নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর মোহাম্মদপুর সংলগ্ন বেড়িবাঁধের গা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে শ’য়ের উপর গরু-মহিষের দুগ্ধ খামার, যেখানে দুধ উৎপাদন ছাড়াও প্রতিদিন উৎপাদিত হয় বিপুল পরিমাণ দুগ্ধজাত খাদ্যপণ্য- বিভিন্ন ধরণের মিষ্টিসহ দই, ঘি, মাঠা এবং নানা প্রকার বেকারী সামগ্রী। এর সাথে কিছু খামারে সারা বছর উৎপাদন ও বিক্রি করা হয় মধু, সরিষার তেল, সুগন্ধি চাল, বিভিন্ন প্রকার ডালসহ রকমারি খাদ্যপণ্য।
কিন্তু এ খামারগুলোর উৎপাদিত পণ্য বছরের পর বছর দেদারছে বিক্রি হচ্ছে উৎপাদনের তারিখ ও মেয়াদের কোন উল্লেখ ছাড়াই। খামার মালিকদের অনেকেই জানেন না তাদের পণ্যে মেয়াদ উল্লেখ না থাকা আইন-বিরুদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য। এ ব্যাপারে তাদের সতর্ক করারও যেন কেউ নেই। এ নিয়ে সচেতন ক্রেতারা প্রশ্ন তুললে উল্টো খামার মালিকদের ধমক খেতে হয় ক্রেতাদের। এভাবেই চলে আসছে এ খামারগুলোর পণ্য উৎপাদন কারবার।
খোদ রাজধানী- যেখানে জনবসতির মধ্যে গরুর খামার থাকাই উচিৎ নয়, সেখানে খামার করে মেয়াদ উল্লেখ ছাড়াই খামারে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করছে খামারীরা ভ্রুক্ষেপহীনভাবে। এ অবস্থা কম-বেশি সারা দেশেই। যত্রতত্র বেকারী, সেমাই কারখানা এবং অন্যান্য নিত্যপণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করা হচ্ছে কোন রাখঢাক ছাড়াই।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত পণ্য ও খাদ্যপণ্য বিপণনের আগে মেয়াদের বিষয়টি কঠোরভাবে নজরদারি করা হয়। বিভিন্ন দেশে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এ-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। বাংলাদেশেও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে মেয়াদ বসানো বাধ্যতামূলক। তবে সেটা অনেকটাই কাগুজে কথা। জোরালো নজরদারি না থাকায় অনুমানের ভিত্তিতে মেয়াদ ও উৎপাদনের তারিখ বসানোর অভিযোগ রয়েছে। কারণ অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে দেশজুড়ে। এই সব হাতুড়ে উৎপাদকদের কাছ থেকে বিশেষজ্ঞের মতামতে সেলফ লাইফ স্টাডি করে পণ্যে মেয়াদ বসানোর আশা করা কল্পনারও বাইরে।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন-বিএসটিআই খাদ্যপণ্য অনুমোদন ও মেয়াদ রাখার বিষয়টি নির্ধারণ করলেও কীভাবে এসব দেয়া হচ্ছে তা খুব একটা খোঁজ রাখেন না বলে অভিযোগ আছে। যদিও তারা পণ্যে মেয়াদ উল্লেখের বিষয় নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, তারা নিয়মিত এসব বিষয় তদারকি করেন। কোনো প্রতিষ্ঠানের সেলফ লাইফ স্টাডির সঙ্গে পণ্যের মানের ভিন্নতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে- জানান কর্মকর্তারা।
দেশে মোড়কজাত খাদ্যপণ্যের গায়ে মেয়াদ ও উৎপাদনের তারিখ বসাতে কোনো নিয়মনীতিরই তোয়াক্কা করছে না উৎপাদক ও বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলো। অনেকটা আন্দাজের ওপরেই তারা পাস্তুরিত দুধ, বেকারি পণ্য, পোল্ট্রি মুরগির মাংসসহ নানা খাদ্যপণ্যের মোড়কে উৎপাদন ও মেয়াদের তারিখ বসাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কিসের ভিত্তিতে এই মেয়াদের দিন নির্ধারণ করছে তা জানতে মাঠে নেমেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। আগামী মার্চের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশনা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এমন অবস্থায় এবার পণ্যে মেয়াদ দেয়ার বিষয়টি দেখভালে মাঠে নেমেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। ভেজাল, মানহীন খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বিক্রি রোধে কাজ করে যাওয়া প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়েছে নির্দেশনাপত্র। আলাদা করে সবাইকে দিতে হবে খাদ্যপণ্যের মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বা গবেষণার ওপর দেয়া হয় তার সেলফ লাইফ স্টাডি রিপোর্ট।
বিশেষ করে দুধ, বিস্কুট কেকসহ অন্যান্য বেকারি আইটেম, জুস, পোল্ট্রি, মাংস এবং রান্নার জন্য প্রস্তুত থাকে এমন পণ্যের প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হচ্ছে এই চিঠি। আগামী ৭ মার্চের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানকে তাদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জানা যায়, নির্ধারিত তারিখের পর প্রতিবেদন পেয়ে তদন্ত করা হবে। কিসের ভিত্তিতে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান পণ্যে মেয়াদ দিচ্ছে তা খতিয়ে দেখা হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে আসলেই কোনো বিশেষজ্ঞ আছে কি না সেসব দেখার পর ভুয়া প্রমাণ হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই বলেও জানানো হয়। আরও জানা যায়, দেশে এই প্রথম এমন উদ্যোগ নেয়া হলো। উন্নত বিশ্বে এ বিষয়টি অবশ্যই পালন করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে কে কীভাবে তারিখ বসিয়ে দিচ্ছে খোঁজও নাই। এতে জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
এটাই সবটুকু নয়, এসব পণ্যের মধ্যে যেগুলো ফ্রিজে রেখে বিক্রি করতে হয় তা নির্ধারিত তাপমাত্রায় রাখা হয় কি না সেদিকটাও তদারকি করবে প্রতিষ্ঠানটি। পণ্যের বিক্রেতার ফ্রিজিং তাপমাত্রা-১৮ ডিগ্রির ওপরে রাখার নিয়ম। কিন্তু কোথাও এটা মানা হয় কি না তাও দেখা হবে।
জানা গেছে, খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বাজারে ছাড়ার আগে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নেয়। আর সেই মান বজায় থাকে কিনা তা মনিটরিং করার দায়িত্বও তাদের। বাংলাদেশে সব মিলিয়ে ১৮১টি পণ্যের বিএসটিআইয়ের অনুমোদন লাগে। এর মধ্যে কৃষি ও খাদ্যপণ্য ৭৬টি।
উন্নত দেশগুলোতে হুট করে কোনো পণ্য বাজারে আনা সম্ভব হয় না। আমাদের এখানে পণ্য বাজারে আনার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তাদের দায়িত্বে পণ্যে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ দিয়ে থাকে।বাজার থেকে মাঝে মাঝেই এসব পণ্য সংগ্রহ করে তাদের সেলফ লাইফ স্টাডি অনুযায়ী মান ঠিক আছে কি না সেটা পরীক্ষা করা দরকার। সেখানে ভেজাল পেলে ব্যবস্থা নেয়াও জরুরী। রাজধানীতে এই কাজ করার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা আছেন মাত্র ২৫ জন যা প্রয়োজনের তুলনায় যে অপ্রতুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।