স্টাফ রিপোর্টার : ‘আপন ভাগ্য জয়’ করে এগিয়ে চলেছেন নারীরা। সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা প্রতিবন্ধকতা ঠেলে তাদের এ জয়ের সহযাত্রী কিন্তু পুরুষই। তবে সাফল্যের এ কীর্তিগাথা এখন সর্বত্র। আগে নারীর ক্ষমতায়ন ছিল বিলাসী স্লোগান; এখন আনন্দময় বাস্তবতা। নারীর এই সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে যে পথ পরিক্রমণ করতে হচ্ছে, তা কুসুমাস্তীর্ণ নয় মোটেও। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ‘স্কুটি আপা’ নামে পরিচিতি পাওয়া শাহানাজ আক্তার পুতুল ও ডিএমপির ট্রাফিক উত্তর বিভাগের সার্জেন্ট পান্না আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। আলোচনায় তারা জানালেন নিজেদের জীবন-সংগ্রামের কথা।
শাহানাজ আক্তার পুতুল বলেন, লেখাপড়া শেষ করে সংসার জীবনে প্রবেশের পর বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে কোনোরকমে দিন চলে যাচ্ছিল। কিন্তু মেয়ে দুটি যখন বড় হচ্ছিল তখন অস্থির হয়ে উঠি। কীভাবে তাদের মানুষ করবো। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। সিদ্ধান্ত নেই ‘কিছু একটা’ করতে হবে। সেই কিছু একটা করার সিদ্ধান্তের পাশাপাশি স্কুটি চালানোর শখ ও জীবিকার তাগিদ নিয়েই যন্ত্রচালিত দ্বিচক্রযানের হাত ধরা। সড়কে প্রথম প্রথম বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেও এখন অনেকটা স্বাভাবিক।
স্কুটি কিনতে গিয়েও তাকে বিপত্তিতে পড়তে হয় শাহানাজকে। তিনি বলেন, বোনদের কাছ থেকে টাকা ঋণ, নিজের কিছু জমানো টাকা এবং ধার-দেনা করে এক লাখ ৫৮ হাজার টাকা দিয়ে স্কুটি কিনি। তাতে ভালোই চলছিল। কিন্তু একজনকে বিশ্বাস করে।হঠাৎ প্রতারণার শিকার হই। চুরি হয় আমার শখের স্কুটি। তখন অনেক ভেঙে পড়েছিলাম। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। তবে সাংবাদিক, পুলিশের সহযোগিতায় স্কুটি ফিরে পাই।
কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে ‘স্কুটি আপা’ বলেন, ভোরে ঘুম থেকে উঠে সংসারের কাজ শেষ করি। বড় মেয়ের ক্লাস শুরু সকাল ৮টায়। তাকে স্কুলে দিয়ে এসে আবার বাসার কাজে হাত লাগাই। বেলা ১২টায় ছোট মেয়ের স্কুল শুরু হয়। মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসি, এসময় বড় মেয়েকে বাসায় নিয়ে আসি। দুপুর ২টার দিকে ছোট মেয়ের স্কুল শেষ হয়। চেষ্টা করি তাকেও বাসায় পৌঁছে দিতে। তবে এর মাঝে দূরের ট্রিপে গেলে মাঝে-মধ্যে সেটা হয়ে ওঠে না।
আগের তুলনায় এখন অনেক ভালো আছি জানিয়ে শাহানাজ বলেন, আগে যারা আমার যাত্রী ছিল তারা অনেকে এখন আমার কাছ থেকে স্কুটি চালানো শিখছে। সেখানে তাদের একঘণ্টা ট্রেনিং দেওয়া হয়। মা আমার সঙ্গেই থাকেন। কিছু টাকা লোন নিয়ে তাকে একটা টং দোকান করে দিয়েছি। মা-মেয়ে মিলে একটু ভালো থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
সার্জেন্ট পান্না আক্তারের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার আটপাড়া থানায়। কৃষক বাবা খোরশেদ ফকিরের তিন মেয়ে ও তিন ছেলের মধ্যে পান্না পঞ্চম। ২০০৯ সালে বাবার মৃত্যুর পর পান্নার কঠিন পথচলা সহজ হয় মায়ের কারণেই। ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে পান্না আক্তার বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন।
