কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পরিবারের দায়িত্বশীলতা দরকার
31, December, 2022, 9:25:36:PM
বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ নতুন নয়। যুগ যুগ ধরে ডানপিটে ছেলে, মাস্তান, যারা এলাকায় হৈ-হুল্লোড়, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা থেকে শুরু করে মারামারির মতো ঘটনা ঘটাত তাদের কিশোর অপরাধী হিসেবেই সবাই জানত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের গতি, প্রকৃতি ও স্বভাবে এসেছে আরও নেতিবাচক পরিবর্তন। বিগত কয়েক দশকে দেশে কিশোর অপরাধের পরিসংখ্যানই বলছে আমাদের কিশোররা কীভাবে প্রচলিত আইন ও সামাজিক অনুশাসনের জাল ছিন্ন করে সাধারণ অপরাধ থেকে খুন, ধর্ষণসহ জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে এবং এর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের অপরাধের মাত্রা বয়স্ক অপরাধীদের নিষ্ঠুরতাকেও হার মানাচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিভিন্ন সময় তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে, তাদের সংশোধনের আওতায় নেওয়া হচ্ছে কিন্তু তাতে করে তাদের সংখ্যা ও অপরাধ কমছে না।
কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়া বহুলাংশে নির্ভর করে সামাজিকীকরণের অন্যতম মাধ্যম পরিবারের দায়িত্ববোধ বা দায়িত্বহীনতা। অতীতে আমাদের সমাজে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে কিশোরদের যে কোনো বিচ্যুত আচরণের বিচার বা সমাধান করা হতো। এখনও গ্রামাঞ্চলে, এমনকি শহরে দুর্বলভাবে হলেও সে রকম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়। তখন মানুষ বিচারের জন্য পুলিশ বা আদালতে না গিয়ে কিশোরদের অভিভাবক বা প্রয়োজন হলে সমাজপতিদের কাছে যেত এবং এভাবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কাজ করত। পরিবারগুলোও কোনো অভিযোগ পেলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করত; যাতে তার কিশোরটি ভবিষ্যতে আর অপরাধে জড়িয়ে না যায়। তাই কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পরিবারের ভূমিকার বিষয়টি ব্যাপক।
অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা যেমন কিশোরদের মনে দাগ কাটে, তেমনি প্রাচুর্যও। অভিভাবকদের ঠিক করতে হবে সন্তানদের প্রত্যাশার মাত্রা কতটুকু হওয়া উচিত। তাদের সব আবদার সহজে মেনে নেওয়ার মধ্যে তাদের মধ্যে যে সহজাত পাওয়ার ভাবনা তৈরি হয়, তা কি সব সময় ভালো? আবার তাদের বয়সের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চাহিদা পূরণের দায় কিন্তু অভিভাবকদের। মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীর হাতে যদি দামি স্মার্টফোন দেওয়া হয় তাহলে এর ফল ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। বিদ্যালয়পড়ুয়া সন্তান কেন বিদ্যালয়ে বা নামাজে যাওয়ার সময় সঙ্গে মোবাইল নিয়ে যাবে? মোবাইল দিয়ে সন্তান কী করে, তা ক’জন অভিভাবক সচেতনভাবে তদারক করেন? অনুরূপভাবে সন্তানদের হাত খরচের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সামর্থ আছে বলেই কিশোর সন্তানকে ইচ্ছেমতো টাকা দেওয়া পক্ষান্তরে তাদের বিপথগামী করা। বাড়তি টাকা দিয়ে সিগারেট বা মাদক সেবন যে করবে না সে নিশ্চয়তা কতটুকু?
আজকের ব্যস্ত নাগরিক জীবনে অভিভাবকরা সন্তানদের প্রয়োজনীয় সময় দিচ্ছেন কি না সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তির এ যুগে সবাই নিজের ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত। একই ছাদের নিচে বাস করেও সবার জগৎ আলাদা হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যম ও ইউটিউবের ব্যবহার এত বেশি হচ্ছে, মা-বাবা নিজেরাই খেয়াল করছেন না যে তাদের সন্তানদের একাকিত্ব। ফলে তাদের মানসিকতা হচ্ছে ভিন্ন। এমনকি বিনোদনের সঠিক সুযোগ না থাকায় তাদের মধ্যে কিছু করার তাড়না তৈরি হয়; যা পক্ষান্তরে তাদের মধ্যে বিচ্যুত ভাবনার জন্ম দিচ্ছে।
সন্তানটি কার সঙ্গে মিশছে বা রাতে কেন দেরি করে ফিরছে- তা দেখার দায়িত্ব কিন্তু পুলিশের নয়, মা-বাবার। সন্তানদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলে তা রোধ করা তাদের আবশ্যিক দায়িত্ব। কিন্তু কারও কারও ভাবনা ভিন্ন; মনে করেন ছেলেটা বড় হচ্ছে, একটু স্বাধীনতা দরকার। তা ঠিক, কিন্তু সেটার মাত্রাও দেখার বিষয়। অথচ এক সময় আসে যখন সে আর সীমার বাইরে চলে যায় আর অভিভাবকদের জন্য থাকে হাহাকার।
এ রকম অনেক দায়িত্ব আছে পরিবারের, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্বল হচ্ছে; ফলে কিশোররা হচ্ছে বিচ্যুত। তাই কিশোর অপরাধ রোধে পরিবারের ইতিবাচক ভূমিকা জোরালো না করলে আইন দিয়ে সেটা রোধ করা প্রায় অসম্ভব। এটা আমি মনে করি৷