মেয়েদের ফুটবল মানেই এখন দর্শকদেও উন্মাদনা। মেয়েরা এনে দিচ্ছেন সাফল্য অথচ ছেলেরা ভোগ করছেন সব সুযোগ-সুবিধা।
এশিয়া ও সাফে বাংলাদেশের ফুটবল বিশেষ করে ছেলেদের ফুটবল তেমন একটা উল্যেখ করার মতো না হলেও, নারী ফুটবল এখন চলছে সোনালী যুগ।তাদের একের পর এক সাফল্য আর ইতিহাস বর্তমানে সাফে তো বটেই এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনে (এএফসি) আলোচনার দাবী রাখে। মেয়েদের এই ধারাবাহিক সাফল্যে এখন উৎসাহিত করছে বাবা-মা দেরও। সাবিনা খাতুন, রূপনা চাকমা, মারিয়া মান্দা, কৃষ্ণা, মার্জিয়া, মনিকা, আঁখি খাতুনরা একেকজন এখন ব্র্যান্ড নারী ফুটবলে। তাদের দেশের মানুষ সারাজীবন মানুষ মনে রাখবে নিঃসন্দেহে। সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি দেশেবাসিকে উপহার দিয়েসম্প্রতি অভিনন্দনের বন্যায় ভেসেছে সাবিনারা।এতে বাংলাদেশের নারী ফুটবলে ইতিহাস গড়ে সোনালী যুগে এখন তারা। এই ইতিহাস রচনায় খেলোয়াড়, প্রশিক্ষক, ট্রেনার আর অফিসিয়ালদের মাঝে একটা বড় একটা পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।
এএফসি ও ফিফা আমাদের এতদিন ফুটবল জাতি হিসেবে গণ্য করতো বলে মনে হয়না, এখন আমাদের অনেকটাই মার্যাদা বাড়িয়েছে তাদের কাছেসাবিনা-আখিঁরা। এতে নারী ফুটবলের জাগরণ উঠেছে। সাবিনা-মারিয়ারা বছরের পর বছর চেষ্টা, কঠোর পরিশ্রম, আর মেধাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের গড়ে তুলেছে। তাদের ওই পরিশ্রম ও ত্যাগের ফসল আজ দেখতে পারছি আমরা। শুধু তাই নয় এ সাফল্যে মেয়েরা আর্থিক ও সামাজিকভাবে বেশ লাভবানও হচ্ছে। সরকারি ভাবে তারা বাহবা পাচ্ছে। দেশের মানুষ তাদের সম্মান করছে। একদিন এই মেয়েরা সমাজে না খেয়ে দিন কাটাতো আজ তারা যাকাত ফেতরা দেয়ার যোগ্য হয়েছে। এটা তাদের ফুটবলই দিয়েছে। আজকের সাফ জয়ী নারী ফুটবলাররা কেবল দেশেই না বিদেশের ফুটবল লিগেও খেলার অফার পাচ্ছে। এই স্বীকৃতি তাদের বিশাল প্রাপ্তি।এটাকম কিসের। এদিকে ফিফা ওয়ার্ল্ড র্যাংঙ্কিয়ে যেখানে ২১১ দেশের মধ্যে আমাদের ছেলেদের অবস্থান ১৯২ তম, সেখানে মেয়েরা ১৮৮ দেশের মধ্যে ১৪০ তম। সাম্পতিক সাফল্যের বিবেচনায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই এগিয়ে আছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, মেয়েরা এনে দিচ্ছেন সাফল্য অথচ ছেলেরা ভোগ করছেন সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা!
বঙ্গমাতা ফজিলাতুনেসা ফুটবল টুর্নামেন্ট ফ্যাক্টরি থেকে জন্ম নেয়া এই নারী ফুটবলাররা এখন দক্ষিন এশিয়ার সেরা। সরকারের পক্ষ এমন সুযোগ করে না দিলে এমন ফলাফল আমরা হয়তো দেখতে পেতাম না। এ জন্য অবশ্যই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। বিগত দিনে ভারত এর মতো শক্তিশালী দলের কাছে বাংলাদেশের মেয়েরা কোনঠাসা ছিলো- এখন অনুর্ধ্ব-১৬-১৭, অনুর্ধ্ব-২০ এমনকি জাতীয় দলও ধরাশাহী হচ্ছে। এটা আশার কথা। সত্যিই অসম্ভব উন্নতি করেছে বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা।
এদিকে, ধারাবাহিক সাফল্যের কারনে সাবিনা-কৃঞ্চাদেরক্যাটাগরিভিত্তিতে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) পরিশ্রমিকের পরিমান বাড়িয়েছে।এক সময়ে `এ` ক্যাটাগারিররাবেতন পেতেন ১০ হাজার, বাকিরা ৫ হাজার ৩ হাজার টাকা করে। সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তাদের বেতন এখন আলোচনার মাধ্যেমে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাফুফে। তাদের দাবী ছিলো অবশ্য মাসিক বেতন ৫০ হাজার। বাফুফের সভাপতি অবশ্য জানিয়েছেন, মেয়েদের দাবী বাস্তবায়ন করতে পারলে খুশি হবো। বাফুফে ভবনেই নারী ফুটবলারদের আবাসিক ক্যাম্প। এক ছাদের নিচে ৬০-৭০ জন ফুটবলার থাকেন। মাসিক কিছু বেতনের সঙ্গে তাঁদের সবকিছুই দেখভাল করে ফেডারেশন। ক্যাম্পে থাকা প্রতি ওদেরখাবার বাবদ প্রতিদিন বাফুফের ব্যয় করতে হয় ৭০০ টাকা। তাঁদের চাওয়া পূরণ করতে হলে ব্যয় বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ১২০০ টাকা। মেয়েদের সব দাবি অযৌক্তিক দেখছেন না বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন।
