স্বাধীন বাংলা রিপোর্ট : প্রচণ্ড গতি নিয়ে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। ঝড়ের প্রভাবে উত্তাল রয়েছে সাগর। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঘণ্টায় ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার গতি নিয়ে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করে সিত্রাং। উপকূল স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রবল ঝোড়ো বাতাস ও বৃষ্টি শুরু হয়। চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত ও কক্সবাজারে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
ঝড়ের তোড়ে উপড়ে গেছে অনেক গাছপালা, সেই সঙ্গে পড়ে গেছে ঘরবাড়ি। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গত রাত থেকে আঁধারে ডুবে আছে অনেক এলাকা। ভারি বৃষ্টিতে নিমজ্জিত অনেক অঞ্চল। আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয় নৌ চলাচল। উড়োজাহাজ ওঠানামায় লাগাম টানা হয়েছে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও যশোর বিমানবন্দরের। গাছ পড়ে বিভিন্ন এলাকায় বন্ধ হয়ে গেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঝড়ের ধাক্কা এসে লেগেছে রাজধানীতেও। দিনরাত ঝরছে বৃষ্টি। রাতে বয়ে গেছে ঝোড়ো হাওয়া। দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রাজধানী ঢাকা, ভোলার দৌলতখান ও চরফ্যাসন, বরগুনা, কুমিল্লা এবং নড়াইলের লোহাগড়ায় ঝোড়ো বাতাসে গাছ ভেঙে ৯ জনের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। সেন্টমার্টিনে ঢেউয়ের তোড়ে ১৩টি ট্রলার ডুবে গেছে। এর মধ্যে ১১টি উদ্ধার করা গেলেও দুটির খোঁজ মেলেনি। ছেঁড়াদিয়ায় একটি জাহাজ ভেসে এসেছে। তবে জাহাজটিতে কোনো লোকজন ছিল না। টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন বাজার এলাকায় ঝোড়ো হাওয়ায় নির্মাণাধীন একটি তিনতলা ভবনের একাংশ ধসে চারজন আহত হয়েছেন। উপকূলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে আমন ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ার খবর মিলেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ, অমাবস্যা তিথি ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যে ক্ষতি বেশি। পাতার নামে নামকরণ পাওয়া ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের অনেক বেশি বিস্তৃতি। এটি গত তিন বছরে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যাসের, যা প্রায় ৫০০ কিলোমিটার।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড়টি আজ মঙ্গলবার ভোরে বাংলাদেশ অতিক্রম করে গতিপথ পাল্টাবে। আরেক আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, মঙ্গলবার সকালের দিকে সিত্রাংয়ের প্রভাব কমে আসতে পারে। তবে এর প্রভাবে দেশের উপকূল এবং অন্য অঞ্চলেও বৃষ্টি হতে পারে।
কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, মঙ্গলবার সকালের মধ্যেই বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়মুক্ত হয়ে যাবে। সকালে আকাশ পরিস্কার হয়ে যাবে। তবে জলোচ্ছ্বাস থাকবে। তিনি বলেন, এবার উপকূলের ক্ষতি কোনো অংশে ইয়াস ও আম্পানের চেয়ে কম হয়নি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে জলোচ্ছ্বাসে। আজ মঙ্গলবার থেকে উপকূলের ক্ষত দৃশ্যমান হতে পারে।
গণভবনে বসে ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতির সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নির্দেশে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মনিটরিং সেল খোলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় উপকূলীয় এলাকার সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ সংশ্নিষ্ট সবাইকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেন, ১৩ জেলায় ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। এসব জেলার মধ্যে রয়েছে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও বরিশাল। গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রতিমন্ত্রী জানান, ৭ হাজার ৩০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২৫ লাখ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। দুর্যোগপ্রবণ জেলাগুলোয় ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি শুকনো খাবার পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড যুক্ত আছে।
গতকাল বিকেল ৩টা থেকে মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বরিশাল বিমানবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। সারাদেশে লঞ্চসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আজ মঙ্গলবারের সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। স্থগিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা। চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজ মঙ্গলবার ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে মোংলা বন্দরে অবস্থানরত দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজের পণ্যবোঝাই, খালাস ও পরিবহনের কাজ। চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি থেকে পণ্যবাহী ১৮টি জাহাজ বহির্নোঙরে সরিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গাছ পড়ে সড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল। তবে রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক।
ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য সমন্বয়ের জন্য ৩২ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়িত্ব দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। সরকারের পাশাপাশি কাজ করছেন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ১ হাজার ২০০ স্বেচ্ছাসেবক। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় সব দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সার্বক্ষণিকভাবে কর্মস্থলে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
উপকূলজুড়ে আতঙ্ক, ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা : ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলের নদনদী ফুলেফেঁপে উঠেছে। তাতে প্লাবিত হয়েছে চর ও নি¤œাঞ্চল। ফলে গতকাল দুপুর পর্যন্ত মানুষ বাড়িঘরে থাকলেও সবকিছু গুছিয়ে বিকেল থেকে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে যাওয়া শুরু করে। অনেকে গবাদি পশু নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে আসতে দেখা গেছে। উপকূলের অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। দুর্বল হয়ে পড়েছে ইন্টারনেট। এতে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়।
খুলনার কয়রায় জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়েছে। এতে বাঁধের কানায় কানায় ওঠে গেছে পানি। পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় গাছের ডালপালা ভেঙে পড়েছে। এতে পটুয়াখালীর অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ আছে। চট্টগ্রাম নগরের উপকূলীয় ও ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকার ওয়ার্ড পতেঙ্গা, হালিশহর, কাট্টলী, লালখানবাজার, পাহাড়তলী এলাকায় ৭৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
চট্টগ্রামে খোলা হয়েছে ১ হাজার ৪৪০টি আশ্রয়কেন্দ্র। বাঁশখালীর ৩৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ১৫ কিলোমিটারের বেশি অরক্ষিত উপকূলীয় এলাকা খানখানাবাদ, কদমরসুল, প্রেমাশিয়া, বাহারছড়া ও ছনুয়ার বাসিন্দারা ঝোড়ো হাওয়ার পাশাপাশি জলোচ্ছ্বাসেরও আতঙ্কে রয়েছেন। আনোয়ারার ১০ কিলোমিটার উপকূলীয় বেড়িবাঁধের কয়েক কিলোমিটার অরক্ষিত বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের গহিরা এলাকায় বেড়িবাঁধের অস্তিত্ব নেই বলে জানিয়েছেন তাঁরা। সীতাকুণ্ডের ২৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের প্রায় আড়াই কিলোমিটার অরক্ষিত। উপজেলার বাঁশবাড়িয়া এলাকার আকিলপুর, বোয়ালিয়ারকুল ও জমাদারপাড়া এলাকার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে গেছে।
|