নূরে আলম সিদ্দিকী: আগস্ট মাসটি বাঙালি জাতির তথা বাংলাদেশের জন্য শোকের মাস। কিন্তু আমার জন্য এটি হৃদয়ে রক্তক্ষরণের মাস; অনুভূতি, উপলদ্ধি ও মননশীলতার পরতে পরতে অসহ্য ও তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা বহন করার মাস। আজকে ৪৫ বছর হল, মুজিব ভাই আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু আমার অনুভূতিতে, বিশ্বাসে এটা আজও পুরোপুরি সত্যরূপে প্রতিভাত হয় না। আমার মননশীলতা, অনুভূতি, হৃদয়ের অনুরণন, কোনো জায়গায় বঙ্গবন্ধু নেই বা তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন- এটা মানতে পারে না। আমার স্বপ্নের মধ্যে তো বটেই, জাগরণেও তাঁর উপস্থিতি স্পষ্টভাবে উপলদ্ধি করি। এ অনুভূতি কাউকে বোঝানো যাবে না, বোঝানো যায় না। আমার হৃদয়ের নিভৃত কন্দরে তিনি অমলিন। তাঁর সাথে সমস্ত স্মৃতি আমার হৃদয়ে নিত্য জাগ্রত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এ বছরটিকে মুজিববর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। শোকাবহ আগস্টে আমার প্রাণের মুজিব ভাই’র প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। ১৫ আগস্টের সেই নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে নিহত বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সকল সদস্যের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ, তার বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতায় যাদের অথবা যাদের পূর্বসূরিদের অবদান আছে, পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে এই রক্তাক্ত বাংলার যেসব দামাল ছেলেরা অভিষিক্ত, যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে; ৪৭ থেকে ৭১- এই দীর্ঘ পথপরিক্রমণে একেকটি আন্দোলনের সোপান উত্তরণের মাঝে একেকগুচ্ছ তরুণ তাজা তপ্ত প্রাণ অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। কিন্তু এই সবকিছুরই পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ প্রতীক ছিলেন জাতির জনক, আমার প্রাণের মুজিব ভাই।
নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে রাখি, দীর্ঘ কারারুদ্ধ জীবনের মধ্যে ১৭টি মাস প্রত্যহ এত দীর্ঘ সময় ধরে আমি যে তাঁর নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছি, বাস্তবে কারাগারের বাইরে অথবা ভিতরে অনুজ তার অগ্রজের, সন্তান তার পিতার এত নিবিড় সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য হয় না। যেটি আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার হয়েছে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী উদ্ধত-উদ্গত-পূর্ণায়ত পদ্মটির মতো উদ্ভাসিত যৌবনের অধিকারী। আজকের যুবকেরা সেটি অনুধাবন করতে অক্ষম, এটি আমি শতভাগ নিশ্চিত। তখন আমাদের পুরো জীবনটা, চেতনার সমস্ত অংশটুকু রাজনীতির সমুদ্রের অতলান্তে নিমজ্জিত। এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, চাওয়া-পাওয়া সবকিছুই ছিল রাজনৈতিক চেতনার গভীরে নিমগ্ন ।
বাংলার স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের কল্পনার আবর্তে আর কোনকিছুই তখন দোলা দিত না। এই যে স্বায়ত্বশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরণ- এর অগ্রভাগে ছিলেন মুজিব ভাই। তিনি ছিলেন আন্দোলনের স্থপতি। তাঁর কালজয়ী নেতৃত্বকে ঘিরেই আবর্তিত হয় প্রতিটি আন্দোলনের স্রোতধারা। এই সে্রাতধারার স্রষ্টা ছিল ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধুকে বহুজনের মধ্য থেকে একক নেতৃত্বে প্রতিস্থাপিত করার পূর্ণ কৃতিত্ব ছাত্রলীগের। রাজনৈতিক চেতনা হিসেবে আমাদের চিন্তায়, মননশীলতায় সুরের মূর্ছনা তুলতে- “এ মাটি আমার সোনা, আমি করি তার জন্মবৃত্তান্ত ঘোষণা”, ‘‘সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি যে আছে মাটির কাছাকাছি”, “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর”।
লাহোরে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে যখন আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে আইয়ুবকে উৎখাত করার জন্য পাকিস্তানের সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সর্বদলীয় কর্মসূচি গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, সেই সম্মেলনের প্রারম্ভে বঙ্গবন্ধু তখনকার পূর্ব-পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশের তরফ থেকে ৬ দফা কর্মসূচিকে আন্দোলনের প্রধান কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করার দাবী তোলেন। মুজিব ভাই তখন এতটাই প্রদীপ্ত ও অকুতোভয় মানসিকতায় উজ্জীবিত ছিলেন যে, ৬ দফা স্বাধীনতার উপক্রমণিকা- এটি তাঁর প্রতীতি ও প্রত্যয়ে পরিণত হয়।
৬ দফা প্রদানের প্রাক্কালে তখনকার শেখ মুজিবুর রহমান এমনকি পূর্ব পাকিস্তানেও অনেক নেতার মধ্যে অন্যতম ছিলেন। কিন্তু ৬ দফার দাবি উপস্থাপনের পর ছাত্রলীগের নিরলস ও নিরবিচ্ছিন্ন আন্দোলনের বিস্তীর্ণ পথপরিক্রমণের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ তাঁকে বাংলার মানুষের হৃদয়ের সিংহাসনে মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, স্থপতি, মূর্তপ্রতীক। আর একে বাস্তবায়িত করার সুদক্ষ রাজনৈতিক সৈনিক ও প্রতিস্থাপনের মূল কারিগর সন্দেহাতীতভাবে ছাত্রলীগ ও তাঁর নেতৃত্ব।
খুব সম্ভবত ১৯৫৭ সালে, ঝিনাইদহে সাংগঠনিক সফরে গেলে তাঁর মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থা ছিল আমাদের বাসায়। তাঁর খাওয়ার থালায় স্থান সংকুলান হবে না বলে একটি খাঞ্চায় করে একটি ১০/১২ কেজি ওজনের রুইমাছের সম্পূর্ণ মাথা তাঁকে পরিবেশন করা হয়েছিল। তিনি সেখান থেকে ভেঙে ভেঙে তাঁর সতীর্থদের দিয়েছিলেন। মাছের মাথাটি তিনি অত্যন্ত পরিতৃপ্তির সাথে খেয়েছিলেন, এটি আমি বুঝতে পেরেছি। তিনি যখন আমাকে কাছে ডাকলেন, তখন আদৌ বোধগম্য হয়নি যে, ওই মাছের মাথা থেকে তিনি আমাকেও খাওয়াবেন। আমি বিমুগ্ধ হলাম, বিমোহিত হলাম, বিস্মিত হলাম। সেদিন থেকেই এই মহান ব্যক্তিত্বটির প্রতি আমার বিমুগ্ধ, বিমোহিত ও বিস্মিত চিত্তের অনবদ্য আকর্ষণ তৈরি হয়।
তারপর ৬১ সালে আমি ঢাকায় চলে আসি। পারিবারিক সূত্রে আওয়ামীলীগের সাথে আমার যে আশৈশব বন্ধন, সেটি ঢাকায় আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন জানত। আমার সঙ্গীসাথীরা, সহপাঠি অথবা ব্যক্তিগত পর্যায়ের বন্ধুরা সবাই সুস্পষ্টভাবে জানত, আমি আওয়ামীলীগ ঘরানার লোক। আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হলে ওখানকার ছাত্রলীগ সংগঠিত করার দায়িত্ব দেন স্বয়ং মোয়াজ্জেম ভাই। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, মোয়াজ্জেম ভাই কোনো হলে আবাসিকভাবে থাকতেন না। যেখানে থাকতেন, সেই বাড়িটির নাম ছিল ‘নিম ভিলা’।ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের তদানীন্তন নেতৃবৃন্দ নাসির ভাই, আনিস ভাই, কেন্দ্রীয় নেতা শহীদুল হক মুন্সী, আজমত আলী শিকদার ভাই আন্তরিকতা ও সহযোগিতায় আমাকে নিম ভিলায় নিয়ে যেতেন।
এরপর থেকে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের সাথে আওয়ামীলীগ কার্যালয়ে (পুরানা পল্টন) মাঝে মাঝেই যেতাম এবং মুজিব ভাই’র সাথে সাক্ষাৎ হতো। জনান্তিকে জানিয়ে রাখা ভালো, যখন মুজিব ভাই আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতি হলেন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, তাঁদের দুজনের মধ্যে গভীর আন্তরিকতার কারণে এবং মুজিব ভাই’র অনন্যসাধারণ সাংগঠনিক শক্তির বদৌলতে আওয়ামীলীগ এককভাবে বঙ্গবন্ধুর হাতে থাকার কারণে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সাংগঠনিকভাবে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতেন ও তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করতেন। আমি অনেকবার কারাগারে যাওয়া-আসার কারণে আমাকে অনেকেই বি ক্লাস বলতেন। মামলায় বারবার জেলখানায় যাওয়া-আসা করলে, সে শাস্তি নিয়েই হোক অথবা বিভিন্ন মামলার জামিনযোগ্য আসামী হিসেবেই হোক, জেলখানার পরিভাষায় তাকে বি ক্লাস আসামী বলা হতো। বি ক্লাস হওয়া সত্ত্বেও আমি আগে কখনো নিরাপত্তা বন্দী বা রাজবন্দী ছিলাম না। ৬৬ সালের ৯ জুন আমি ডিপিআরে রাজবন্দী হিসেবে কারাগারে ঢুকি এবং আমাকে কারাগারের পুরনো ২০ সেলে স্থান দেওয়া হয়। এর সন্নিকটেই ছিল দেওয়ানী, যেখানে কারাগারে মুজিব ভাইয়ের অবস্থান ছিল। দেওয়ানীর পাশেই ছোট্ট একটি রান্নাঘর, যেটি একান্তভাবেই মুজিব ভাই’র জন্য ব্যবহৃত হতো।
সেবার যখন আমাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললেন, ‘বারবার ঘু-ঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এইবার ঘু-ঘু তব বধিবে পরাণ’। তিনি দ্রুত এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং নিচু স্বরে বললেন, প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে, পরে সয়ে যাবে। তাঁর সেই সান্ত¦নার বাণীতে আমার কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি। কারণ বি ক্লাস থেকে নিরাপত্তা বন্দী হয়ে জাতে উঠেছি। আর মুজিব ভাই-ই নন, নিরাপত্তা বন্দীরাই কুলীন ছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে কারাগার থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার আগ-পর্যন্ত ১৭টি মাস তাঁর নিবিড় সাহচর্য ও সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তারপর ১৯৬৯ এর শেষার্ধে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই এবং তাঁরই নির্দেশে একাত্তরে ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি, যার প্রতিটি সভায় সভাপতিত্ব করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এ সমস্ত দায়িত্ব পালনের সুবাদে স্বাভাবিকভাবেই মুজিব ভাই’র সাথে আমার অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে। তাঁর অপার স্নেহে আমি সিক্ত হয়েছি। এছাড়া পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি আমাকে চাপ সৃষ্টি করেন এবং আমি আমার এলাকা ঝিনাইদহ ২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হই।
মুজিব ভাই’র সাথে আমার অজস্রস্মৃতি থেকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে দুয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করছি। যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিষয়টি আইয়ুব খান চূড়ান্ত করে ফেললেন এবং মুজিব ভাইকে (তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হননি) আসামি করে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলানোরও তাদের দুরভিসন্ধি তখন পাকাপোক্ত হয়ে উঠল। তখন মুজিব ভাইকে সম্পূর্ণ বিছিন্ন করার তাদের সিদ্ধান্তটি সুস্পষ্টভাবে জানাজানি হয়ে গেল। তখনকার এক বিকেলে আমরা জেলখানার অভ্যন্তরে দেওয়ানী এবং ২০ সেল মিলে যে চত্ত্বর ছিল তা হাঁটার জন্য তো বটেই এমনিতেও বিস্তীর্ণ। মুজিব ভাই ও আমি পাশাপাশি হাঁটছিলাম। হঠাৎ মুজিব ভাই আমার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমি বিস্ময়াভিভূত নয়নে তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। তখন তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আলম, কালকে তোর ভাবী দেখা করতে আসলেআমি তাকে আর খাওয়া আনতে নিষেধ করে দেব। আমার খানেওয়ালাই যদি আমার কাছে না থাকে(জেলখানায় আমি এত খেতাম যে আমার সহযোদ্ধা রাজবন্দীরা আমাকে খাদক বলে অভিহিত করত) তাহলে বাহির থেকে এত খাওয়া এনে লাভ কী? শুধু শুধু রেনুর উপরে বাড়তি ঝামেলা চাপানোর তো কোন মানে হয় না। আমরা তো আগেভাগেই জানতাম, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিই শুধু নয়, তাকেও নিঃশেষ করে দেওয়ার একটা জঘন্য পায়তারা চলছে। আমিও অবরুদ্ধ। বুকফাঁটা আর্তনাদ করারও সুযোগ নেই। কিন্তু অনুভূতির রক্তক্ষরণ অনেকটাই বৃদ্ধি পেল। আমার দুটি চোখ কেবল অশ্রুসিক্তই হয় নাই, আমি তাঁর হাতটা চেপে ধরা অবস্থাতেই সশব্দে কেঁদে দিয়ে বলেছিলাম, মুজিব ভাই, ওরা সত্যিই কি আপনাকে মেরে ফেলবে? ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে তো আপনি বিশ্বাস করেন না। আপনি বিচ্ছিন্নতাবাদীও নন, তবে আপনার প্রতি কেন তাদের এত আক্রোশ? আইয়ুব জান্তার কেন এত জেদ? আপনি আপোসহীন পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য হিস্যার দাবীতে। পরে যখন মুজিব ভাইকে দেওয়ানী থেকে সরিয়ে সমস্ত বন্দীদের লকআপের পরে তাঁকে অজানা গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমি দেওয়ানীর পাশের সেল নতুন ২০-এ ছিলাম। তখন আমাদের তত্ত্বাবধানে থাকা ডেপুটি জেলারগণ, বিশেষ করে শামসুর রহমান ও তোফাজ্জল হোসেন আমাদের সমবয়সী ও বন্ধুপ্রতিম ছিলেন, তাদেরকে অনুরোধ করায় তারা নিজেদের চাকরির ঝুঁকি নিয়ে আমাকে সুযোগ করে দিতে সেদিন নতুন ২০-এ লকআপ করেননি। ফলে যে রাস্তা দিয়ে মুজিব ভাইকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সেই রাস্তার সন্নিকটে একটি কলাপসিবল গেট ধরে আমি অঝোরধারায় কাঁদছিলাম। মুজিব ভাই তার স্বভাবসুলভ পাজামা-পাঞ্জাবি, মুজিব কোট পরা অবস্থায় হাতে পাইপ, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পরে খুবই গম্ভীর মননশীলতা ও মননে ধীর পদক্ষেপে জেল পুলিশদের সাথে হেঁটে যাচ্ছিলেন। যদিও অবলীলাক্রমে তিনি পাইপ টানছিলেন, তবুও তাঁর মুখম-লে একটা চরম দুশ্চিন্তার ছাপ পরিস্ফূট হয়েছিল, যা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। আমি চরম আবেগাপ্লুত হৃদয়ে চিৎকার করে বললাম- মুজিব ভাই, তোমাকে কি ওরা মেরে ফেলবে? আর কখনো কি তোমার দেখা পাব না? আমরা পূর্ব বাংলাকে জীবনের বিনিময়ে মুক্ত করব, ইনশাল্লাহ। তবুও তোমার শেষ নির্দেশনা দিয়ে যাও। মুজিব ভাই ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। ডান হাতে পাইপ ছিল। বা হাত উঁচিয়ে বললেন- ওরা যদি আমাকে মেরেও ফেলে, তবুও চলমান আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেও। পাকিস্তানীদের অপশাসন হতে পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করতেই হবে। এ দায়িত্ব আমি তোমাদের হাতে রেখে গেলাম। পথবিচ্যুত হয়ো না। ভয়ভীতি নির্যাতন নিগ্রহকে তোমাদের উপেক্ষা করতে হবে। এর বেশি কথা বলার সুযোগ তখন আর ছিল না।
বাকশালের বিরোধিতা করে সংসদ ছেড়ে আসার পর ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসায় আমার যাতায়াত প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফুর রহমান মারা যাবার পর মনি ভাই তাঁর সঙ্গে করে আমাকে ৩২ নম্বরে নিয়ে যান। আত্মীয়স্বজন ও শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়া বাসার ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। আমি ৩২ নম্বরের বাড়ির ছাদে গিয়ে পৌঁছালাম। সেখানে বঙ্গবন্ধু অবস্থান করছিলেন। একটি ইজিচেয়ারে বসা অবস্থায় তিনি আমাকে দেখলেন। তাঁর ঠোঁট দুটি কেঁপে উঠল, চোখ অশ্রুসজল হলো। তিনি ইশারায় আমাকে কাছে ডেকে নিলেন। আমি ভীষণভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। তখন হেলিকপ্টারে টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়ার জন্য আত্মীয়দের ও শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছিল। মরহুম জিল্লুর রহমান তাঁর কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে তালিকা প্রস্তুত করতে ব্যস্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি টুঙ্গিপাড়ায় যাবি? প্রচ- ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও হেলিকপ্টারে স্থান সংকুলানের অভাবের কথা চিন্তা করে আমি মুজিব ভাইকে না করেছিলাম।
১৫ আগস্টের দুয়েকদিন আগে বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ হয়। আমি বাকশালে যোগ দিইনি বিধায় আমার সংসদ সদস্য পদ তো এমনিতেই বাতিল হয়ে যাবার কথা। বঙ্গবন্ধু আমাকে পরামর্শ দিলেন, গোপালগঞ্জে তাঁর বাবার নামে স্থাপিত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেয়ার জন্য। জবাবে আমি বলেছিলাম, আমার মনটা এখন খুব খারাপ। আপনাকে পরে জানাব। এই ছিল তাঁর সাথে আমার শেষ কথা।
স্বাধীনতার পূর্বকাল হতেই ভ্রান্তবামেরা বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে আসছিল। বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে তাদের সেই চেষ্টা সফল হয় এবং যত কষ্টদায়কই হোক এটা নির্মম বাস্তব, বাকশাল গঠন ১৫ আগস্টের পটভূমিকা রচনায় অনেকটাই প্রণোদনা প্রদান করে। নেতা অবশ্য আমাকে ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আমি আমার মানুষকে বলেছিলাম, সাড়ে তিন বছর কিছুই দিতে পারবো না। তারা তা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছে। এখন আমি কী করে তাদের শান্ত রাখবো? তাই এখন একটা রেজিমেন্টেশনের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান একটা উন্নয়ন আনতে চাই। তারপর আবার বহুদলীয় ব্যবস্থায় ফিরে আসবো, ইনশাল্লাহ। কিন্তু ১৫ আগস্ট তাঁর সেই ওয়াদা পুরণ করার সুযোগ দেয়নি।
মুজিব ভাইয়ের নেতৃত্বের যে আসন, সেটি মানুষের হৃদয়ে তিলতিল করে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। সে আসনটি ছিল মোঘলদের হীরকখচিত ময়ুর সিংহাসনের চাইতেও মূল্যবান, অতুলনীয়। তাইতো প্রশ্ন এসে যায়, ১৫ আগস্টের পর সারা বাংলাদেশ আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো বিস্ফোরিত তো হলই না, বরং নীরব, নিথর, নিস্পৃহ, নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে রইল কেন? এই নিস্পৃহতার কী কারণ- তার পূর্ণ বিশ্লেষণের ভার আমি ইতিহাসের কাছেই অর্পন করতে চাই। তবুও আমার নিজের ধারণা, ঘটনার আকষ্মিকতা এবং নৃশংস নির্মমতায় সমগ্র জাতি হতচকিত হয়ে গিয়েছিল, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল।
দ্বিতীয়ত- বাকশাল গঠন প্রক্রিয়ার প্রকোপে আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক শক্তি বিধ্বস্থ হয়ে গিয়েছিল। অনেক দল, বিশেষ করে ভ্রান্ত বামের সংমিশ্রনে আওয়ামীলীগ তার নিজস্ব সাংগঠনিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। ভাগের মা গঙ্গা পায় না- এমনই এক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল সে সময়। অন্যদিকে, যাদের উপর সংগঠনসমূহের দায়িত্ব অর্পিত ছিল তারা সকলেই দায়িত্ব পালনে কেবল ব্যর্থই হননি, অনেকটা অস্বীকৃতি জানানোর মতোই ছিল তাদের নিস্পৃহতা। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, রক্ষীবাহিনী রাজনৈতিক নির্দেশের অভাবে সেনাবাহিনী হতে পরিত্যক্ত ২৬ জন ধিকৃত মানুষকে প্রতিরোধ করার জন্য এগিয়ে আসেনি।
বঙ্গবন্ধুকে অকালে হারানোর ক্ষতবিক্ষত আমার হৃদয়কে দীপ্তিহীন আগুনের শিখায় দগ্ধীভূত করে যখন একান্তে ভাবি, বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের গৃহটি আক্রান্ত হওয়ার পর দুই ঘন্টার কাছাকাছি সময় তিনি হাতে পেয়েছিলেন। এই সময়ের মধ্যে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে এবং রক্ষীবাহিনীর যিনি রাজনৈতিক দায়িত্বে ছিলেন- তাদের সবার সঙ্গে টেলিফোনে বারবার পরিস্থিতি জানিয়ে সাহায্যের জন্য, অর্থাৎ ওদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন। কিন্তু বারবার টেলিফোন করার পরও কারো কাছ থেকে তিনি কোন সহযোগিতা পাননি শুধুমাত্র কর্ণেল জামিল ব্যতিরেকে। আমি প্রত্যয়দৃঢ় চিত্তে মনে করি, সশস্ত্রবাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তো বটেই, ন্যূনতমভাবে তাদের দেহরক্ষীদের নিয়ে বের হলেও দুস্কৃতিকারীরা পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করার পথ খুঁজে পেত না। কিন্তু দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুর, মর্মান্তিক শাহাদাতের পূর্বে তিনি বুকভরা বেদনা নিয়ে উপলদ্ধি করে গেলেন, তিনি কতটা একা, নিঃস্ব ও রিক্ত !
১৫ আগস্ট কোন সেনা-অভ্যুত্থান বা কোন বিদ্রোহ হয়নি। কোন জনতার বিপ্লবও সংঘটিত হয়নি। অন্যদিকে হত্যাকারীরা সংখ্যায় যে কেবল ২৬ জন ছিল তাই নয়, তাদের প্রায় সকলেই সামরিক বাহিনী হতে হয় বহিস্কৃত, নয় চাকরিচ্যুত। এখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য নয়, পরিস্থিতি ব্যাখ্যার প্রয়োজনে আমি উল্লেখ করতে চাই, ১৫ আগস্টে আমার হৃদয়ের যে রক্তক্ষরণ, তা আজও বন্ধ হয়নি। এর প্রধানতম কারণ, তখন আমার হাতে কোন সংগঠনই ছিল না। ৭১-এর ২৫ মার্চ সারা বাংলাদেশ যখন পৈশাচিক শক্তি সশস্ত্র পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হল এবং কারফিউ জারি করে নির্বিচারে গুলি ছুঁড়ে নিরীহ নিরস্ত্র নিতান্ত সহজ সরল মাটির মানুষগুলোকে হত্যা করা হল, তখন হৃদয়ের সমস্ত যন্ত্রণাকে প্রশমিত করে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার সংকল্প ও পূর্ব পরিকল্পনাকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রজ্জ্বলিত আকাক্সক্ষাকে নির্দিষ্ট কর্মসূচিতে রূপান্তরিত করি। কারণ, ২৫ মার্চে আমার একহাতে ছিল বাঁশের বাশরি আর হাতে রণতূর্য। কিন্তু ১৫ আগস্টে হৃদয়ে শুধু রক্তক্ষরণ হয়েছে, কিছুই করতে পারিনি। বাকশালের বিরোধিতা করা সত্ত্বেও ১৫ আগস্টের পর আমাকে গ্রেফতার করে দীর্ঘদিন ক্যান্টনমেন্টে তারপর কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯ মাস বন্দী করে রাখা হয়েছিল (রিট করে বেরিয়ে আসি)। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া, আমার একটাই সান্ত¦না এই যে, ১৫ আগস্টে প্রতিরোধ গড়তে না পারলেও নেতার একান্ত বিশ্বস্ত সহকর্মী হিসেবে কারাভোগের মাধ্যমে নেতার প্রতি কিছুটা ঋণশোধ করতে পেরেছি।
লেখক : স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য।
|