আলাপচারিতায় পান্না জানান, নিজের প্রচেষ্টা আর পরিবারের সর্বাত্মক সহযোগিতায় স্থানীয় ও সামাজিক রক্তচক্ষুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যোগদান করি সার্জেন্ট হিসেবে। প্রথমে অনেকে সার্জেন্ট হিসেবে একজন নারীকে দেখে অবাক চোখে তাকাতেন। পেশাগত এ কাজে ওসব পাত্তা দেয়ার সুযোগ নেই। আমি নিজেকে কখনো নারী সার্জেন্ট ভাবি না। আমার পেশাগত পরিচয় সার্জেন্ট।
রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত সাতরাস্তা মোড়ে দায়িত্ব পালনের ফাঁকে পান্না বলেন, মাঠপর্যায়ে কাজের ক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা পাচ্ছি। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কিছু সীমাবদ্ধতায় বিড়ম্বনায়ও পড়তে হচ্ছে। শুধু আমি নই, প্রত্যেক নারী সহকর্মীকেই ওয়াশরুমের অভাবে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। আমাদের পুরো শিল্পাঞ্চলের মধ্যে একটি মাত্র স্থান রয়েছে রেইনবোতে। সেখানে গিয়ে আমাদের টয়লেট, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ সব কিছু সারতে হয়। এ সমস্যায় শুধু নারী বলেই মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পুরুষ সহকর্মীদের ক্ষেত্রে বাস্তবিক সমস্যা কম। আমার মনে হয় এ জায়গায় আমাদের পরিবর্তন জরুরি।
তিনি বলেন, সার্জেন্ট হিসেবে আমাকে যানবাহনের চালক এবং পথচারীদের নিয়ে কাজ করতে হয়। চালক শ্রেণি অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের পুরুষ সার্জেন্টদের মতো পাত্তা দিতে চায় না। এটা আমাদের অ্যাপ্রোচের কোনো সমস্যা নয়, এটা তাদের সমস্যা। শুরুতে নারী সার্জেন্টদের বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর বেশকিছু অভিযোগ দেয় বাসচালক-হেলপাররা। পরিস্থিতি বুঝে এসব ক্ষেত্রে আমাকে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়েছে। ঠান্ডা মাথায় সামাল দিতে হয়েছে। ভিডিও ক্যামেরা সরবরাহের জন্য ডিএমপিকে ধন্যবাদ। কেউ ঝামেলা করলেই আমরা তা ক্যামেরা অন করে পরিস্থিতি রেকর্ড করছি এবং উর্ধ্বতনদের অবহিত করছি। এখন এ জায়গায় বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। কেউ উল্টাপাল্টা অভিযোগ করতে পারে না।
পান্না বলেন, নারীরা পুরুষের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়। আমি নিজেকে সার্জেন্ট মনে করি, নারী সার্জেন্ট নয়। আমার পদেও নারী শব্দটি নেই। আমি আমার পেশাগত জীবনে সেটাই দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে প্রমাণ করেছি। যে জন্য আমি ট্রাফিক উত্তর বিভাগের শ্রেষ্ঠ সার্জেন্টের পুরস্কার পেয়েছি। আমার পারদর্শিতা আছে বলেই হয়তো গত তিন বছর পুলিশ সপ্তাহের প্যারেড পরিদর্শনে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী গাড়ি চালানোর দায়িত্ব পালন করেছি। বাহিনীর সেই আস্থাটা তো এমনিতে হয়নি। কাজেই সেটার প্রমাণ দিতে হয়েছে।
নারীর ক্ষমতায়নে সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকার প্রশংসা করে পান্না আক্তার বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অবদান অসামান্য। তার নির্দেশনায় পুলিশে সার্জেন্ট হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। প্রত্যেকটি নারী সার্জেন্টই পেশাগত কাজে প্রশংসা অর্জন করেছেন। বাহিনীতে আমাদের কার্যক্রমের পর্যালোচনাও প্রশংসা পেয়েছে। নারীর এগিয়ে যাওয়া, ক্ষমতায়ন ও পদায়নের ক্ষেত্রে পুলিশে নারীর অংশগ্রহণ এবং সফলতা বড় ধরনের উদাহরণ হতে পারে।