সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি: আগামী ১৬ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত হবে সুনামগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচন। এবারের নির্বাচনকে ঘিরে প্রথমে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী একাধিক প্রার্থীদের দৌড়ঝাপ থাকলেও দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করার পর স্তব্ধ হয়ে যায় মেয়র প্রার্থীদের নিয়ে নির্বাচনী হাওয়া। কারণ হিসেবে শহরের দুই পরিবারের মধ্যে লড়াই দীর্ঘ বছর ধরে চলে আসলেও এবার নির্বাচনে হাসন রাজার পরিবারের কোন সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ায় বখত পরিবারের একক আধিপত্য দেখা দেয়। ফলে মেয়র প্রার্থী নিয়ে কোন ভোটার কিংবা পৌর নাগরিকের মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া নেই।
তবে বিএনপি’র মনোনীত ধানের শীষের মেয়র প্রার্থী মোঃ মোর্শেদ আলমকে নিয়েই বাজিমাত করার ছক তৈরী করছেন বিএনপি’র নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। বিএনপি দলীয় একাধিক নেতাকর্মীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, বিএনপি’র মনোনীত মেয়র প্রার্থী নতুন হলেও রাজনীতির মাঠে রয়েছে তার শক্তিশালী অবস্থান। অবশ্য বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরাবরই পৌর শহরে বিএনপি’র ভোটের প্রাধান্য থাকলেও মেয়র প্রার্থীর ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায় না।
জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম নূরুলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে মোর্শেদ আলমকে দিয়েই বিএনপি চমক দেখানোর চেষ্টা করছে। জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম নূরুলের নেতৃত্বে প্রতিদিন তৃণমুল নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে নির্বাচনী এলাকায় শো ডাউন দেওয়া হচ্ছে। সেই সাথে পৌরবাসীর চিন্তা চেতনায়ও দেখা দিয়েছে পরিবর্তন। ভোটের দিন যতই গড়াচ্ছে ততই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের আশা করছেন বিএনপি’র কর্মী সমর্থকরা।
এদিকে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী সকলেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত করতে একট্টা হয়ে মাঠে ময়দানে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু সকল কিছুকে চাপিয়ে পাড়া মহল্লা, চায়ের দোকান, পয়েন্টে পয়েন্টে আড্ডায় মেয়র প্রার্থীর চেয়ে কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিয়েই আলোচনা ও সমালোচনাই বেশী দেখা যাচ্ছে।
এবারের পৌর নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামীলীগের বর্তমান মেয়র নাদের বখত, বিএনপি’র মোর্শেদ আলম ও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন চরমোনাইপীরের হাত পাখা মার্কা নিয়ে আলহাজ¦ রহমত উল্লা নির্বাচন করছেন। আর সেকারণেই মেয়র পদের চেয়ে কাউন্সিলর প্রার্থীর সংখ্যা বেশী হওয়ায় ওয়ার্ডবাসী পড়েছেন বিপাকে। এবারের নির্বাচন শীত মৌসুমে হওয়ায় নতুন চাল, খেজুরের রস, খেজুরের গুড়ের ক্ষির খাওয়ার ধুম পড়েছে পাড়ায় পাড়ায় প্রার্থী সমর্থকদের মাঝে। মেয়র প্রার্থীদের নিয়ে যেনো কারোরই কোন মাথা ব্যথা নেই। বিপরীত দিকে কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিয়ে বেশ আনন্দ উৎসব মুখর পরিবেশেই চলছে প্রচার প্রচারণা। সুনামগঞ্জের নির্বাচন বিভিন্ন কারণে দুই পরিবারের মধ্যে আবদ্ধ থাকায় অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীও নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না। বখত পরিবারের ক্লীন ইমেজের সুনাম কুড়ানো সাবেক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদন সুনামগঞ্জ সরকারী কলেজের ভিপি আইয়ূব বখত জগলুল আকস্মিকভাবে ঢাকায় মৃত্যু বরণ করার কারনে গত উপ-নির্বাচনে জন নন্দিত প্রয়াত চেয়ারম্যান দেওয়ান মমিনুল মউজদীনের অগ্রজ দেওয়ান গণিউল সালাদীন চৌধুরী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করলেও নির্বাচন নিরপেক্ষ না হওয়ার প্রশ্ন তুলে এবারের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেননি। এই বিষয়ে তার সমর্থকদের ক্ষোভের মুখে কিছু দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে নির্বাচন না করার কারণ ব্যাখ্যা করে সমর্থকদের শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। যার কারনে আসন্ন পৌর নির্বাচনে নৌকার মনোনীত প্রার্থীর সাথে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপি’র মনোনীত ধানের শীষ মার্কা নিয়ে সাবেক ছাত্রদল নেতা মোঃ মোর্শেদ আলমই ভরসা।
নির্বাচন যাতে একপেশে না হয় সেদিক বিবেচনায় মাঠে নেমেছে বিএনপি। বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী থাকলেও নেই কোন প্রচার প্রচারণা। এদিকে প্রতিদিনই আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকার প্রার্থী বর্তমান মেয়র নাদের বখত ও জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মোঃ মুর্শেদ আলম নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন ৯টি ওয়ার্ডের ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। সুনামগঞ্জের রাজনীতি বহু পরিবারে বিভক্ত হলেও পৌরসভার নির্বাচনে ঐহিত্যবাহী দেওয়ান পরিবার ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হুসেন বখত পরিবারের বলয়ে আবদ্ধ। তার প্রমাণ মিলে গত অর্ধ শতকের বেশী সময় যাবৎ পৌরসভার নেতৃত্বে দেওয়ান পরিবারের মরমী কবি ও সাধক হাসন রাজার প্রপৌত্র দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরী, দেওয়ান জয়নুল জাকেরীন চৌধুরী ও দেওয়ান মমিনুল মউজদীন। আর বখত পরিবার থেকে যারা পৌর পিতা হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা হলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহচর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হুসেন বখত এর পুত্র মনোয়ার বখত নেক, আয়ূব বখত জগলুল এবং বর্তমান মেয়র নাদের বখত। এ দুই পরিবারের মধ্যে দেওয়ান মমিনুল মউজদীন তৃণমুল পর্যায় থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের মনকে জয় করে ৩ বার পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসাবে অত্যান্ত নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে পৌরবাসীর মনে স্থায়ীভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
অন্যদিকে বখত পরিবারের সুযোগ্য উত্তরসূরী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার বখত নেক ছিলেন জনদরদী গরীবের চেয়ারম্যান ও নেতা হিসেবে অতুলনীয়। আইয়ূব বখত জগলুল যদিও মমিনুল মউজদীনের সাথে দুইবার নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তথাপিও তার জনপ্রিয়তায় কোন ভাটা পড়েনি। সড়ক দুর্ঘটনায় মমিনুল মউজদীন স্ত্রী পুত্র সহ মৃত্যু বরণ করার পর যখন সুনামগঞ্জবাসী শোকে স্তব্ধ ও মূহ্যমান, তখন পৌর পিতা হিসাবে দেওয়ান পরিবারের আরেক উত্তরসূরী গণিউল সালাদিনকে পরাজিত করে উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে সুনামগঞ্জ পৌরসভার দায়িত্ব গ্রহণের পর পাল্টে যেতে থাকে সুনামগঞ্জের দৃশ্যপট। মউজদীনের জল জোছনার শহর সুনামগঞ্জকে মডেল পৌরসভায় রূপান্তর করতে রাস্তা ঘাট, কালভার্ট, দৃষ্টি নন্দন রিভার ভিউ এমনকি পৌর শহরের মানুষের চলাচলের কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন রাস্তা সম্প্রসারণসহ রাস্তার পাশে উন্নত দেশের আদলে জনচলাচলের জন্য গড়ে তুলেন ফুটআইল্যান্ড। এখনো অনেককে বলতে শোনা যায়, আয়ূব বখত জগলুল বেঁচে থাকলে হয়তো সুনামগঞ্জ পৌরসভার রূপ জৌলসে টিকরে পড়তো মমিনুল মউজদীনের জোছনার আলো। মমিনুল মউজদীন রাজনীতির সকল বলয় ভেঙ্গে সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে হতে পারতেন এমপি/মন্ত্রী। তদ্রুপ আইয়ূব বখত জগলুল আজ যদি বেঁচে থাকতেন তিনিও জাতীয় নির্বাচনে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে হাওরের জনপদ উন্নয়ন বঞ্চিত সুনামগঞ্জবাসীর উন্নয়নে রাখতেন জোরালো ভূমিকা। এ দুই নেতার কথা সুনামগঞ্জবাসী শ্রদ্ধাভরেই স্মরণ করবে বহুকাল।
