স্বাধীন বাংলা প্রতিবেদক রাজধানীর ইস্কাটন থেকে মেরুল বাড্ডা পর্যন্ত দূরত্ব ৪ দশমিক ৩ কিলোমিটারের মতো। গত নভেম্বরে তেলের দাম বাড়ানোর পর সরকার ভাড়ার যে হার ঠিক করে দিয়েছে, তাতে এই পথের ভাড়া ১০ টাকার কম আসে। তবে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা হিসেবে এটাই আদায় করার কথা। কিন্তু এই পথটুকুর জন্য স্বাধীন পরিবহন আদায় করে ২০ টাকা, অর্থাৎ দ্বিগুণ।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর নতুন করে শনিবার বিআরটিএ যে বাস ভাড়া নির্ধারণ করেছে তাতে মহানগরীতে বাড়ানো হয়েছে কিলোমিটারে ৩৫ পয়সা। ফলে এখন থেকে প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীদের গুনতে হবে আড়াই টাকা।
সরকার এই রুটের জন্য নতুন করে এবার যে ভাড়া ঠিক করে দিয়েছে, তাতে কিলোমিটার হিসাবে এই দূরত্বে ভাড়া হয় ১০ টাকা ৭৫ পয়সা। কিন্তু সমস্যা হলো নিশ্চিতভাবেই বলে দেয়া যায়, বাসগুলো এখন ২০ টাকার ওপর বাড়তি হিসাব করে আদায় করবে। এর কারণ আগেও তাই হয়েছে। এই বাড়তি ভাড়া আদায়ে গত কয়েক বছরে রাজধানীতে বাস মালিকরা যে ওয়েবিল পদ্ধতি চালু করেছে, সেটি বন্ধ করতে পারেনি সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ।
গত নভেম্বরে বাস ভাড়া ২৬ শতাংশ বাড়ানোর পর বিআরটিএ জোরালোভাবে বলেছিল, তারা ওয়েবিল বন্ধ করে দিয়ে কিলোমিটার হিসেবে ভাড়া আদায় নিশ্চিত করবে। যারা কথা শুনবে না, তাদের রুট পারমিট বাতিলের হুমকিও দেয়া হয়। কিন্তু নিজের এই হুমকি ভুলে গিয়ে কদিন পরই বিআরটিএর অভিযান থেমে যায়। ভাড়া নির্ধারণ করে কার্যকরে কেন ব্যর্থ বিআরটিএ সারা দেশে প্রায় এক লাখ বাস চলে। ঢাকা মহানগরীতে চলে সর্বোচ্চ ৬ হাজার। এই ৬ হাজার গাড়িতে অনেক সময় কিছু কিছু অনিয়ম হয়। ফাইল ছবি
বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মাদ মজুমদার বলেন, ‘গতবার ভাড়া নির্ধারণ করার পর মালিক সমিতি, শ্রমিক ফেডারেশনের সদস্য বিআরটিএ পুলিশ যৌথ টিম কাজ করেছে, যা কয়েক মাস অব্যাহত ছিল। যারা অতিরিক্ত ভাড়া নিয়েছে আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছি।’ কতগুলো বাস জব্দ করা হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে বলতে পারব না।’ যে ভাড়া নির্ধারণ করেন তার অতিরিক্ত নেন বাস মালিকরা। নির্ধারিত ভাড়া কখনোই কার্যকর করতে পারেন না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহন সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘ভাড়া বাড়ার পরই কিন্তু মনিটরিং শুরু হয়। গতবার ভাড়া বৃদ্ধির পর বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেটরা ছিল।’
ঢাকা শহরে অনেক বাস চলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চোখের আড়ালে যদি করে ফেলে আমাদের নজরে এলে শাস্তি পায় নাই- এমন দৃষ্টান্ত কিন্তু নেই। আগামীকাল থেকে শক্তভাবে মনিটর করা হবে৷ কোনো অনিয়ম পেলে তাৎক্ষণিক আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। প্রত্যেক বাসে ভাড়ার তালিকা বড় করে চার্ট দেব। যদি কেউ না টানায় তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব।’ বাড়তি ভাড়া রোধে বিআরটিএ ৭ জন ম্যাজিস্ট্রেট সব সময় রাস্তায় থাকে দাবি করে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘তারা সপ্তাহের ৬ দিন রাস্তায় থাকে। এরা মোবাইল কোর্ট করতেছে।’
আর যাত্রীরা বছরের পর বছর ধরে ওয়েবিলের নামে বাড়তি ভাড়া দিয়ে চলেছে। আগামী দিনে বন্ধ হবে- এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না। প্রতিটি ওয়েবিলই ২ কিলোমিটার বা এমন দূরত্বে বসানো হয়েছে। আর এই দূরত্বের জন্য সাধারণত ১০ টাকা করে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এই হিসাবে রাজধানীতে বেশির ভাগ বাসেরই ভাড়া কিলোমিটার হিসেবে ৫ টাকা পড়ছে। কোথাও কোথাও তা আরও বেশি পড়ে।
তবে সড়ক পরিবহন সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ওয়েবিল অবৈধ। তাই এমন কিছু দেখলে তারা ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেটরা যদি এ ধরনের অনিয়ম দেখতে পায় তাদের আইনের আওতায় আনা হয়। জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ করব, তাদের যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আছে, তারা যাতে ভাড়া মনিটর করে, যাতে বাড়তি ভাড়া কেউ আদায় করতে না পারে।’
বাস মালিকদের সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ খান নিজের ঘোষণার উল্টো কথা বলেন পরে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘সারা দেশে প্রায় এক লাখ বাস চলে। মহানগরীতে চলে সর্বোচ্চ ৬ হাজার। এই ৬ হাজার গাড়িতে ঢাকা মহানগরীতে অনেক সময় কিছু কিছু অনিয়ম হয়। এ অনিয়ম রোধ করার জন্য আমরা মালিক শ্রমিকরা, ম্যাজিস্ট্রেটসহ দুই মাস ধরে কাজ করছি।
‘আমি নিজেও রাস্তায় ছিলাম আপনারা অনেকে দেখেছেন মহানগরীতে আমরা সব জায়গায় করতে পেরেছি তা না। কোথাও কোথাও আমরা করতে পারি নাই। মালিক সমিতি থেকে নির্দেশ দিলেই সেটা সবাই পালন করবে বাংলাদেশে এমন কোনো সেক্টর এখন পর্যন্ত হয় নাই। যারা মানে নাই, তাদের গাড়ি ডাম্পিং করা হয়েছে। সুতরাং আমরা কোনো অন্যায়কে সাপোর্ট করি না। কোনো অন্যায় হোক সেটা আমরা চাই না, আমাদের চেষ্টাও অব্যাহত আছে।’
ভাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ভাড়ার বিষয়টি তারা (বিআরটিএ) নির্ধারণ করেছে। এখানে সাড়ে ৪২ শতাংশ তেলের দাম বেড়েছে। আর ভাড়া বৃদ্ধি করেছে ২২ শতাংশ।’ ওয়েবিল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই পরিবহন নেতা বলেন, ‘যারা এটা মানবে না তাদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত কাজ চলতেছে।’ অনিয়ম রোধে পরিবহন মালিক সমিতি শতভাগ সফল হয়নি জানিয়ে এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘ঢাকা ছাড়া সারা দেশে আমরা সাকসেস।’
এসি বাসের ভাড়া সরকার নির্ধারণ করে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একজনের দুই কোটি টাকা দামের বাস। একজনের এক কোটি টাকা দামের বাস। সে যে পরিমাণ সেবা দিচ্ছে, সেই পরিমাণ টাকা নিচ্ছে। এসির ভাড়া ট্রাকের ভাড়া সরকার নির্ধারণ করে না।’ বিআরটিএ দূরপাল্লার বাসে নতুন করে ভাড়া বাড়িয়েছে কিলোমিটারে ৪০ পয়সা বা ২২ শতাংশ। ফলে এখন দূরপাল্লায় যাত্রীদের কিলোমিটারে ভাড়া গুনতে হবে ২ টাকা ২০ পয়সা করে।
ফলে আন্তজেলা রুটেও চিত্রটা মোটামুটি একই রকমের। ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত দুটি রুট একরামপুর ও গাইটাল থেকে কাপাসিয়া হয়ে ঢাকার মহাখালী টার্মিনালের দূরত্ব হয় ১১০ থেকে ১১২ কিলোমিটার। নরসিংদী হয়ে যেসব গাড়ি চলে, সেগুলোর দূরত্ব হয় ১২০ থেকে ১২৫ কিলোমিটার। সরকার দূরপাল্লায় ভাড়া ঠিক করে দেয় ৫২ আসনের। কিন্তু এই রুটের বাসগুলোতে আসন ৪৫টির মতো। সেই হিসাবে ৭টি আসন কমলে ভাড়া আনুপাতিক হারে বাড়ানো যাবে।
এই হিসাবে কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৮০ পয়সার জায়গায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি হারে ভাড়া নেয়া যাবে ২ টাকা ১৬ পয়সা হারে। এই হিসাবে কাপাসিয়া হয়ে ভাড়া হওয়ার কথা ২৪০ টাকার মধ্যে। কিন্তু আদায় হচ্ছে ২৭০ টাকা। আগে থেকেই ৩০ টাকা বেশি আদায় করে চলা বাসমালিকদের আসলে নতুন ঘোষণা অনুযায়ী কোনো ভাড়া বাড়ানোর কথা না।
|