মার্ক জাকারবার্গ ২০০৪ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি ফেসবুক আবিষ্কার করেন। আর বাংলাদেশে ফেসবুক চালু হয় ২০০৬ সালে ২২ আগস্ট। প্রায় ১৬ বছর ধরে আমরা ফেসবুক জগতে এসেছি। সেই সূত্রে রেডমিক কিবোর্ড ইউজ করি। কিন্তু অনেকেই বাংলা টাইপিং করতে পারে না। একে তো টাইপিং করতে পারে না, আবার অন্যরা বাংলা টাইপিং করলে ব্যঙ্গ চোখে দেখে। মন থেকে এটি মেনে নিতে পারে না। আনস্মার্ট, গেয়ো, খ্যাত ভাবে। হয়তো অনেকেই মুখে বলে না। কিন্তু আচার আচরণে বোঝা যায়। এ যুগের ছেলেমেয়েরা বাংলিশ টাইপিংকে স্মার্ট বলে থাকে। এটাই নাকি আধুনিক, যুগের সঙ্গে মানানসই। কিন্তু বাংলিশ অনেকেই বুঝে না, গুরুত্বপূর্ণ কথা বাংলিশ এ লিখলে বোঝা যায় না। কিন্তু বাংলায় লিখলে একটি অক্ষর ভুল হওয়া সাপেক্ষেও সুন্দরভাবে বোঝা যায়। বাংলা টাইপিং এ যে টান থাকে তা বাংলিশে নেই। সাময়িকভাবে লেখা দ্রুত হলেও খাপছাড়া একটা ভাব থাকে। অনেকই ইচ্ছে করে বাংলা টাইপিং করে না। অনীহা দেখায় বাংলা টাইপিংয়ে। একটা গা-ছাড়া ভাব। মনে করে বাংলিশই সুপারস্টার। কিন্তু সে যে একটা ভুলের মধ্যে আছে সেটা কখনো অনুধাবন করে না।
বর্তমানে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রায় ৪.৮ কোটি। প্রতি ৩ জনের ১ জন ফেসবুক ব্যবহার করে এই দেশে। এখন প্রশ্ন হলো- কতজন মানুষ বাংলা টাইপিং করে? কত জন মানুষ বাংলা টাইপিংয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে? অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে উত্তর আসবে অর্ধেক মানুষও বাংলা টাইপিং করে না। বেশির ভাগ মানুষ বাংলিশ টাইপিং করে। তাহলে কি বাংলা এতটাই সস্তা হয়ে গেল। তাহলে কি এতটা আত্মত্যাগ- মহিমা বিসর্জন মূল্যহীন হয়ে পড়লো।
আবার দেখি অনেকে মেসেঞ্জারে অভ্রতে লিখে। কেন? সরাসরি আমরা প্রভাতে লিখতে পারি না? বাংলাকে আমরা মন থেকে ভালবাসি, কোনো ফাঁক ফোকর রেখে ভালবাসলে ভাষার ভালবাসা পূর্ণতা পায় না। আর বাংলা তো মায়ের ভাষা। যে ভাষায় সাদা কাগজে কালো কলমে লিখতে কার্পণ্য আসে না, সে ভাষায় টাইপিংয়ে কি সমস্যা? আমরা বাংলা লিখতে পছন্দ করি কিন্তু কেন বাংলা টাইপিং করতে পছন্দ করি না? বাংলা টাইপিং কি মায়ের ভাষার সম্মান বাড়ায় না? বাংলা টাইপিং কি বাংলা ভাষাকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় না? বাংলা টাইপিং কি শহীদের মর্যাদা বাড়ায় না? কেন আমরা পাশ্চাত্যের লোভে পড়ে বাংলা টাইপিংকে আনস্মার্ট ভাবছি? কেন মনে হচ্ছে বাংলা টাইপিং কঠিন, সময়সাপেক্ষ ব্যাপার? কেন আমরা ১৬ বছরে বাংলা টাইপিং শিখলাম না? কেন আমরা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধে বাংলা টাইপিংয়ে অনীহা করি? প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যায়। যার উত্তর পাওয়া খুবই মুশকিল। প্রথমদিকে বাংলা টাইপিং একটু কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। কিন্তু কয়েকদিনের মাথায় সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। তারপর যে শ্বাশত অনুভূতি হয় তা বলে বোঝানো যাবে না। তখন নিজে থেকেই বাংলা টাইপিং কেউ ছাড়বে না। অনেকেই ইংরেজি বা বাংলিশে প্রশ্ন করলেও ইচ্ছে হবে না বাংলিশে উত্তর দিই। মনে হবে বাংলায় উত্তর দিই। তখন বাংলার প্রতি মহত্ত্ব বেড়ে যাবে আরো একধাপ। এ ধাপ মায়ের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগায়।
আবার দেখি অনেকেই লিখে ইউ কেমন আছো? এটা কোন ভাষা, আবার তো বুঝে আসে না। আধুনিক মানে এই নয় ভাষাকে মিশ্র করা। নিজের মতো ভাষাকে বিকৃত করে হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি করবো। ভাষার মান কমানো।
মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা- তোমার কোলে তোমার বোলে কতই শান্তি ভালবাসা। একজন বাঙালির জন্য বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারা কতটা সৌভাগ্যজনক তা সে নিজেও জানে না। হয়তো এর কোনো সীমানা নেই। এর পরিসীমা খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলা ভাষায় যে শাশ্বত অনুভূতি আছে, তা পৃথিবীর কোথাও নেই। জোর করে সবই সম্ভব কিন্তু ভাষা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। বাংলাভাষাকে রক্ষা করার জন্য বাংলার সাহসী সৈনিকরা জীবন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি। দীর্ঘ নয়মাস যুদ্ধ করতে হয়েছে, মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষা করা জন্য। শুধু কি এই নয় মাস, তার আগে কত বৈষম্য গঞ্জনা ব্যঞ্জনার কটুক্তির শিকার হতে হয়েছে। অবশেষে আমরা পেয়েছি নিজের মায়ের বাংলাভাষা।
এখনো চোখ বন্ধ করে ১৯৭১ সালের কথা চিন্তা করলেই চোখে ভেসে আসবে লাশের পর লাশ। লাল রংয়ে ছেঁয়ে যাওয়া নদী। তাদের অকালে জীবন গিয়েছিল শুধুমাত্র একটি ভাষার জন্য। শুধুমাত্র মায়ের ভাষার সতীত্ব রক্ষার জন্য। সেই বাংলাভাষাকে কি আমরা অবজ্ঞা করতে পারি?
আধুনিকের চাকচিক্যের বাহুল্যতা বন্ধ না করলে আমরা বাংলা ভাষার ত্যাগের মহিমা কিভাবে বুঝবো? বাংলা টাইপিং একটা দেশপ্রেম। যে দেশপ্রেমে রয়েছে মনের গভীর আত্মতৃপ্তি। যে আত্মতৃপ্তি পেতে হলে মন থেকে বাংলা টাইপিংয়ের মহত্ত্ব বুঝতে হবে। বাংলা টাইপিং বাঙালি মননে সঞ্চারিত বাংলাভাষার ভালবাসার স্পন্দন। যারা বাংলাকে ভালোবাসে তারা কখনো বাংলিশ টাইপিং করে না। আমাদের চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। মানবিকতার বিকাশে মন থেকে ভাষাকে শ্রদ্ধা করতে হবে। আসুন আমরা বাংলা টাইপিং করি ও অন্যদেরকে এবিষয়ে উৎসাহিত করি।
মাহমুদা টুম্পা শিক্ষার্থী ব্যবস্থাপনা বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া