দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় ও সংসারের খরচ বেড়েছে। বেতনের তুলনায় সংসারের ব্যয় অনেক বেশি। তাই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন অনেকে। কিন্তু আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ীয় সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে তারা হিমশিম খাচ্ছে। তাই ভোক্তা ঋণের গ্রাহক খেলাপি হয়ে পড়ছে। সাধারণত গাড়ি, আসবাবপত্র বা ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর মতো পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের সাধারণত ভোক্তা ঋণ দিয়ে থাকে।
কেন্দ্রীয় হালনাগাদ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ভোক্তা ঋণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৮৫২ কোটি টাকা, যা এ খাতে বিতরণকৃত ঋণের চার শতাংশেরও কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৭ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ ভোক্তা ঋণ। আর বর্তমানে ভোক্তা ঋণের খেলাপি তিন হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে।
ভোক্তা ঋণ বিতরণে শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সোনালী ব্যাংক। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির ভোক্তা ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ আট হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানে থাকা ব্র্যাক ব্যাংকের সাত হাজার ৫৯১ কোটি, চতুর্থ অবস্থানে থাকা দ্য সিটি ব্যাংকের ছয় হাজার ৬৪২ কোটি এবং পাঁচে থাকা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ছয় হাজার ৫৪২ কোটি টাকা।
ভোক্তা ঋণে খেলাপির মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকে। এসব ব্যাংকের ৬৪ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে দুই হাজার ৬২৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের ২৬ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকার বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ৯১২ কোটি টাকা খেলাপি। বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর ছয় হাজার ১১৬ কোটি টাকার ঋণের ২৪৫ কোটি খেলাপি ঋণ এবং বিশেষায়িত ব্যাংকের ৩৪ কোটি টাকার ঋণের ১৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ।
পরিমাণের দিক থেকে ভোক্তা ঋণের খেলাপির শীর্ষে অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৪০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের ৫৪১ কোটি, তৃতীয় অবস্থানে থাকা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ২৫৬ কোটি, চতুর্থ অবস্থানে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের ২৫৩ কোটি এবং পাঁচে থাকা দ্য সিটি ব্যাংকের ২০২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে।
সাধারণভাবে ভোক্তা ঋণ অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহত হয়। ভোক্তা ঋণ বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে ভোক্তা ঋণ নিয়ন্ত্রণের পক্ষে মত দেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ভোক্তা ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এতে মানুষের সংসারের খরচ ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। কিন্তু সেই অনুপাতে আয় বাড়েনি অনেকের, বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের। ফলে খরচের তালিকা ছোট করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। আবার অনেকেই তা পারছেন না। যারা পারছেন না, তারা ঋণ নিয়ে হলেও বাড়তি খরচ সামাল দিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, রোজার মাসেও পণ্যমূল্য বাড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। এর ফলে খরচ বেড়ে সাধারণ মানুষের অবস্থা আরও খারাপ হবে, যার চাপ পড়বে মূল্যস্ফীতিতেও।
জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই ভোক্তা ঋণে খানিকটা কড়াকড়ি আরোপ করে আসছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে করোনার কারণে স্থবির অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরিতে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর ভোক্তা ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণে ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে সব ধরনের অশ্রেণিকৃত ভোক্তা ঋণে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হতো, যা ওই সময় কমিয়ে দুই শতাংশ করা হয়। এ ছাড়া ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্যসব ভোক্তা ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এর পর থেকে ভোক্তা খাতে ঋণ বিতরণে বেশ আগ্রহ দেখায় ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে সুদের হার তুলনামূলক কম হওয়ায় সাধারণ মানুষও সংসারের বাড়তি খরচসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে এই ঋণ নিতে উৎসাহিত হয়। তবে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে ভোক্তা ঋণের সুদহার সীমা বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত ত্রৈমাসিক তফসিলি ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষ তিন মাসে ভোক্তা ঋণ বেড়েছে ১৬ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা বা ১৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১ সালের পুরো সময়ে ভোক্তা ঋণ বেড়েছিল মাত্র ১৩ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা বা সাড়ে ১৬ শতাংশ। করোনা মহামারির বছর ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ভোক্তা ঋণের পরিমাণ ছিল ৮১ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। শুধু ভোক্তা ঋণের পরিমাণই নয়, এ সময়ে ভোক্তা ঋণের গ্রাহকও বেড়েছে বেশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ভোক্তা ঋণের মোট গ্রাহক ছিল ২৮ লাখ ১০ হাজার ৪৭২ জন, যা গত বছর ডিসেম্বরে বেড়ে হয়েছে ৩১ লাখ ৫৩ হাজার ২২ জন। এ হিসাবে ২০২২ সালে ভোক্তা ঋণের গ্রাহক বেড়েছে তিন লাখ ৪২ হাজার ৫৫০ জন।