মুফতি আবদুল্লাহ নোমান সুকুমারবৃত্তি ও উত্তম শিষ্টাচারে মানুষ একদিকে যেমন পৌঁছতে পারে সম্মান, নিরাপত্তা ও গৌরবের সর্বোচ্চ চূড়ায়, তেমনি খারাপ চরিত্রের প্রভাবে মানুষ নিক্ষিপ্ত হয় ধ্বংস, কলঙ্ক ও কদর্যতার পূতিগন্ধময় আঁস্তাকুড়ে। সবাই চাই নিজেকে উত্তম আখলাকের বিভায় আলোকিত করতে, সুন্দর চরিত্রের ভূষণে শোভিত করতে। তাই তো সমাজের কুখ্যাত ঘাতকও যখন উচ্চ পদের প্রার্থী হয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চায় তখন তার নামেও স্লোগান তোলা হয়, ‘অমুক ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র’। আর যখন কারও নামের সঙ্গে চরিত্রহীনতার তকমা লেগে যায়, তখন তার ব্যক্তিত্ব ও ভাবমর্যাদা নষ্ট হওয়ার জন্য অন্য কিছুর প্রয়োজন হয় না।
সুন্দর চরিত্রে ঈমানের পূর্ণাঙ্গতা উত্তম আচরণ ও সুন্দর উচ্চারণে ফুটে ওঠে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও মন-মানসিকতা। এমনকি মুমিনের ঈমানও পূর্ণাঙ্গতা পায় উত্তম আখলাক ও সুন্দর চরিত্রে। চরিত্র মাধুর্যের মূর্ত প্রতীক। বিশ্ব মানবতার অনুপম রূপকার মহানবী (সা.) এ মর্মে ইরশাদ করেছেন, ‘চরিত্রে যারা সবচেয়ে উত্তম, ঈমানের বিচারেও তারাই পূর্ণাঙ্গ মুমিন’ (আবু দাউদ : ৪৬৮২)। উত্তম চরিত্রের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহান এই শিক্ষক তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের বাঁকে বাঁকে যেমন সুন্দর চরিত্রের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তেমনি তাঁর সম্মানিত সহচরদেরও এর প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা চরিত্রে সবচেয়ে উত্তম তারাই সবচেয়ে ভালো মানুষ’ (বোখারি : ৬০২৯)। শুধু ব্যক্তিজীবন, পারিবারিকজীবন ও সমাজজীবন নয়, ঈমানি জীবনের পূর্ণতার মাপকাঠিও চরিত্র। তাই চারিত্রিক সততা, আচরণের নান্দনিকতা ও সুকুমারবৃত্তিকে উপেক্ষা করে ভালো মুমিন হওয়ার সুযোগ নেই।
উত্তম আখলাকের মর্যাদা মুসলমান মাত্রই অবগত, মানবজীবনের প্রকৃত সফলতা হলো পরকালীন মুক্তি। সেদিন যার আমলের পাল্লা ভারী হবে সে-ই হবে চিরস্থায়ী সুখময় জীবনের অধিকারী। পবিত্র কোরআনের চিরন্তন বাণী, ‘সেদিন যার পাল্লা ভারী হবে সে তো সন্তোষজনক জীবনে থাকবে। আর যার পাল্লা হালকা হবে তার ঠিকানা হবে এক গভীর গর্ত। তুমি কি জানো সেই গভীর গর্ত কি? এক উত্তপ্ত আগুন’ (সুরা কারিয়া : ৬৯)। কেয়ামতের বিভীষিকাময় দিনে আমলের পাল্লাকে ভারী করতে কে না চায়? সেদিন সবার অভিপ্রায় ও আপ্রাণ চেষ্টা থাকবে, জীবনের সব অর্জন ও সঞ্চিত সম্পদ দিয়ে হলেও আমলের পাল্লাকে অধিক ওজনবিশিষ্ট করতে। অথচ সুন্দর চরিত্রের মাধ্যমেই তা সম্ভব। আবু দারদা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) বলেন, কেয়ামতের দিন আমলের পাল্লায় সৎ চরিত্রের চেয়ে অধিক ভারী আর কিছুই নেই।’ (আবু দাউদ : ৪৭৯৯)
উত্তম চরিত্রে মেলে জান্নাত সুন্দর চরিত্রে একদিকে যেমন দুনিয়াতে সুবাসিত ও নির্মল জীবন লাভ করা যায়, তেমনি পরকালেও পাওয়া যায় চিরসুখের জান্নাত ও স্বর্গীয় অফুরন্ত নেয়ামত। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলো, কোন আমলটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাবে?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহভীতি ও উত্তম চরিত্র।’ আবার প্রশ্ন করা হলো, ‘কোন কাজটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে?’ তিনি বললেন, ‘মুখ ও লজ্জাস্থান’ (তিরমিজি : ২০০৪)। বলার অপেক্ষা রাখে না, শেষ রাত্রের কোমল পরিবেশে প্রভুপ্রেমে মগ্ন হয়ে নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করা ও দিনের বেলায় সিয়াম পালন করা চাট্টিখানি কথা নয়! এমন মহা সৌভাগ্য কয়জনের হয়! মজার বিষয় হলো, সদাচার ও উত্তম চরিত্রে এ মহা মর্যাদা লাভ করা যায় অনায়াসেই। আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ঈমানদার বান্দা তার উত্তম চরিত্রের বিনিময়ে তাদের মর্যাদায় উন্নীত হয়, যারা দিনে সর্বদা রোজা রাখে আর রাতে নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়ে।’ (আবু দাউদ : ৪৭৯৮)
চরিত্র ও শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণয়ের কষ্টিপাথর সন্দেহ নেই, উত্তম চরিত্রের কথা মুখে বলা যেমন সহজ, যাপিত জীবনে এর বাস্তব প্রতিফলন ও যথাযথ প্রয়োগ তত সহজ নয়। অনেকের পোশাকি ও ঠুঁটো চরিত্রমাধুর্য বাইরের মানুষকে মুগ্ধ করলেও ঘরে আসামাত্র তার মুখোশ উন্মোচন হয়ে যায়। দূর হয়ে যায় তার মনোমুগ্ধকর কৃত্রিম মেকআপের আবরণ। পরিবারের সঙ্গে মানসিক রোগীর মতো সে আচরণ শুরু করে। ঠুনকো বিষয়ে অগ্নিশর্মা হয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে, যা কখনোই উচিত নয়। তাই তো বিশ^নবী (সা.) চরিত্র নির্ণয়ের কষ্টিপাথর সাব্যস্ত করেছেন স্ত্রী ও পরিবারের সঙ্গে আচরণের প্রকৃতিকে। বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই সর্বশ্রেষ্ঠ যে তার স্ত্রীর চোখে তোমাদের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ। আর আমি আমার স্ত্রীদের চোখে তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।’ (তিরমিজি : ৩৮৯৫)
সুন্দর চরিত্রের আদর্শ রূপরেখা সত্যি কথা বলতে কী, আমরা সমাজজীবনে আখলাক ও চরিত্র বলতে শুধু কিছু স্থূল আচরণ, কৃত্রিম ব্যবহার ও মধুময় সৌজন্যকে বুঝে থাকি। অথচ এর মর্মার্থ অনেক ব্যাপক, সুদূরপ্রসারী। মানবজীবনের সব ক্ষেত্রেই রয়েছে উত্তম চরিত্রের শিক্ষা ও নির্দেশনা। প্রিয় নবী (সা.) চারিত্রিক সদাচারের রূপরেখা অঙ্কন করেছেন এভাবে, ‘যে তোমার সাথে সম্পর্কছেদ করে, তুমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখো। যে তোমার প্রতি অন্যায় অবিচার করে, তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও। যে তোমার সাথে অসদাচরণ করে, তুমি তার সাথে সদাচরণ করো। নিজের বিপক্ষে হলেও হক কথা বলো’ (সহিহ আত-তারগীব : ২৪৬৭)। এ যেন সাগরসেচা মুক্তা! তিনি উত্তম চরিত্রকে অনুপদ বাণীতে চিত্রিত করেছেন। এই গুণগুলো যদি কেউ ব্যবহারিক জীবনে ধারণ করতে পারে এবং আচরণে-উচ্চারণে এর প্রতিফলন ঘটাতে পারে, তাহলে তার জীবন হবে যেমন হৃদয়গ্রাহী সৌরভে সুরভিত, তেমনি তার হৃদয়জগৎ থাকবে সদাপ্রশান্ত, প্রাণবন্ত ও আলোকিত।