২০১৮ সালের ১ জানুয়ারী ঢাকায় আওয়ামী লীগের জনসভায় গেলে সেখানে আকস্মিক ভাবে আইয়ূব বখত জগলুল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর আবারো শোকের ছায়া নেমে আসে সুনামগঞ্জের আকাশে বাতাসে। বিউগলের করুণ সুরে ক্রন্দন করে প্রতিটি পৌর নাগরিকের মন।
২৯ মার্চ ২০১৮ইং তারিখে অনুষ্ঠিত সুনামগঞ্জ পৌরসভার উপ-নির্বাচনে প্রয়াত আয়ূব বখত জগলুলের ছোট ভাই বর্তমান মেয়র নাদের বখত নৌকা মার্কা নিয়ে জয় লাভ করেন। নাদের বখত নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে জননন্দিত মেয়র আয়ূব বখত জগলুলের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার ঘোষণা দেন। সুনামগঞ্জ পৌর শহরকে নান্দনিকতার ছোঁয়া এনে দিতে এবং প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে নিরলস ভাবে কাজ করেছেন। গত উপনির্বাচনে হাসন রাজা পরিবারের প্রতিনিধি দেওয়ান গণিউল সালাদিন তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুললেও রহস্যজনক কারনে এবারের পৌর নির্বাচনে অংশ নেননি। দেওয়ান গণিউল সালাদিন কিংবা হাসন রাজা পরিবারের কোন প্রার্থী না থাকায় নির্ভার হয়ে নির্বাচনে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন বর্তমান পৌর মেয়র নাদের বখত।
পৌর এলাকার নতুনপাড়ার বাসিন্দা এডভোকেট রজত কান্তি সরকার বলেন, প্রশাসন যাতে একটি সুষ্ঠু অবাদ গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেন আমরা সেটাই কামনা করছি। আমরা যেনো সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রেখে শান্তিতে বসবাস করতে পারি সেদিকে নজর রেখে আমাদের প্রাপ্য পরিষেবা দিবেন সেই আশা রাখি।
জামতলা মহল্লার বাসিন্দা দিলোয়ার হোসেন দিলু বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ হলে বিএনপি’র মনোনিত প্রার্থীই জয়ী হবে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনীর কাছে একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিবেন সেই প্রত্যাশা রাখি।
আওয়ামীলীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী বর্তমান মেয়র নাদের বখত গত ৭ জানুয়ারী সুনামগঞ্জ রিপোটার্স ইউনিটির নেতৃবৃন্দের সাথে পৌর কার্যালয়ে এক সৌজন্য সাক্ষাৎ ও মত বিনিময় সভায় বলেন, সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। কলম সৈনিকদের জাতির বিবেক, রাষ্ট্রের তৃতীয় চক্ষুও বলা হয়ে থাকে। আপনারা সমাজের অনিয়ম দুর্নীতি আপনাদের লিখনীর মাধ্যমে তুলে ধরার কারনেই আমরা আমাদের ভুল ক্রটিগুলো শুধরাতে পারি। আপনারা সমাজ সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকার রাখার কারনেই সুন্দর হয় সমাজ। আমি পুন:রায় মেয়র নির্বাচিত হলে, ড্রেনেজ ব্যবস্থার মাধ্যমে শহরের জলাবদ্ধতা, রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো সংস্কারসহ শিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত বেকার যুবসমাজের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূর করতে কিছু কর্ম পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। সেগুলো বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন, আমি যেনো আমার প্রয়াত বড় ভাই জননন্দিত মেয়র আয়ূব বখত জগলুলের নান্দনিক পৌরসভা বিনির্মাণে নিজের সকল মেধা ও যোগ্যতা মানুষের সেবায় বিলিয়ে দিতে পারি। সেই সাথে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে সরকারের চলমান উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রতিটি পদক্ষেপ বাস্তবায়নে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারি।