দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।
ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূইয়া বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বিইআরসির মাধ্যমে নির্ধারণ হওয়ার জন্য আদালতে মামলা চলমান। এ বিষয়ে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইন। কিন্তু এই আইন কীভাবে প্রয়োগ হবে তার জন্য বিধি দরকার। আইন কার্যকর করার জন্য বিধি দরকার। বিধিতে সবকিছু উল্লেখ থাকে। এমন অনেক আইনই আছে, সরকার আইন করেছে; কিন্তু বিধি আর করে না। এটা আশ্চর্যজনক। না করে আইনের যে ফাঁকফোকর আছে সেটা ব্যবহার করে মূল কর্তৃত্বটা নিজেদের কাছে রেখে দেয়। বিইআরসির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। বিধি না হওয়ায় বিইআরসি প্রয়োগ করতে পারছে না। এখন মূল্য তো নির্ধারণ করতেই হবে, সরকার সেটা করছে। নীতিমালা হয়ে গেলে তো আইনের কাছে হাত-পা বাঁধা হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এটা আইনের লঙ্ঘন নয়, তবে আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে সুযোগ নেওয়া হচ্ছে। এটা নিয়ে ক্যাবের মামলা চলমান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে গেলে বাংলাদেশেও বাড়ানো হয়। কিন্তু কমে গেলে সবসময় কমানো হয় না। এর কারণ হচ্ছে দেশের দাম নির্ধারণ পদ্ধতি।
শুক্রবার রাতে লিটারপ্রতি ডিজেলের দাম ৮০ থেকে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪, কেরোসিন ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪, অকটেন ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ এবং পেট্রোল ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা করা হয়। এতে ডিজেলের দাম বেড়েছে একলাফে ৪২.৫ শতাংশ। এ ছাড়া অকটেন, পেট্রোল, কেরোসিনের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৫১.৬৮, ৫১.১৬ ও ৪২.৫ শতাংশ। অথচ বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েল ৯৪ ডলার আর ডব্লিউটিআই ক্রুড অয়েল ৮৮ ডলারে বিক্রি হয়। আর গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় এ দাম আরও কমে ৯৪ ও ৮৮ ডলার হয়েছে।
ব্লুমবার্গের বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী, গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের পর তেলের দাম এবারই সর্বনিম্ন। গত ৬ মাসে তেলের দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। দুই মাস আগেও ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম বেড়ে ১২০ ডলার হয়ে যায়।
বিশ্ববাজারে প্রতিদিনই তেলের দাম ওঠানামা করে। খুচরা পর্যায়ে তেলের দাম নির্ধারণে সারাবিশ্বের অভিজ্ঞতায় প্রধানত তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এসব পদ্ধতির মধ্যে অধিকাংশ দেশ মার্কেট ডিটারমাইন্ড পদ্ধতি অনুসরণ করে। এটা আন্তর্জাতিক বাজারের দরের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। অর্থাৎ বিশ্ববাজার দর অনুযায়ী কমানো-বাড়ানো হয়। এ ছাড়া কিছু দেশে আছে প্রাইস সিলিং বা সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেওয়ার পদ্ধতি। সিলিং মার্কেট প্রাইসের সঙ্গেই থাকে, তবে একটা সর্বোচ্চ মূল্যের ওপরে উঠতে পারে না। সে সময়ে হয়তো সরকার ভর্তুকি দেয়। আর সবচেয়ে কঠোর পদ্ধতি হলো ফিক্সড প্রাইস বা একদর পদ্ধতি। এ পদ্ধতি অনুসরণের ফলে বিশ্ববাজারে আচমকা দাম বেড়ে গেলেও ভর্তুকি দিতে হয়। আবার কমলেও কমানো হয় না। ফলে ভোক্তা কমার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। বাংলাদেশে সরকারের নির্বাহী আদেশে ফিক্সড প্রাইস বা একদর পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিইআরসির দায়িত্বশীল সূত্র জানান, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির এখতিয়ার বিইআরসির। এ বিষয়ে বহুবার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। একটা প্রবিধান করার কথা, এজন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়েছে। কিন্তু ১০ বছর ধরে তা জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। মন্ত্রণালয় তা হতে দিচ্ছে না। এজন্য বিইআরসি করতে পারছে না। এলপিজির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা ছিল। কিন্তু ক্যাবের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত নির্দেশ দেওয়ায় বিইআরসি এলপিজির দাম নির্ধারণ করছে। সেটা প্রবিধানের জোরে নয়। জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের বিষয়েও ক্যাব আদালতে মামলা করেছে, সেটা চলমান আছে। এখনও রায় হয়নি। এটা ঝুলে আছে। প্রবিধান হলে বা আদালতের রায় পক্ষে পেলে বিইআরসি জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করতে পারবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে দাম বাড়ানো বা কমানোর একটা স্থায়ী পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। যেন বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে বা কমলে দেশেও দাম বাড়ানো বা কমানো হয়। দাম নির্ধারণ বিআইরসির ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।
এ বিষয়ে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, আইন থাকলেও বিইআরসি তা প্রয়োগ করতে পারছে না। সরকার দাম নির্ধারণের জন্য অ্যাডমিনিস্ট্রিটিভ প্রাইজ ব্যবহার করে। তিনি বলেন, বাজারে যে দাম সেটাই যদি দিতে হয় তা হলে সরকারের দরকার কী এর মধ্যে থাকার। ভারত সরকার যেমন নেই। বলা হয়েছে, মার্কেট প্রাইজ রাখলে জনগণের ওপর চাপ পড়বে। এখন সরকারই নিজেই জনগণের জন্য সেই চাপ সৃষ্টি করছে। এমন সময় দাম বাড়ানো হলো যখন মানুষ সব কিছুতে হিমশিম খাচ্ছে। কোনো কিছুই ম্যানেজ করতে পারছে না। যেহেতু ভোক্তার কিছু বলার নেই, এটা অন্যায়ের পর্যায়ে পড়ে। আমার মনে হয়, তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে আমরা আদালতে যেতে পারি। আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন। সরকার যা ইচ্ছা করতে পারে না। সেটাই একটা পথ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, বাংলাদেশে সরকার নির্ধারিত ফিক্সড প্রাইজ পদ্ধতিতে মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এটা করা হয় আমদানি খরচ ও ভর্তুকির ওপর ভিত্তি করে। অনেক দেশই এ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ প্রাইজ পদ্ধতি অনুসরণ করে। ভারতেও দীর্ঘদিন এটা ছিল। এখন তারা আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী ‘ডায়নামিক ডেইলি প্রাইসিং মেথড’ নামে মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি অনুসরণ করে। বিইআরসির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী দেশে মূল্য নির্ধারণ হওয়া উচিত।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করার এখতিয়ার বিইআরসির। সরকার আইন লঙ্ঘন করে দাম নির্ধারণ করছে।
|