বাংলাদেশের নারী ফুটবল আসলে শুরুতে যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর চেষ্টায়বদলে গেছে আদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু। দেশের মহিলা ফুটবল প্রসারে রেখেছেন বিশেষ অবদান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাফুফের মহিলা কমিটির প্রধানের পদটি ছিল তাঁরই। বাফুফে ভবনের তৃতীয় তলায় বসতেন। সাফের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব ওখান থেকেই পরিচালনা করেন। তারপর মহিলা ফুটবল নিয়ে তাঁর কাজের সময়টা ওই কক্ষেই কাটত। এসেছে একের পর এক সাফল্য। বিশেষ করে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে বড় শক্তি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। যার নেপথ্যের নায়ক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। তারই হাত ধরেই বদলে গেছে দেশের নারী ফুটবল। শুধু শিরোপাগুলোর কথা বলে গেলে মাঠে বাংলাদেশের মেয়েদের দাপটের কথা পুরোপুরি ফুটে উঠবে না। যদি না অনূর্ধ্ব-১৮ সাফে পাকিস্তানের জালে ১৭ গোল,অনূর্ধ্ব-১৫ সাফে পাকিস্তানকে ১৪-০ গোলে হারানোর খবরটা ছিলো সুখের। বয়সভিত্তিতে প্রায় সবগুলো প্রতিযোগিতাতেই বাংলাদেশের সাফল্যগুলো ছিলো গোল উৎসবের। অথচ একটা সময় বাংলাদেশের মেয়েদেরও ডজন ডজন গোল হজম করছে। ২০০৩ সালে ঘরোয়া ফুটবল চালুর পর আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের মেয়েদের অভিষেক ঘটে ২০০৫ সালে। দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবলের সেই আসরে জাপানের কাছে ০-২৪ গোলে হেরেছে সাবিনারা।
সর্বশেষ বঙ্গমাতা আন্তর্জাতিক নারী গোল্ডকাপ ফুটবলে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে আসরের ফাইনাল হতে পারেনি। লাওসের সঙ্গে বাংলাদেশ যৌথ চ্যাম্পিয়ন হয়। অপরাজিত থেকেই মৌসুমী-মনিকারা ফাইনালে ওঠে এবং সেটা সংযুক্ত আরব আমিরাত, কিরগিজস্তান, মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে দাপুটে ফুটবল খেলে। ২০১৮ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের বাছাইয়ে আরব আমিরাতকে ৭-০ ও লেবাননকে ৮-০ গোলে হারায় বাংলাদেশ। মেয়েদের ফুটবল মানেই এখন দর্শকদের এমন উন্মাদনা। তাদের নিয়ে প্রত্যাশা অনেক। নারী ফুটবলে এখন আসলে এটা উন্মাদনা তৈরি হয়েছে। যে কোন টুর্নামেন্ট খেলতে নামলেই দর্শকরা জয় ছাড়া অন্য কিছু মেনে নিতে চায়না, সেটা যে কোন দলের বিপক্ষেই হোক। অবস্থানটা এমনই তৈরি হয়েছে। আসলেসাফ ট্রফি জয়ের পর থেকে বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের প্রতি ভক্ত সমর্ধকদের আস্থা প্রত্যাশা বেছে গেছে এটাই স্বাভাবিক। এক নজরে নারী ফুটবল দলের সাফল্য- এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ গার্লস রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৫, নেপাল। ২০ ডিসেম্বর ২০১৫, ফাইনাল। বাংলাদেশ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ গার্লস রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৬, তাজাকিস্তান। ২৮ এপ্রিল ২০১৬ ফাইনাল। বাংলাদেশ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ওমেন্স চ্যাম্পিয়ন্সশিপ ২০১৭, কোয়ালিফায়ার্স। ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ফাইনাল। বাংলাদেশ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ওমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৭, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ফাইনাল। অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। জকি ক্লাব গার্লস ইন্টারন্যাশনাল ইয়ুথ ফুটবল টুর্নামেন্ট ২০১৮, হংকং। ১ এপ্রিল ২০১৮। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ওমেন্স চ্যাম্পিয়ন্সশিপ ২০১৯, কোয়ালিফায়ার্স, ঢাকা। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮। বাংলাদেশের মেয়েরা অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ ওমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৮, নেপাল। ৭ অক্টোবর ২০১৮। বাংলাদেশ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ মহিলা আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতা ২০১৯, ঢাকা। ৩ মে ২০১৯। বাংলাদেশ অপরাজিত যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন। সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ ওমেন্স চ্যাম্পিয়ন্সশিপ ২০২১। ২২ ডিসেম্বর ২০২১। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন। সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ ওমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২২। ভারত। ২৫ মার্চ ২০২২। বাংলাদেশ রানার্স আপ। দুটি ফিফা টায়ার ওয়ান আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ। প্রতিপক্ষ মালয়েশিয়া। ২৩ ও ২৬ জুন ২০২২। দুটি ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা দলের সিরিজ জয়। সাফ ওমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২২, নেপাল। ০৬-১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২। বাংলাদেশ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন।