পারিবারিক ব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে: নেপথ্যে কারণ...
18, August, 2022, 10:34:50:PM
পরিবার হলো একটি রাষ্ট্র বা সমাজের ক্ষুদ্রতম ইউনিট। যখন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ এবং প্রাপ্তবয়স্কা নারী পারস্পরিক সম্মতিতে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রিয় আইন মেনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সামাজিক স্বীকৃতির মাধ্যমে একই ঘর বসবাস করতে শুরু করে তখন থেকেই একটি পরিবার সৃষ্টি হয়। একেক সমাজে পারিবারিক ব্যাবস্থা একেক রকম। কোন সমাজ পিতৃতান্ত্রিক পরিবার আবার কোন সমাজে মাতৃতান্ত্রিক। বাংলাদের অধিকাংশ পরিবার পিতৃতান্ত্রিক। পরিবারের বাবাই প্রধান কর্তা থাকেন। পরিবারে অন্যান্য সদস্যরা পরবারের সার্বিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেন। আকারের দিক থেকে পরিবার আবার দুই ধরনের একক পরিবার অন্যটি বৃহৎ পরিবার। বৃহৎ পরিবারে সাধারনত বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ফুফু সবাইকে নিয়ে গঠিত। এধরেন পরিবার সাধারনত গ্রামেই আগে দেখা যেতো। একক পরিবার বলতে বুঝায় যেখানে স্বামী-স্ত্রী ও তাদের সন্তান নিয়েই গঠিত। এরকম পরিবার শহরের বেশি হলেও বিশ্বায়ানের যুগে এখন গ্রামেও বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃহৎ পরিবার গুলো নানান কারনে ভেঙে ছোট পরিবারে রূপান্তরিত হচ্ছে। আগের বৃহৎ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। একে অপরের প্রতি খুবই আন্তরিক ছিলো। সুখে দুঃখে পাশে দাঁড়াতো, নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতো। এগুলো এখন শুধুই স্মৃতি।
এখন বিয়ে করে স্বামী স্ত্রী শহরে বসবাস করছেন। স্বামী উপার্জন করছেন আবার কখনো দেখা যায় স্ত্রীও উপার্জন করছেন। সন্তান লালন পালন করছেন। বাবা কর্মব্যস্ত থাকায় খুব ভোরে অফিসে চলে যান। সন্তানরা তাতের বাবার সংস্পর্শ পাচ্ছে না। দাদা-দাদি না থাকায় সন্তানরা তাদেরও সংস্পর্শ পায় না। কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ততা থাকার দরুন পরিবারকে সময় দিতে পারছেন না বলে অনেক স্ত্রী স্বামীর প্রতি অভিযোগ করেন। দু’জনেই চাকরির সুবাধে ব্যস্ত সময় পার করার কারনে তাদের মাঝে যে পারষ্পরিক সম্পর্ক থাকার কথা সেটাও ঠিকমত রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ছুটির দিনগুলোতে কোথাও বেড়াতে যেতে পারছেন না। ফলে নিজেদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও কলহ-বিবাদ ইত্যাদি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে খুব সহজেই অপরিচিত মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া। অনেকই অফিসের কলিগ ও ফেইসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে পরকীয়ার মত অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে এটাকে কেন্দ্র করে কলহ বিবাহ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলস্বরূপ বিবাহ বিচ্ছেদ, হত্যা এবং আত্নহত্যার মত ভয়াবহ ঘটনা গুলো আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে।
পারিবারিক কলহ সৃষ্টির পিছনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ থাকলেও বর্তমানে পরকীয়া বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কগুলো বেশি। বিবাহের পরও পূর্ববর্তী প্রেমিক বা প্রেমিকার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা বা অফিসের কলিগদের সাথে বা যে কারো সাথে স্বামীর অজান্তে স্ত্রী আবার স্ত্রীর অজান্তে স্বামী পরকীয়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে। এতে করে পারিবারিক ভাঙন শুরু হয়। প্রথম আলোর এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকায় দৈনিক ৩৯টি এবং প্রতি ৩৭মিনিটে একটি তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। সাহিত্যে, নাটক-সিনেমায়, টিভি সিরিয়ালে পরকীয়া প্রেমকে আকর্ষণীয় ঢং এ উপস্থাপন করা হচ্ছে। সেই বিষয়গুলো বর্তমান সমাজে সরাসরি প্রভাবে ফেলছে। এক্ষেত্রে ভারতীয় নাটক-সিরিয়ালগুলো অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। নাটকে দেখানো হয় কিভাবে পরিবারের সদস্য একে একে অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ, ষড়যন্ত্র-কুটচাল করতে হয়। এগুলো দেখতে দেখতে দর্শকরা একমসয় নিজেদের জীবনের প্রয়োগ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এই ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রভাবের আজ বাংলাদেশ সরাসরি প্রভাবিত।
সম্প্রতি কতগুলো আলোচিত ঘটনার দেখলেই বুঝা যায়, পরিবারগুলোতে কিভাবে নানারকম সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
১. কলেজশিক্ষিকা ও কলেজছাত্রের বিয়ে ঘটনা সম্প্রতি আলোচিত ও সমালোচিত ঘটনা। পারিবারিক কলহের জেরে পূর্বের স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ। পরে ফেইসবুকে পরিচিত হয় কলেজছাত্রের সাথে দীর্ঘদিন প্রেম করার পর গোপনে বিয়ে করেন। বিষয়টি প্রকাশ পেলে নানাদিক থেকে বিভিন্ন কটুক্তি শুনতে হয়। কিন্তু বিয়ের ৬ মাস যেতো না যেতোই সেই মহিলার লাশ উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হত্যা নাকি আত্মহত্যা সেটা তদন্তের বিষয়।
২. দুই সন্তানের জননী স্বামীর সাথে মনোমালিন্যের জেরে বাবার বাড়িতে অবস্থানকালীন সময়ে নিজেকে অবিবাহিত দাবি করে ফেইসবুকে পরিচিত হন রংপুরের পীরগাছা উপজেলা সোহেল রানার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। পরে পূর্ব স্বামীকে তালাক দিয়ে সোহেল রানাকে বিয়ে করেন। (আরটিভি নিউজ ২৪শে জুলাই ২০২২ ইং)
৩. প্রেম থেকে বিয়ে, অতঃপর পরকীয়ার সম্পর্কের কথা জেনে যাওয়ায় স্ত্রীকে হত্যা করেছেন মুহাম্মদ সোহাগ (২৭) নামের এক যুবক। (প্রথম আলো ৩রা ফেব্রুয়ারি ২০২২ ইং)
৪. পরকীয়ার সম্পর্কের জের ধরে কথিত পরকীয়া প্রেমিকের সহায়তায় শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন নিজের মেয়ে তন্নী আক্তারকে (১৭)। পুলিশের তদন্তে এমনটাই বেরিয়ে এসেছে। এই ঘটনাটি ঘটেছে বরিশাল সদর উপজেলায়। (প্রথম আলো ৪ই জুন ২০২২ ইং) ৫. সম্প্রতি খুলনায় এডিসি লাবনী আক্তার আত্মহত্যার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মাথায় অত্র ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেন তার সাবেক দেহরক্ষী মাহমুদুল হাসান। জানা গেছে কন্সারে আক্রান্ত স্বামীর সাথে পারিবারিক কলহ চলছিলো। তখন তার দেহরক্ষী সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যান। বদলির ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য চলছিলো। এমনটাই তদন্তে উঠে এসেছে। (২১শে জুলাই ২০২২ ইং)
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয়, পরে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। আবার সেই বিয়ে ভেঙে যায় পারস্পরিক সন্দেহ অবিশ্বাস আর দ্বন্দ্ব-কলহের জের ধলে। এই ঘঠনা গুলো সাম্প্রতিক সময়ে বেশি ঘটছে। পত্রিকার কাগজ খুললেই হত্যা, আত্মহত্যার মত ঘটনা গুলো চোখে পড়ে। এইকিছুদিন আগেও এই ঘটনা গুলো এত বেশি ঘটতে দেখা যায় নি। হাল আমলে কেন বেশি ঘটছে তার কারন কি সেটা অনুসন্ধানের বিষয়। আমাদের দাদা-দাদি, বা বাবা-মায়েদের যুগে এর বিয়ে বিচ্ছেদ ও পারিবারিক কলহ এত বেশি ছিলো না। কদিন আগেও পারিবারিক কলহের একটা ধরন ছিলো যৌতুকের কারনে নারী নির্যাতন, বা অন্যান্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারনগুলো। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে সেই সমস্যা গুলো আরো এক ধাপ এগিয়ে নানা রুপ ধারণ করেছে। যে পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যাগুলো এখন প্রকট আকার ধারণ করছে সেগুলো হলো—
১. বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে পারষ্পরিক সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন পরে তা অস্বীকার।
৩. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয়, প্রেম, বিয়ে, পারিবারিক কলহ পরিণতিতে তালাক, হত্যা বা আত্মহত্যা।
৪. বিয়ের পরও সাবেক প্রেমিক বা প্রেমিকার সাথে সম্পর্ক রেখে পরকীয়ার জড়ানো, পারিবারিক কলহ প্রেমিকার হাত ধরে পালানো।
৫. বিয়ের আশ্বাসে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে এসে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার, পরে ধর্ষিতাকে হত্যা বা ধর্ষিতা নিজেই লোকলজ্জার কারনে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেওযা। ৬. সন্তান রেখেও পরকীয়া করে অন্যত্র বিয়ে।
৭. পরকীয়ার সম্পর্ক জেনে যাওয়ায় খোদ নিজের সন্তানকে নিজেই হত্যা করা।
৮. বিয়ের পর ছোটোখাটো কারনে তালাক দিয়ে উচ্চমূল্যের কাবিনের টাকা আদায় করে নেওয়া।
৯. পারষ্পরিক সম্মতিতে শারিরীক সম্পর্ক করা, সেই ভিডিও ধারন করে পরে ব্লাকেমইল করে একাধির বার ধর্ষণ করা।
১০. প্রেমেরর টানে বিদেশীরা বাংলাদেশ চলে আসা এবং বাংলাদেশে থেকে বিদেশে পাড়ি জমানো।
আমাদের সমাজে কয়েকবছর আগেও প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক গুলো নেতিবাচক চোখে দোখা হতো। যারাই যুক্ত ছিলো তারা অন্তত গোপন রাখতেন। কখন বিয়ে পর্যন্ত গড়াতো আবার কখনো বিয়ে পর্যন্তও গড়াতো না। কিন্তু বর্তমানে প্রেম ভালোবাসার ও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে নামে যে অশ্লীলতা ছড়াছড়ি সমাজে শরু হয়েছে তারই সরাসরি প্রভাব হলো এই তালাক, হত্যা আর আত্মহত্যা। ভার্চুয়াল জগতের অল্পরকদিনের পরিচয়েই সম্পর্ক গুলো ঘনিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। ছবি দেওয়া নেওয়া, ভিডিও কলে কথা বলা, দেখা করতে এসে ধর্ষণ, গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে দেশের প্রতিটি জনপদের হাজারো আপনার আমার বোনের ন্যায় কিশোরী যুবতীরা। যাস্ট ফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড, গার্লফেন্ড, অবৈধ প্রেম ভালোবাসা, বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপন করার যে কালচার আমাদের দেশে চালু হয়েছে সেই অপসংস্কৃতির করুন পরিণতি আজকের আমাদের সমাজে দেখতে পাচ্ছি। পারিবারিক ও সামাজিক ব্যাবস্থায় আজ ঘুনে ধরেছে। মরিচিকা ধরেছে তার প্রতিটি স্থরে স্থরে। সেই ঘুনে ধরা সমাজটাকে পাল্টাতে হলে ধর্মীয় বিধিনিষেধ যথাযথভাবে পালন ও অপরাধীদের উপর রাষ্ট্রীয় আইন দ্রুত কার্যকর করার ব্যাবস্থা ত্বরান্বিত করতে হবে। আজকে এমন এক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে সেখানে সবকিছু উদার ভাবে চলছে। বিয়ের বহির্ভুত প্রেমের আর নোংরামিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যুবক-যুবতী, কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের মাঝে অবাধ মেলেমেশা বন্ধ করতে উদ্যোগ গ্রহন করা। মিডিয়ায় নারীদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করা। প্রযোজনে নারীদের জন্য আলাদা, নিরাপদ ও উপযুক্ত কর্মক্ষেত্রে সৃষ্টি করা যেতে পারে। প্রতিটি ধর্মের ধর্মেীয় বিধিনিষেধ যথাযথ মেনে চলতে সচেষ্ট হতে হবে।
লেখক: আশিকুর রহমান সাকিব শিক্ষার্থী আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।